২২ অক্টোবর ২০২০ ষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী শুরু হয়েছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। এবার করোনা মহামারির কারণে সাত্ত্বিক পূজা ছাড়া অন্যান্য বিষয়গুলো পরিহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী ২৬ অক্টোবর সোমবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তা শেষ হবে। কল্পারম্ভ এবং সন্ধ্যায় বোধন আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে উৎসবের প্রথম দিন ষষ্ঠী পূজা সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধর্মীয় বিধিবিধান সমুন্নত রেখে দুর্গাপূজার আয়োজন ও অংশগ্রহণের জন্য সনাতন সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রতিবারের মতো দুর্গতিনাশিনী দুর্গা স্বামীর গৃহ কৈলাস থেকে বাবার বাড়ি বসুন্ধরায় আসছেন। দেবী বোধন ও অধিবাস সহকারে ষষ্ঠী পূজার মাধ্যমে শুরু হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের শারদীয় দুর্গোৎসব। ভক্তদের পূজা গ্রহণের জন্য দুর্গা দেবীর মর্ত্যে আগমনের পর ষষ্ঠীতিথিতে মণ্ডপে মণ্ডপে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার অধিষ্ঠান হয়। এ সময় বেলতলা কিংবা বেলগাছের নিচে দেয়া হয় ষষ্ঠীপূজা। দক্ষিণায়নের নিদ্রিত দেবী দুর্গার নিদ্রা ভাঙ্গার জন্য করা হয় বন্দনা পূজা।
“উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ” এর তথ্যমতে “শারদীয়া দুর্গাপূজাকে “অকালবোধন” বলা হয়। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাঁদের পূজা যথাযথ সময় নয়। অকালের পূজা বলে তাই এই পূজার নাম হয় “অকালবোধন”। এই দুই পুরাণ অনুসারে, রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। কৃত্তিবাস ওঝা রামায়ণে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। এই জন্য স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে শরৎকালে দুর্গাপূজার বিধান দেওয়া হয়েছে। হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, “…অকালবোধন শরতে বৈদিক যজ্ঞের আধুনিক রূপায়ণ ছাড়া আর কিছুই না।”পঞ্চপ্রদীপের শিখায় বোধন হলো দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার। সায়ংকালে চণ্ডীপাঠ আর ঢাক-ঢোল-কাঁসার শব্দে মুখরিত হলো চারপাশ ”।
দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হল হিন্দু দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি উৎসব। দুর্গাপূজা সমগ্র হিন্দুসমাজেই প্রচলিত। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজে এটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আশ্বিন বা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। শারদীয়া দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা বেশি। বাসন্তী দুর্গাপূজা মূলত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
আকাশে আকাশে শরতে মেঘের ভেলা, শিউলি ফুলের গন্ধ সুরভিত চারিপাশ। পূজার ঢাকের সরব আওয়াজে জেগে ওঠেছে দেবীর বন্দনা প্রাণের মেলা। দেবী দুর্গার আগমনে চারদিকে চলছে আনন্দ আয়োজন। ২২ অক্টোবর ঘটপূজা শেষে মহাসপ্তমীতে শুরু হবে মূর্তিপূজা। চক্ষুদান করা হবে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার। খুলে গেছে দশ প্রহরণধারিণী ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার অতল স্নিগ্ধ চোখের পলক। একটি বছরের জন্য ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে দেবালয়ে।
পাঁচ দিনব্যাপী হিন্দু বাঙালীর শারদোৎসব দুর্গাপূজা। খগড়-কৃপাণ, চক্র-গদা, তীর-ধনুক আর ত্রিশূল হস্তে শক্তিরূপেন দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধে মন্ডপে মন্ডপে ঠাঁই নিয়েছেন। ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনি, আর ভক্তকুলের আবহনের মন্ত্রোচ্চারণে দেবী দুর্গার স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আগমন ঘটেছে। পূজার মন্ত্রোচ্চারণ, মন্দিরে মন্দিরে ধূপ-ধুনোয় ভক্তদের নৃত্য আরতি, আর ঢাক-ঢোল, কাঁসর-মন্দিরার পাশাপাশি মাইকের আওয়াজে এখন মাতোয়ারা সারাদেশের পূজামন্ডপগুলো। নানা আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে পূজা মন্ডগুলো। থিমের অভিনবত্ব আর রকমারি আলোকসজ্জার সাজে সাজানো হয়েছে একেকটি পূজামন্ডপ। হিন্দুদের পাশাপাশি সব ধর্মের মানুষের যোগ দেয়ায় দুর্গোৎসব রূপ নিয়েছে সার্বজনীনতায়। সারাদেশের মন্দির ও পূজামন্ডপে ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ, উলুধ্বনির শব্দে দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের জানান দিচ্ছে।
ধর্ম ও সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও তা যে সার্বজনীন তা শারদীয় দুর্গাপূজা এলে সহজে বুঝা যায়। শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও শারদীয় দুর্গাপূজায় আনন্দের অন্ত নেই। সেখানকার মাইকে মাইকে ভেসে উঠে কীর্তন কিংবা পুরনো দিনের গানের সুর। ‘আজি শঙ্খে মঙ্গলগাঁও জননী এসেছে দ্বারে’ কিংবা ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশভুজা জগজ্জননী মা’ এই আহ্বান যেন আকাশে-বাতাসে। জ্ঞান-কর্ম ও নিদ্রার তিনগুণের আঁধারে দেবী মহামায়াকে বন্দনা করতে ভক্তপ্রাণে যেন আকুতির শেষ নেই।
আনন্দমুখর পরিবেশের পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও চোখে পড়ার মতো। প্রতিটি মন্ডপে পুলিশ ও আনসারের পাশাপাশি কোথাও কোথাও নিযুক্ত করা হয় rab সদস্যদেরও। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদের ছিল সতর্ক প্রহরা। অনেক মন্ডপে বসানো হয়েছে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর। তবে এতসব কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছেদ ফেলেনি পূজার উৎসবমুখরতায়।
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে ইতোমধ্যেই সুনাম অর্জন করেছে। যদিও এ ধর্মীয় সম্প্রীতিকে নস্যাৎ করার জন্য কোন কোন মহল থেকে চেষ্টা করা হলেও কিন্তু তারা সফল হয়নি এবং হবেও না। বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ও অন্যান্য দর্শন পালনকারী মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধে ওই অশুভ শক্তি যেমন আগেও সফল হতে পারেনি, আগামীতেও পারবেনা এটা আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস। আমাদের সবার একটিই পরিচয় আমরা সবাই বাঙালি, বাঙালিত্বই আমাদের আসল পরিচয়। এই পরিচয়ের সূত্রে সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জানাই শারদীয় শুভেচ্ছা।
মাহবুবুল আলম
: কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
বাংলাদেশ।