১৯ নভেম্বর ২০০৭ তাঁর চলে যাওয়ার দিন।
সঞ্জীব চৌধুরী, মুলতঃ গানের মানুষ, গীতিকার, শিল্পী, সাংবাদিক এমন সব পরিচয়ের বলয়ে আবদ্ধ হয়েই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সঞ্জীবদার কাছের মানুষেরা জানেন উনি আসলে এইসব পরিচয়ের বাইরে একজন আমুদে, সরল, স্বপ্নবাজ, প্রগতিশীল এবং অসম্ভব গুণী মানুষ ছিলেন।
আজ তাঁর আরো একটা চলে যাওয়ার দিনে, বসেছি এই মানুষটির সাথে জড়িয়ে থাকা আমার একান্ত কিছু আবেগগাঁথা নিয়ে। শুরু থেকেই শুরু করতে হবে…
জীবনে অনেক কিছু করতে চেয়েছি আমি। একদম ছোটবেলায় অল্প কিছুদিন গান করেছি, করেছি আবৃত্তি। এরপর কিছুদিন শুধুই পড়ালেখায় মনোনিবেশের চেষ্টা। লম্বা বিরতি নিয়ে আবার ফিরলাম অভিনয় নিয়ে।
১৯৯৩/৯৪ সময়কাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে, নুতন করে শুরু করলাম বিতর্ক, সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের সাথে কোরাস গান, আবৃত্তি, নাটক এবং একদিন মনে হলো সব বাদ এবার সাংবাদিক হবো বা লেখালিখি শুরু করবো।
তখন ”ভোরের কাগজের” রমরমা অবস্থা। জনপ্রিয় স্মার্ট দৈনিকের একটি। রোকেয়া হলে রুমে রুমে আমরা এই পত্রিকাটাই পড়ি। ভোরের কাগজের বিনোদনমূলক সাপ্তাহিক আয়োজন ছিল ”মেলা” পাতা। বেশ ভালোলাগা নিয়ে পড়তাম।
পড়তে পড়তেই একদিন মনে হলো আমি নিজে কেন লিখিনা। যুক্ত ছিলাম ছাত্র রাজনীতিতে। মধুতে নিয়মীত যাতায়াত, সেই সুবাদে সাংবাদিক তরুণ সরকারের সাথে পরিচয়। বিশিষ্ট ভদ্রলোক, ভোরের কাগজে কাজ করেন, বললাম আমার ইচ্ছের কথা। তরুণদা নিয়ে গেলেন ভোরের কাগজ অফিসে একদিন। জীবনের প্রথম এসাইনমেন্ট দিলেন অন্যপক্ষ সম্পাদক সুমনা শারমীন। সেটাতেই ফেল মারলাম। অতীব শরমিন্দা হয়ে সুমনা আপাকে সেটা জানাতে গেলাম সপ্তাহ খানেক পর। সেদিন আপার সাথেই দেখা হলোনা।
দেখা হলো লেখক আনিসুল হকের সাথে উনি আমাকে পাঠালেন মেলা সম্পাদক ”সঞ্জীব চৌধুরীর” কাছে। ছাত্র ইউনিয়ের সকল নেতা কর্মীদের মুখে মুখে ৯০ এর আন্দোলের সময়ের সঞ্জীবদার ভুমিকা এর মাঝেই শুনে ফেলেছি… গানের মানুষ হয়ে রীতিমত ভক্তকূল হয়ে গেছে তাঁর তখনই।
আমি তখন খুব বেশীই সরলা পল্লীবালা এক কিশোরীই বলা যায়, মানে একটা গুটিয়ে থাকা মানুষ। বেশীরভাগ সময় অন্যদের কথা শুনি। সেদিনও তাই, উনার টেবিলের সামনে যেয়ে বসলাম জড়োসড়ো হয়ে। প্রথমদিনই দেখলাম তাঁর সব কাজের পাশাপাশি মূল যে কাজ সেটা হচ্ছে পুরো অফিসকে ”হাস্য রসে” ভরপুর রাখা। তখন কাজ করেন, নবনীতা, সুমন পাটোয়ারী, শামীম সহ অনেক ঝকঝকে সব তরুণ তরুণী। তাহাদের মধ্যকার আলাপ আলোচনা, ইহা ভুলবার নয়। এতোই মজার সব রসিকতা। আমার সৌভাগ্য হলো একটু দূরে বসে তা উপভোগ করবার।
প্রথমদিনই আমাকে বললেন আমি যা নিয়ে ইচ্ছে যেন লিখে নিয়ে আসি।
সেই আমার লেখালিখি শুরু পত্রিকাতে, খুব সাধারণ লেখা, সাধারণভাবে করা কারো ইন্টারভিউ শুধু সঞ্জীবদার হাতে যেয়েই কি অসাধারণ হয়ে উঠতো। আমি আজকাল ফেসবুক এবং অন্য কিছু অনলাইন মিডিয়াতে টুকিটাকি যাই লিখি, অনেকের অনেক বেশি প্রশংসা পেয়েছি, পাচ্ছি। তবে আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে আমার লেখা যদি কারো এতটুকু ভালো লাগে তার অনেকখানি যিনি আমাকে শিখিয়ে গেছেন তিনি ”সঞ্জীব দা”।
যদিও লেখালিখি ধরে রাখতে পারিনি অনেকদিন। ২০০০ থেকে ২০০৫ আবার সব বাদ, ২০০৬ এর পর বোধ হয় প্রথম আলোতে যাব যাব করতে করতেই একদিন ‘যায় যায় দিন’ অফিসে চলে যাই পরিচিত অনেকগুলো মানুষের সাথে দেখা করতে। সেখানে নুরুল ইসলাম ছোটন উনি আমাকে যার সাথে দেখা করতে পাঠালেন লেখালিখি আবার শুরু করার জন্যে, তার রুমে ঢুকে আবার বিস্ময়ের পালা, আবার সঞ্জীবদা। আমাকে অল্প একটু সময়েই অনেক উত্সাহিত করলেন, নবউদ্যমে শুরু করতে বললেন, তাঁকে কথাও দিলাম, লিখবো।
কিন্তু তখন ৯ টা ৫ টার কাজটাই জীবনের প্রধান হয়ে দাঁড়ালো। আর হলোনা আমাকে দিয়ে। ২০০৯ এ দেশ ছাড়ার বছর খানিক আগে সঞ্জীবদাও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আর তো হলোনা দেখা!!!
আজও কিছু লিখতে গেলেই কেন যেন সঞ্জীবদাকে আমার খুব মনে পরে, কোনদিন বলা হয়নি, আজ বলি লেখালিখিতে আমি আপনাকে ”গুরু” মেনেছিলাম দাদা।
আপনাকে ভালোবেসে লাখো ভক্ত আজ যতোটা আবেগ নিয়ে গায়…
‘’তবে এই হোক তীরে জাগুক প্লাবন
দিন হোক লাবন্য হৃদয়ে শ্রাবণ
তুমি কান্নার রং, তুমি জোছনার ছাঁয়া ।।
আমি তোমাকেই বলে দেব
কি যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে
আমি তোমাকেই বলে দেব
সেই ভুলে ভরা গল্প, কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়
ছুঁয়ে কান্নার রং, ছুঁয়ে জোছনার ছাঁয়া’’….
আমি সেই ভক্তকুলের একজন। আমার কেন যেন মনে হয়, শুধু গানের লিরিকস যে কত সুন্দর হতে পারে সেটা সঞ্জীবদা বেঁচে থাকলে আমরা আরো অনেক কিছুই পেতে পারতাম।
সঞ্জীবদা, বাপ্পাদের ‘’দলছুট’’ তাঁদের প্রথম এলব্যামের গান, ‘’সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে, আউলা বাতাস খেলে’’। রোকেয়া হলের আমি যে রুমটিতে বসবাস করতাম, সেই রুমের সবাই ক্যাসেটে এই গান এতো বেশী শুনতাম এবং গলা ছেড়ে গাইতাম…
একদিন ভোরের কাগজে লেখা দিতে গিয়ে সঞ্জীবদাকে জানালাম সেই তথ্য। এই কথা শুনে এমন বিনয়ী হাসি দিলেন… আহ সরলতা। তবে সঞ্জীবদার এই সবকিছুই গভীরভাবে ছুঁয়ে ছিলো আমাদেরই রাজনৈতিক সহকর্মী বন্ধু শিল্পীকে। শুরু করেছিলেন তাঁদের যৌথ পথচলা! মেয়ে কিংবদন্তিকে নিয়ে ছিল তাঁদের সংসার জীবন…
আমি যা সব সময় বলি, শিল্পী মানেই চারপাশে থাকা মানুষের জানার বাইরেও অনেক অজানা অধ্যায়। একজন শিল্পী মানে তাঁদের থাকে একান্ত এক ভুবন। যাপিত জীবনের কান্না হাসির বাইরে অপার্থিব এক ভুবন। সেই ভুবনকে ছুঁয়ে থাকার চেষ্টা করতে করতেই অনেক সময় নিজের শরীরকেই বড্ড অবহেলা করা হয়ে যায়, ‘সময়’ দেয়না সময়।
জীবনে প্রিয় মানুষের হাতে হাত রেখেও কী ভীষণ দরদ দিয়ে গাইতে পারেন,
‘’হাতের উপর হাতের পরশ রবেনা
আমার বন্ধু আমার বন্ধু হবে না হবেনা
হাতের উপর হাতের পরশ রবে না রবেনা
শিশির ঝরুক সকালবেলা আমাকে তুমি করবে হেলা
আমাকে ভালোবাসবে ঠিকই
কিন্ত আমার হবেনা হবেনা’’!!!
আহা কী দরদেই না সঞ্জীব দা গাইতেন,
‘’যাই পেরিয়ে এই যে সবুজ বন
যাই পেরিয়ে ব্যস্ত নদী অশ্রু আয়োজন
যাই পেরিয়ে সকাল দুপুর রাত
যাই পেরিয়ে নিজের ছায়া বাড়িয়ে দেয়া হাত’’
সঞ্জীবদা যতোটা আনন্দ নিয়ে কন্ঠে তুলে নিয়েছিলেন শাহ্ আব্দুল করিমের গাড়ী চলেনা… ঠিক ততোটাই উদাসীন ছিলেন আসলে নিজের দেহ ঘড়ির ঠিকঠাক দেখাশুনায়। পোড়া চোখের গল্প শুনাতেন মানুষকে। শুনাতেন নোঙ্গরের গল্প।
তারপর, এক পলকেই চলে গেলে…
‘’পাগল, রাগ করে চলে গেল
ফিরেও তাকালো না’’!!!
আড়ি দিয়ে যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন দাদা, আমি আপনাকে মিস করি। এই যে আজ লিখলাম, মনে হচ্ছে আপনি বেঁচে থাকলে আমার যেকোন লেখা পাঠিয়ে বলতাম, দাদা একটু কাচি চালিয়ে ঝালিয়ে দিন প্লিজ, লেখায় যে ম্যাজিকটা আপনি নিয়ে আসতেন সেই ভালোবাসা পাক সবাই এবং সেটা নিয়ে পাঠক আমার লেখা পড়ুক।
সঞ্জীবদার কথা দিয়েই আজ করি শেষ, করি তাঁর বন্দনা… ‘’বাক্যের শুরু অন্য কোথাও তোমাতেই দেই দাড়ি যখন যেখানে নোঙর ফেলেছি সবাইকে আজ আড়ি’’।
আপনার রেখে যাওয়া ভালোবাসার মানুষেরা ভালো থাকুক।
প্রিয় সঞ্জীবদা, ভালো থাকবেন যেখানেই আছেন!!!
‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ আমার লেখালিখির গুরু!!!
নাদিরা সুলতানা নদী
কলামিস্ট, সাংস্কৃতিক কর্মী, প্রাক্তন ছাত্রনেতা
উপস্থাপক, রেডিও বাংলা মেলবোর্ন
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা