শৃঙ্খলার শিকল-দীন মোহাম্মদ মনির 

  
    

কতই না সুন্দর শৃঙ্খলায় পূ্র্ন জীবন! শৃঙ্খলায় কি না হয়; সাফল্যে ভরপুর সাজানো-গোছানো প্রতিদিন, শৃঙ্খলায় লাভ হয় কাংখিত বস্তু! যন্ত্রের মধ্যে শৃঙ্খলার রূপটি পরিপূর্নভাবে প্রকাশিত অর্থাৎ প্রোগ্রামড। কয়েকটি বাটন থাকে কাংখিত আচরনটি লাভের জন্য।

প্রোগ্রামড প্যানেলটিকে আমরা যন্ত্রটির মাথা বলি। মজার বিষয় হলো এর কোন হৃৎপিন্ড থাকে না যার দ্বারা নিজের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম। যন্ত্রটি হৃদয়হীন থাকলেই নিয়ন্ত্রিত আচরন পাওয়া সম্ভব। ভোক্তাদের জন্য যন্ত্রের এই আচরনটির নাম এফিসিয়েন্সি।

রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যেও শুধু মাথা থাকে এবং এই রাষ্ট্রযন্ত্রের উপাঙ্গ গুলোও এক একটি শৃঙ্খলিত যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু নয়। যে রাষ্ট্র এই মানুষ নামক হৃৎপিন্ডধারী প্রানীটিকে যত বেশী শৃঙ্খলায় বন্দী করে যন্ত্রে রূপান্তর করতে পারে সে রাষ্ট্র ততো বেশী আপাতদৃষ্টে সফল। শুধু মস্তিষ্কেই প্রাধান্য দেয়া হয় প্রায় রাষ্ট্রযন্ত্রে। মগজধোলাই এর কাজ চলে শিশুকাল থেকে। ধোলাইয়ের কাজটি চলতে থাকে পারিবারিক বলয়ের মধ্যেও। পুশিং , প্রেসার আর তথাকথিত উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেয়ার নামে মরনপণ লড়াই। শাখা-প্রশাখা ও পাতাগুলোকে নিয়ন্ত্রিত ভাবে একটি কাংখিত আকৃতিতে রূপান্তরের মাধ্যমে বনসাই বানানোর প্রচেষ্টা চলতে থাকে অবিরাম। বনসাই দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। গাছটির বিকাশকে ব্যক্তি সুখের জন্য বাধাগ্রস্ত করার মধ্যে আনন্দের এ রূপটি নির্মম নয় কি? সবুজ পাতাগুলোতে সূর্যের সোনালী আলোর প্রতিফলনের খেলায় গাছটির প্রানের উচ্ছ্বাস , বেড়ে উঠার সাথে আশ্রিত পাখ-পাখালির কোলাহল মূখর সুরের ব্যঞ্জনায় সদা নিসর্গ নিস্বন , মৃদু শীতল হাওয়ার উন্মাদনায় শাখা-পত্রের সন্মিলিত প্রানের স্পন্দন গাছটির জীবনকে যেন পরিপূর্নতা আর তৃপ্তিতে ভরিয়ে রাখে। শুধুমাত্র গাছটির জীবন নাশ কিংবা স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠার হুমকিসমূহকে দূরে রাখার শৃঙ্খলাটিই এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। শৃঙ্খলা দিয়ে শিকল না বানিয়ে বরং শৃঙ্খলার একটি জামা পড়িয়ে দিলে প্রানটি স্বাধীনতা ও স্বার্থকতার স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। জামাটি তার জীবন বিকাশে বাধা না হয়ে বরং সৌন্দর্য বর্ধনে সহায়তা করবে।

ব্যক্তিস্বত্তার অবাধ স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের উন্নয়নের জন্য শৃঙ্খলার  একটি সমন্বয় সর্বদাই জরুরী। প্রানবন্ত সমাজ তথা দেশ সেটাই যেখানে প্রানের নির্মল উচ্ছ্বাস আর অনুশীলন মাত্রাতিরিক্ত শৃঙ্খলা দ্বারা বাধাগ্রস্ত নয়। অতি শৃঙ্খলার মধ্যে মানব স্বাধীনতা থাকে না। নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাতো পরাধীনতারই সমার্থক বিষয়। যতটুকু শৃঙ্খলা প্রয়োগ করলে বিশৃঙ্খলায় পরিনত হবে না ঠিক ততোটুকুই কাম্য হওয়া উচিৎ।

দেশ, সমাজ, পরিবার নির্বিশেষে সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলার এই পরিমাপটি সম্পর্কে কর্তাগনদের যথাযথ ধারনা থাকলেই পূর্ণাঙ্গ স্বস্তি ও স্বাধীনতাবোধ প্রানবন্ত এবং অর্থবহ হয়। পরিমাপটির ধারনা কেবল মাত্র গভীর দর্শন ও বাস্তবতার সঠিক উপযুক্ততার ভিত্তিতেই লাভ করা সম্ভব। সর্বসাধারণ এই সূক্ষ দর্শন সম্পর্কে সর্বদা অবহিত থাকবে না এটাই স্বাভাবিক; তবে প্রয়োগে চর্চা অব্যহত থাকবে না এমন ধারনা যুক্তিহীন এবং ভীত্তিহীন।

সন্তান জন্ম দেয়ার মহৎ কর্মটি করার পর পরই পরবর্তী কর্তব্য হিসাবে প্রজন্ম গঠনে বাবা-মায়ের শৃঙ্খলার যথামাত্রা প্রয়োগে সচেতনতা সন্তানকে মানুষ বানাতে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। নিজ সন্তানকে যন্ত্রমানব কিংবা অর্থের যন্ত্র বানানো খুব একটা কঠিন কাজ নয় এবং এর সাফল্যে গর্বের অন্তরালে যে  বঞ্চনা থাকে তার খবর কতজনই বা রাখে বরং পরিনামে আত্মদহনে দগ্ধ হয় আর উপায়ন্তর না দেখে পূণর্গঠনে ব্যর্থ হয়ে আহাজারিপূর্ণ জীবননাশ বরন করে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানকে বা তার ন্যাচারাল প্রবনতাকে উপেক্ষা করে স্বীয়সার্থলব্ধমোহে ব্যাকুল হয়ে অথবা সামাজিক অন্ধ প্রতিযোগিতার মোহমন্দ্রজালে নিমজ্জিত হয়ে একই সাথে একক সন্তানকে বহুগুনে গুনান্বিত করার অভিপ্রায়ে অপ্রয়োজনীয় সম্মিলিত অপচেষ্টার যাঁতাকলে নিরন্তর পিষ্ট করার নিমিত্তে আরোপিত শৃঙ্খলাগুলো সন্তানটির মানবাত্মাকে শুধুই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সন্তানটি মানুষের গুনাবলী নিয়ে স্বাধীনভাবে পৃথিবীর বুকে পরিপূর্ণ প্রশান্তি নিয়ে বেঁচে থাকবে এটাইতো আমাদের প্রত্যাশা। বৃষ্টি আর কাদা-পানিতে খোলা মাঠে হৈ-হুল্লোর করে কাদামেখে একাকার হয়ে ফুটবল খেলার বিশৃঙ্খলাপূর্ণ এই নির্মল স্বাধীনতাটুকুকে নির্দিষ্ট বয়সের গন্ডির মধ্যে অবশ্য করনীয় উপকর্ম নামক শৃঙ্খলা দিয়ে ভূষিত করার নামই যথার্থ শৃঙ্খলা।

রাষ্ট্রযন্ত্রে শৃঙ্খলার যথার্থ ব্যাপ্তি কতটুকু হওয়া উচিৎ যাতে করে একাধারে সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠা ও মানবাত্মার স্বাধীন চর্চার অবাধ ক্ষেত্র রচনা হয় তা নিয়ে আলোচনার জন্য একদিকে একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র ও অন্যদিকে একটি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রের তুলনামূলক পর্যবেক্ষনে অন্তর্নিহিত বিষয়টির অনুধাবন সম্ভব। একটি উন্নত ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রে দীর্ঘ দেড় যুগের মত জীবনকালের অভিজ্ঞতা এবং অন্যদিকে শৈশব, কৈশর ও যৌবনের কিয়দংশ অতিবাহিত জন্মভূমি প্রিয় দেশ সম্পর্কে ব্যক্তিগত অনুধাবন আলোচনার অপেক্ষা রাখে।

যে দেশটিতে আমার দেড় যুগের মত লম্বা সময় কেটেছে সে দেশটির নাম অষ্ট্রেলিয়া যেটি পৃথিবীর উন্নত কয়েকটি দেশের একটি। দেশান্তরের শুরুর দিকে দেশটির অবকাঠামো, আইন-কানুন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খলার ঝলমলে রূপটি দেখে শুধুই মুগ্ধ হতাম। ভাবতাম রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপটি এমনই হওয়া উচিৎ। সুন্দর ও নির্ভেজাল জীবন অতিবাহিত করতে থাকলাম। ধীরে ধীরে সময়ের প্রবাহে উপলব্ধ হতে থাকলো কোথায় যেন জীবন পরিপূর্ণ নয়। একটা শূন্যতা , একটা হাহাকার অনুভব করতে থাকলাম। ভাবলাম এটা  সম্ভবত স্বদেশের ছোঁয়া বঞ্চিত অতৃপ্ত প্রানের বেদনা থেকে উৎসারিত  বিরাজমান কষ্টেরই ফলাফল। বিশ্লেষণ করলাম , অন্য দশটি জন্মসূত্রে অস্ট্রেলিয়ানের এ সংক্রান্ত ব্যাপারে মতামত নিলাম ; বের হয়ে এলো এই অপরিপূর্ণতার আর সীমিত স্বাধীনতার অন্তর্নিহিত কারন অার সেটা হলো শৃঙ্খলার অতিপ্রয়োগ প্রতিটি পদক্ষেপে। খেতে, পড়তে , বসতে, চলতে, কথা বলতে শৃঙ্খলার শিকলে বন্দী মানুষ। স্বাধীনতার পূর্ণ রূপটি যেন হাহাকার করে বলে, আমি কি তোমাতে বিরাজমান ? পরাজিত আত্মা উত্তরে বলে না হোক বিরাজমান , জীবনতো নিরাপদ। যেন সকল মৌলিক (ভাত, কাপড়, আবাস) প্রাপ্তিতে নিরাপদ কারাবাস। শৃঙ্খলার যথোপযুক্ত মাত্রাটি প্রয়োগে এরাও ব্যর্থ অনেক ক্ষেত্রে। অপরদিকে স্বীয় জন্মভূমি

প্রিয়দেশ বাংলাদেশর অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। শৃঙ্খলার অভাব সর্বত্র। স্বাধীনতার অবাধ চারনক্ষেত্র যেন এ মাটি। যার যা ইচ্ছা তাই চর্চা করতে  পারে সবাই। সত্যিকারের স্বাধীনতাটি শুধুই কয়েকটি বিশেষ শ্রেনীর মধ্যে উপস্থিত। দুর্বল ও অসহায় তাদের শিকার সর্বদাই।

শৃঙ্খলা আর বিশৃঙ্খলার সাম্যাবস্থা যা কিনা প্রত্যেকটি  নাগরিককে উপহার দেয় প্রভাবমুক্ত প্রানের বিকাশ , স্বাধীনচেতনার অনুশীলন আর প্রনভরে হাস্যজ্জল জীবনের নিশ্চয়তা সেটা খুঁজে বের করে প্রয়োগের মাধ্যমেই সফল রাষ্ট্র গঠন সম্ভব। এ কাজটির মহান দায়িত্ব সমাজ পরিচালনায় দক্ষ, বিজ্ঞ ও দর্শণধারী ব্যক্তিবর্গের হাতে। নীতিনির্ধারক নির্বাচন যদি শুধুমাত্র মুদ্রার নাম, রাজধানীর নাম আর তথ্যপ্রদানে পারদর্শিতার বিচারে নির্ভর হয়, তার মত হতাশাব্যঞ্জক আর হতে পারে না।

শৃঙ্খলার শিকল পড়িয়ে  নয়, বরং বিশৃঙ্খলার নগ্নদেহকে শৃঙ্খলা নামক সবুজ রংয়ের কাপড় দিয়ে ভূষিত করে টকটকে লাল রংয়ের রাজটিকার অহংকার প্রদানের মাধ্যমেই মুক্তির বহুকাংখিত গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব।

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments