অতিমারির ছোবল এখন ঘরে ঘরে। দীর্ঘশ্বাস আর রুপ বর্ণ গন্ধহীন একটা আধি ভৌতিক মুখোশ আটা জীবন এখন জীবনানন্দ দাসের কবিতার স্বাদহীন ঠাণ্ডা মাংসের মত ! আহা নির্মম ভার্চুয়াল সময় ! এই আত্মার সংকটকালে নতুন বই হাতে পাওয়া যেন বেহেস্তী মেওয়া। আর এই লকডাউনের সময়ে যদি লেখক নিজে হাতে স্বাক্ষর সহ বই উপহার দেয় তাহলে সেটা হয় বন্ধু’তার এওয়ার্ড – অ্যাচিভমেন্ট। ২১ মে অপরাহ্নে বেঙ্গল বুকস বইটা হাতে আসে। তারপর মুগ্ধ কিশোর পাঠকের মত এক চুমুকে গিলে ফেলা বা সেই রকম এক বৈঠকে বইটা পড়ে ফেলি ! কি এমন বশ শাপলা সপর্যিতার এই লেখায়?
বশ আছে। তার সহজিয়া ঋজু আর ঝরনার মত নির্ভার গতিশীল ছুটে চলা ভাষায়। ভাষার চেয়ে অধিক মুন্সিয়ানা তার গল্প বুননে – অপ্ল অপ্ল করে নির্মোহ ভাবে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা। এ অভিজ্ঞতা এক নারীর জীবনে ঝাঁপ দেবার, নারী হয়ে ওঠার লড়াই করে তিলে তিলে একজন শাপলা সপর্যিতা হয়ে ওঠার গল্প। প্রথমে একটা ভয় গলার ভেতরে আটকে ছিল। এই নারীবাদী লেখা আমাকে কার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে? নারী জীবনের বাঁকে বাঁকে অভিজ্ঞতা গুলি নিকষিত -অম্ল মধুর, নিঠুর, নির্মম, নি -ভক্তির এবং নির্মল। কিন্ত শাপলা সেটা কার মত করে বলে? সে কি তসলিমা নাসরিনের খোলামেলা চৌকশ বর্ণনা দিতে চায় ! নাকি আরেক ক্লাসিক নারীবাদী সিমন দ্য ব্যুভয়া হয়ে উঠতে চায়? প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক -কারণ এই দারুন দিনলিপি বাদ দেয়নি কিছুই, প্রথম প্রেমের শিহরন, চুম্বন স্পর্শ, প্রেমে প্রতারিত হওয়া, সংসার ও সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে নিরন্তর আশার ভেলায় ভাসা।
যে ভয়টা পেয়েছিলাম সেই রগরগে বর্ণনা নেই, যে কথা তসলিমার মত নারী লেখকদের বিরুদ্ধে সমালোচক মহল আঙুল তুলে দেখান। আমি অবশ্য বিশ্বাস করি না, প্রেমের এমনকি শারীরিক সম্পর্কের বর্ণনা সাহিত্যে, আত্মজীবনীতে থাকবে না। কিন্ত পাঠক হিসেবে বুঝেছি বাংলা সাহিত্যে এই এলাকাটি যেমন অনাবাদী তেমনি তেমন কেউ নিজের এই সব স্পর্শকাতর অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে বিনিময় করতে চাননি। ব্যতিক্রম তসলিমা নাসরিন। শাপলা এই ব্যতিক্রমদের একজন। তবে তার বর্ণনা আত্মিক। শ্বাসরুদ্ধ মুহূর্ত তার লেখায় কোমল ও হৃদয় স্পর্শী। তাই তার বুকের পাঁজর ভেঙ্গে আসা কবিতার ভাষা, সাড়ে সতের বছরের হৃদয়ের কারুকাজ, প্রথম কবিতার বই, প্রথম প্রেম -পুরুষের আলিঙ্গন সব উচ্চারিত হয়েছে মগ্ন সাহসে- জলের কুসুমের সৌরভে। তার দমবদ্ধ একাকী উপলব্ধি ‘এ নারী জীবনের সত্যি একটাই- নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মুল্য দিতে হবে এক এক করে গুনে গুনে জনে জনে।’

পাঠক ভাববেন না শাপলা আমার বন্ধু বলেই এত নাম কীর্তন। তার এই আত্মকথনে অন্তত আমার কোন উপস্থিতি নেই ! তাকে আমি দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগের সহপাঠি হিসেবে, মৈত্রী হলের মেয়ে হিসেবে- আন্দোলনে, কবিতা আবৃত্তি আর আর টি এস সি তে। তার মত ঝর্নার মত ছুটে চলা বন্ধুর জীবনে এত বন্ধুরতা আমি কখনো জানতেই পারি নি! তার সাথে আমার নাড়ী ছেড়া বন্ধুর বাঁধনে মুক্ত করেছে লুবনা নামের আরেক অগ্নি বলাকা। সেই লুবনাকে আপনারা এই লেখায় পাবেন, পাবেন লালমাই পাহাড়, ময়মনসিংহ শহর, ব্রক্ষপুত্র নদ, কাশফুল, লেখকের মা, মেয়ে সবার উপস্থিতি।
বইয়ের নাম ভাল লাগে নি। আমি হলে ‘নারীর শতরুপ’ বা ‘শতরূপে শাপলা’ এই রকম কিছু লিখতাম। অন্তর্জালে শাপলা পরিচিত নাম। তিনি নিজেকে বিলাসী লেখক হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। বিলাস বলতেই হয় – আমি ভাবি কিভাবে একজন দুই মেয়ের মা, যিনি শিক্ষিকা বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে টিউশনি করে এসে লিখতে বসেন ! কি জাদুমন্ত্রে সে সময় বের করেন ? আনুপ্রানন প্রকাশনের ছাপা ১২৮ পৃষ্ঠা যেমন ঝকঝকে তেমনি বাঁধাই চমৎকার । ২৮০ টাকার বিনিময়ে আপনি বেজার হবেন না – হলফ করে বলছি।
ইতি, কাললেখ , ৬ আগস্ট, ২০২১,মালিবাগ, ঢাকা।
ড: আহমেদ আবিদ:
‘রুমি’ নামেই বন্ধুরা চেনে। স্বভাবে বাউল, নেশা নতুন কিছু জানা। এক ডজন দেশ, দেড় ডজন মহানগর আর অর্ধ শতকের জীবনের চক্করে যমুনা পার থেকে আদিবাসী দারুগ ভূমি পারামাত্তার জল ( নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া) অবধি বাউলিয়ানা। জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বন্ধু, বড় নেশা পলায়ন, বিশেষ করে স্কুল পালানো। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্প ছেড়ে পালিয়েছেন। দেশের বাইরের প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের জল পানি ছেড়ে পালানোর রেকর্ড আছে।
ড. আহমেদ আবিদ নামে গবেষণা পেশায় বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্প্রতি বছর খানেকের চুক্তিতে ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ এর শিক্ষকতা শুরুর অপেক্ষায়। ‘লোকযোগ’ নামে একটি কিসসা দল তৈরী চেষ্টা করছেন। নাট্যকলা ও ইংরেজি ভাষায় সাবসিডিয়ারিসহ দর্শনে সম্মান সহ স্নাতকোত্তর। পিএইচডি করেছেন ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটিতে।
নির্মিত তথ্য চিত্র : … এবং স্বপ্নযাত্রী; ২০১০ ( Dreaming Vendors)
মঞ্চস্থ নাটক: কফিন, যেই দেশেতে।
চমৎকার অালোচনা। বইটির পরিচিতি ও মূল্যায়ন দুই-ই উঠে এসেছে সুন্দরভাবে।
বইটি পড়ার সুযোগ হয়েছে অামার। অামার মনে হয়েছেএই সমাজে নিয়ত দমন, নিষ্পেষণ এবং তার প্রেক্ষিতে গোপন রক্তক্ষরণ আর অভিযোজনের মধ্য দিয়ে নারীর প্রতিদিনের বেঁচে থাকার এক মর্মন্তুদ বিবরণ ‘হান্ড্রেড ফেসেস অফ উইমেন’। ধন্যবাদ ড: অাহমেদ অাদিব, একটি ভালো বইয়ের প্রাজ্ঞজনোচিত অালোচনার জন্য।
অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো একজন প্রাজ্ঞ উত্তর উপনিবেশী তাত্ত্বিক এবং নিবিষ্ট পাঠকের মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করবে, নিশ্চিতভাবেই।
প্রশান্তিকার সকল কলাকুশলি ও ড. আহমেদ আবিদকে জানাই ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা।