শোকের রাজনীতি ও ১৫ আগস্ট । শিউলি আফছার

  
    

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে শতবর্ষী হতেন এবছর। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোকদিবসে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত প্রশান্তিকার আয়োজনে লিখেছেন শিউলি আফছার। 

আমার জন্মের পরপরই আমি রাজনীতি বুঝিনি। কেউ আমায় রাজনীতি শেখায়নি।ছোট ছোট চোখে দেখে বোধের বাকশে জমা করেছি মাত্র।
আমি অভাগী! মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। চরম সর্বনেশে এক রাজনৈতিক প্রজন্ম ছিলাম আমরা। ৭৫(জন্ম) পরবর্তীতে আমরা টেলিভিশনে জাতির পিতার মুখ দেখা দূরে থাক, কোনো প্রকাশিত সত্য ইতিহাসের বই হাতে পাইনি। হাইস্কুলে পড়াকালীন পাঠ্য বইয়ের কোনো পাতায় লেখা ছিলোনা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। লেখা ছিল হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে আমরা জিতেছিলাম! কোন সে হানাদার বাহিনী! এই শব্দের অর্থ জানার জন্য পাক পবিত্র জ্ঞানী মানুষের সংখ্যা আমাদের সময় খুবই কম ছিলো।

৯০ এর দশকে আমরা জনকণ্ঠ অথবা সংবাদ অথবা পরে ভোরের কাগজে ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের বিষয় নিয়ে আব্দুল গাফফার চৌধুরীসহ অনেকের প্রবন্ধে কিছু কিছু তথ্য পেতে শুরু করি। সোবহানবাগের এক বইয়ের দোকান হতে আমাকে আমার বান্ধবী আমার আগ্রহ দেখে মিজানুর রহমানের বই ‘আমি রাসেল বলছি’ কিনে দিল। আমি সারারাত সেই রাসেল নামক নিস্পাপ শিশুকে হত্যার প্রতিবাদের কান্নাভেজা চোখ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।যে জিনিসকেই চাপা দেয়ার চেষ্টা চলে, সেই বস্তুই মানুষের নিকট আরাধ্য হয়ে উঠে।
হাতে এলো আরো তথ্যাদি, শিশুটির দোষ ছিল, সে শেখ মুজিবের ছেলে! সে রমার কোলে ছিল! তাকে তাদের বাসায় তার মায়ের হাতের রান্না খাওয়া আর ভাবী ভাবী বলে ডাকা বাংলাদেশের বিপথে যাওয়া মেজর ডালিম, ফারুক গংরা মেরে ফেলেছে। তারপর আরো সময় পরে অপরাধীদের হত্যার স্বীকারের ভিডিও প্রকাশ পেতে থাকে বিদেশি টেলিভিশনে। রাজনৈতিক সুত্রের চেয়েও ওই বয়সে বুকের ভিতর অজানা প্রশ্ন এসে ভীড় করেছিল।এইটা কোনো কথা! এক ভোরে এক পরিবারের মা, বাবা,ভাই,ভাবী, কাজের সহকারী, বেড়াতে আসা আত্নীয় স্বজনের রক্তে রাঙা সিঁড়ি। অবিশ্বাস্য! দেখতে গেলাম ৩২ নম্বর ধানমণ্ডি! উহ! সে কী কান্না কেঁদেছিলাম ওই সিড়ির পাশে দাঁড়িয়ে। তারপর কতো কবির কতো রচনা, গান আর কবিতায় ভিজে গেছে আমাদের সাহিত্য আর সংস্কৃতি।

অনেক পরে ওই সময়ের সাক্ষী হিসেবে ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত একটি বই হাতে এলো, শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ! বঙ্গবন্ধু হত্যার ঠিক চার বছর পরে প্রকাশিত! সকল বিবেচনায় এটাকে দুঃসাহসিক কাজ বলা চলে। সংকলন টি প্রকাশের কয়েক মাসের ভিতরে এর ১২৫০ কপি বিক্রি হয়ে যায়। আমাদের প্রতিবেশী কমরেড পরেশ সাহা আমার আগ্রহ দেখে নানা বই দিতে থাকেন তার লাইব্রেরি হতে, কিন্তু তিনি আলাপে আলাপে লক্ষ্য করে বললেন, এক মুজিব লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে! মেয়ে বই দিলাম কমরেড হবার আশায়, হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত! তুমিতো ভীষণ শক্ত!

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যারা নীচু পশুর ন্যায় উল্লাস করেছেন, যে সব লেখক বুদ্ধিমান শার্টের আস্তিন গুটিয়ে বঙ্গবন্ধু অনুসারীদের দিকে তেড়ে এসেছেন, আজকে তারাই বঙ্গবন্ধুর স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর জন্য অশ্রুপাত করছেন, (শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ,আগামী প্রকাশনা)।

কাজেই হাইব্রিডদের ভীড়ে আপনি যে আগস্ট মাসে শান্তিতে কাঁদবেন, এই সুযোগ ও আপনার নাই! এতো ভীড়ে পড়লে যা হয়! আওয়ামী লীগ নামক বিশাল দলের কে কোথায় চিপা চাপায় অশ্রুপাত করছে, কে দেখে! কারন তিনি তো এতোই বিশাল নেতা ছিলেন যে তাকে সীমিত পরিসরে চিন্তার সুযোগ নেই। কাড়াকাড়ি করে কোনো লাভ নেই! তিনি সবার ছিলেন, আছেন।তার জন্য এদেশের মা বোনেরা রোযা রেখেছিলেন, যখন তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। সেই সময়ে নেতার উদারতাকে অনেকেই হীন স্বার্থে ব্যবহারে ব্যস্ত ছিল সেই প্রমানও পাওয়া যায়, তিনি এই বিষয় নিয়ে অনেক বক্তৃতা করে গেছেন।সেই বক্তৃতায় তার সিক্ত মনের সন্ধান পাওয়া যায় ( বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা)।

বঙ্গবন্ধু যে কতো কতো সাধারণ মানুষকে আন্তরিক ভাবে চিনতেন তা তার কারাগারের রোজনামচা পড়লে অনুমান করা যায়।কারাগারের রোজনামচায় তাঁকে নিয়ে বিষন্নতার ভুমিকা পড়ে অবাক হয়েছি। বাবাকে নিয়ে কন্যাদের (শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার) মর্মস্পর্শী ভূমিকা অসাধারণ লেগেছে। ১৯৪৮ এর ভাষা আন্দোলন এর সময় গ্রেফতার শুরু, তারপর ১৯৪৯, ১৯৫৮, ১৯৬২ জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারের পর আবার ১৯৬৬ সালে ৬ দফা নিয়ে ৮ বার বিভিন্ন জেলা শহরের জেলে গ্রেফতার হন এবং জামিন পান। শেখ হাসিনা কারাগারের রোজনামচায় ভূমিকায় লিখেছেন, ১৯৬৮ সালে ঢাকা জেলগেট হতে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় আবার গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তায় বন্দী করে রাখা হয়(৬ পাতায়,কারাগারের রোজনামচা)।

এই অসাধারণ বইটিতে অনেকের কথা হুবুহু সেইভাবেই লিপিবদ্ধ আছে, যেইভাবে লেখক বঙ্গবন্ধু নিজে লিখে গেছেন।পান্ডুলিপি সরবরাহের দুঃসাহসিক ঘটনা আমাকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থান দিয়েছে। কী কঠিন সেই যাত্রা।পাকিস্তানি সেনার চোখ এড়িয়ে বুদ্ধির সাথে সংগ্রহ করেছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেদিনের বঙ্গবন্ধু কন্যা! গ্রেট কালেকশন! প্রকাশের কাজটাও ছিল বার বার বাধাযুক্ত! কি অসাধারণ সাবলীল লিখা, ৬৪ পাতায় লিখেছেন, ফনীকে ডেকে আনলাম। ফনীও কিছুদিন পাগল ছিল,এখন ভালো হয়েছে।গান মন্দ গাইতে পারেনা। বললাম, ফনী বাবু গান গাও।সে দেহতত্ত্ব, মারফতি, কির্তন, মন্দ গায় না।(কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান)।

অনেক বুদ্ধিমান বলেন (সম্মানপুর্বক) তাদের রাজনীতির ফলাফল আওয়ামী লীগের তরীতে গিয়ে উঠেছে। অসমাপ্ত আত্নজীবনী আর কারাগারের রোজনামচায় অসংখ্য প্রমান পাওয়া যাবে পাতায় পাতায়! বঙ্গবন্ধু লিখেছেন পাতায় পাতায় মুক্তির মন্দিরে সোপান তলে, কতো কতো নেতা কর্মীদের ত্যাগ! কেউ মরেছে! কেউ অত্যাচার সইতে না পেরে পাগল হয়েছে।কারো কোনো অপরাধ খুঁজে না পেয়েও ম্যাচিস ছবির গুলজারের কাহিনির মতো পারিবারিক জীবন খন্ড খন্ড হয়ে নিঃশব্দে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কারাগারের রোজনামচা বইয়ের ৬৫ পাতায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে চলেছে।আরও আটজন কে গ্রেপ্তার করেছে বিভিন্ন জায়গায়। দমননীতি সমানে চালাইয়া যাইতেছে সরকার।

প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কঠিন সময়ের প্রেক্ষাপটের স্পিরিট বা আধ্যাত্মিকতা আজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা কেনো! শোকের সেই শোকাবহ বেদনাদায়ক অধ্যায়ের ভিতরে অকৃতজ্ঞতার জন্ম নিল কবে? কখন!? খন্দকার মোশতাক এর হাসেঁর মাংশের যুগের শুরু কি তবে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরে ফজর নামাজের ঠিক আগে! হাইয়্যা আলাস সালাহ! হাইয়্যা আলাল ফালাহের আহবানের মধ্যে এহেন নৃশংসতা তবে কি আন্তর্জাতিক চক্তান্ত্রে সম্ভব হলো! কয়েক বছর ধরে সেই গোয়েন্দা দলিল প্রকাশিত হয়েছিল তা দেখে রীতিমতো ভিমড়ি খাবার দশা! তবে কী! শংকর এই জাতিগোষ্ঠির ভিতরে মীরজাফরি আজো আছে! ছিলো কারো কারো মনে!

কারাগারের রোজনামচায় ৪৩পাতায় বঙ্গবন্ধু জেলখানায় হাজতিদের মধ্যে এক তথাকথিত আসামীকে দেখলেন, তিনি লিখেছেন, হাজতিদের মধ্যে নামাজ পড়াবার আগে বক্তৃতা করছেন, ওয়াজ করছেন,হাজতিরা বসে শুনছে।আমি দুরে দাড়াইয়া তারঁ বক্তৃতা শুনছি।তিনি বলছেন, খুব জোরে দুরুদ শরীফ পড়। শয়তান দূর হয়ে যাবে।জোরে পড়। সুন্দর চেহারা,অল্প বয়স, চমৎকার বলার কায়দা। তবে জামাটা খুব বড়। মাঝে মাঝে চক্ষু বুজে কথা বলেন।জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কি মামলায় এসেছেন।আমাকে এক পাহারা বললো, জানেন না, রেপ কেস!! এক ছাত্রীকে পড়াতো তার উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, মসজিদের ভিতর। মেয়েটার ১২/১৩ বছর, চিৎকার করে উঠলে লোক এসে দেখে ফেলে।

তারমানে, রাজনীতি সমাজনীতি সব জায়গায় ভালো মন্দের মিশেলে ভরা।কেউ ফেরেশতা নয়।মানুষ ফেরেশতার ভান করার চেষ্টা করে মাত্র,ফেরেশতা নয়! আবার শয়তানও নয়!
১৯৭৫ সালের পরে এদেশের মানুষ বিশ্বাস হারাতে শুরু করেছে,কোথাও কেউ নেই! এই জাতি সব পারে!

বিনম্র শ্রদ্ধা ১৫ আগস্টের ভোরে হত্যাকাণ্ডের শিকার সকলের প্রতি।একজন সেতারবাদক শেখ কামালের প্রতি, একজন আন্তর্জাতিক মানের এথলেট সুলতানা কামালের প্রতি, দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র রাসেলসহ সকলের প্রতি।যে খাতায় গুরুত্বপূর্ণ পান্ডুলিপি বঙ্গবন্ধু লিখেছেলেন সেইগুলো বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরবরাহ করেছিলেন, পান খাওয়া আর শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার ব্যতীত এই নারীর কিছুর প্রতি কোনো মোহ ছিলো না।কী সরল সেই চেহারা! এই সংগঠককে আত্নাহুতি দিতে হয়েছিল কোলে রাজনৈতিক ব্লাকহোলে!

রাজনীতি কী কোনোদিনই আর নির্মোহের, সাধারনের সাধের বস্তু হতে সক্ষম হবেনা! জটিলতা আর বিশ্বাসঘাতকতা ছেড়ে সাদা কাশফুলের মতো হতে পারবেনা? কবি মন প্রায়ই নিজের কাছে নিজেকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।

সহায়ক গ্রন্থ: কারাগারের রোজনামচা; অসমাপ্ত আত্মজীবনী- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ- সংকলন, আগামী প্রকাশনী।

শিউলি আফছার
কবি ও লেখক
উপ রেজিস্ট্রার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments