সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বিদায়ের রেশ না কাটতেই চলে গেলেন বাপ্পী লাহিড়ী। সর্বভারতীয় বা উপমহাদেশ বিবেচনায় বাপ্পী লাহিড়ী তুমুল জনপ্রিয় গায়ক। সুরকার । মজার মানুষ ছিলেন তিনি। সে মজা বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে গানে। আজ হিসেব করে দেখলে বোঝা সম্ভব গম্ভীর ভীতু হাসতে না জানা বাঙালিকে সিরিয়াস গানের নামে বৃত্তবন্দী হবার থেকে বাঁচিয়ে গেছেন বাপ্পী লাহিড়ী। একটা গান যে কেবল আবোল তাবোল হতে পারে আবার শুধু মাকা যা মাকা যায় রাম পাপ্পু বলে বলে গাওয়া যায় এটা তাঁকে ছাড়া ভাবাও যায় না। আবার দেখুন এই মজার মানুষটি কম বয়সে ডিসকো ড্যানসার গানে সারা উপমহাদেশ তোলপাড় করে দিয়েছিলেন। পোশাক, কথা, সুরে আধুনিক মানুষটি প্রচুর সোনা পরতেন। সবসময় প্রচুর সোনার গয়না পরতে ভালবাসতেন। বলতেন, ‘আমার ভগবানের নাম সোনা!’
তাঁর একটি গান, সোনার আখরে লিখা ভুলে যাওয়া নাম…. বাপ্পী লাহিড়ী অলোকেশ বাপ্পী লাহিড়ী আপনাকে ভোলা অসম্ভব।

সন্ধ্যার গুরু ছিলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান, তার পুত্র উস্তাদ মুনাওয়ার আলী খান, যার অধীনে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আয়ত্ত করেছিলেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত না শিখলে গান না জানলে আজকাল কন্ঠ বিকৃত করে হয়তো নাম করা যায় বা কিছুদিন ফড়িং এর মতো ওড়াও যায় কিন্তু টিকে থাকা যায় না। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে নবীন প্রজন্ম যদি কেবল দুটি বিষয়ও ধার নেয় তার একটি হবে সাধনা। অন্যটি শিরদাঁড়া ক’দিন আগেই আমরা লতা মঙ্গেশকারকে হারালাম। সে বেদনার রেশ ছিলো বিশ্বময় । আমাদের দু:খ কষ্ট বা মনস্তাপ ভাগাভাগি হয়ে গেছিল পুরা পৃথিবীর সুর রসিকদের সাথে। এবার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। হিন্দী বা অন্য ভাষায় গান করলেও ইনি কেবল আমাদের। বাংলা ও বাঙালির। তাই বাঙালিকেই মনে রাখতে হবে তাঁকে। মনে রাখার দায় নিতে হবে আমাদেরও। আমাদের বলতে বলছি বাংলাদেশের বাঙালির কথা। সন্ধ্যা’র সাথে যে দুজন বাঙালি গায়কের নাম অনিবার্য ভাবে চলে আসে তাঁদের একজন হেমন্ত আরেকজন মান্না দে। ২০০০ সালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সিডনি কনসার্টে মান্না দেকে উপস্হাপন করার। সে মজলিশে মান্না দে বলেছিলেন তাঁর এবং অন্যদের বাংলা গানের মূল শ্রোতা এখন বাংলাদেশের মানুষ। তিনি তাঁর জীবন সায়াহ্ণের সেই কনসার্টে আমাদের কে অনুরোধ জানিয়েছিলেন যেন বাংলা গানের মর্যাদা আর ভালোবাসার জায়গাটুকু বজায় রাখতে পারি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর বারবার মনে হচ্ছে তাঁকে মনে রাখবার কাজটা তো আমাদেরও।
এটা নিশ্চিত উভয় বাংলায় শোকের ছায়া আর বেদনা নেমেছে। আমাদের দেশে হয়তো মনে মনে তার ভাগটা বেশী। একে তিনি আমাদের হৃদয়ের অন্ত:পুরে তার ওপরে আমরা এখন বলতে গেলে গায়ক গায়িকা শূন্য এক অন্ধকার জগতে। আমাদের দেশের এবং দেশের বাইরের বাংলাদেশীদের সন্ধ্যা মান্না হেমন্ত আরতির বাইরে পা ফেলার সুযোগ নাই। নাই বলেই রিমিক্স বা আবার গাওয়ার ছলে বারবার ফিরে আসেন তাঁরা। আসবেন নাই বা কেন?
দশকের পর দশক ধরে আমাদের শহর বন্দর গ্রামে আনন্দ অনুষ্ঠান বা পূজা যে কোন উৎসবে বারবার গীত হয়ে আসছেন এঁরা। কথায় বলে সুরের কোন দেশ কাল ভেদ নাই। আপনি পাসপোর্ট ভিসা এমন কি করোনার ভয় দেখিয়ে মানুষের যাতায়াত ঠেকাতে পারেন কিন্তু সুরের আসা যাওয়া বন্ধ করতে পারবেন না। শাস্ত্র অনেক আগেই বলে রেখেছে শুদ্ধতম শিল্প হচ্ছে সুর। এমন কি যে ভাষা ছাড়া ও মানুষের মনে ঢুকে রাজত্ব করতে পারে। আর সে সুরের রাণী ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মাইকে রেডিওগ্রামে রেডিও বা যে কোন মাধ্যমে যখনই তাঁর গান ভেসে আসতো বুঝে নিতে কোন অসুবিধা ছিলো না কে গাইছেন। একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন- চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কি হবে বা গানে মোর ইন্দ্রধনু দু’ যুগের দুটি গান কিন্তু সে এক গলা সে এক আবেদন। আমাদের কৈশোরে শোনা মধু মালতি ডাকে আয় গানটি এতো যুগ ধরে স্বমহিমায় বেঁচে আছে। কিভাবে থাকলো ? কেন আজকালের শিল্পীরা মরিয়া হয়ে ওঠে এই গান গাইতে ? কারণ ঐ একটাই সাধনা।

মানুষ হিসেবেও অসাধারণ ছিলেন তিনি। আমাদের জীবদ্দশায় এতোবড় একজন লিজেন্ড পাশের বাড়ীতে থাকতেন অথচ সাড়া শব্দ বলে কিছু নাই। এঁরা এমনই। আনন্দবাজারে দেখলাম বিয়ের পর তাঁর স্বামী তাঁকে বলেছিলেন, সে তুমি যতোই নামী হও থাকতে হবে আমার একতলা বাড়ীতে। এক দোতলা মানুষকে বড় ছোট করে না বটে তবে পরিমিতিবোধ জানিয়ে যায় । আর সে বোধ থেকেই গড়ে ওঠে মাটির কাছের মানুষ। যাঁরা জীবনে এবং জীবনের পরও বেঁচে থাকেন জনগণের অন্তরে। হারাতে হারাতে প্রায় এতিম হয়ে যাওয়া বাঙলার সাংস্কৃতিক জগতে আরতি বা তেমন দু একজন ছাড়া আর কেউই থাকলো না। এখনো বেঁচে থাকা সু অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ মনে ধরেছে ভীষণ। তিনি লিখেছেন: সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শুনেই আমি সঙ্গীত চিনেছি। তার পরে সেই মানুষের গানে আমি ঠোঁট মিলিয়েছি। কিন্তু সন্ধ্যাদি যখন সুচিত্রা সেনের গলায় গান গাইতেন, তখন মনে হত যেন সুচিত্রাই গাইছেন। কী সুন্দর যে মিলত! ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র সেই বিখ্যাত ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু‘ গানটি আর কেউ ও রকম ভাবে গাইতে পারবে কি না সন্দেহ!
শেষ বয়সে এসেও মাথা নোয়ান নি। দিল্লী গিয়ে ঘাড় নামিয়ে গলায় মেডেল ঝুলিয়ে পদ্মশ্রী হবার চাইতে গীতশ্রী থাকাই সম্মানের। এটা জানতেন তিনি। ‘এ শুধু গানের দিন’, ‘আমি যে জলসাঘরে’-র মতো ফিল্মের গান কিংবা ‘দিবস রজনী, আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি’-র মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর কণ্ঠে সমান জনপ্রিয় হয়েছে। প্রকৃতার্থেই তিনিই তো ‘গীতশ্রী’! সম্প্রতি কেন্দ্র তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। ‘গীতশ্রী’ তা প্রত্যাখ্যান করেন।
১৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রে নেপথ্য গায়িকা হিসেবে গান করেছেন সন্ধ্যা। তবে যে কোনও কারণেই হোক বলিউডে নিজের সাঙ্গীতিক জীবন দীর্ঘায়িত করেননি। ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৬ সালে কবি, গীতিকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে বিবাহ। তাঁর বহু গানের গীতিকার শ্যামল। শ্যামলের সঙ্গে বিবাহের পর তাঁর জীবন খানিক বদলে যায়। মহিষাসুরমর্দ্দিনী মানে বাঙালির মহালয়াতে ভোর সকালের গান ও সন্ধ্যার জীবনের মঙ্গল প্রভাতের সূচনা। আজ তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
গীতশ্রী সন্ধ্যা সুরের যাদুকর বাপি লাহিড়ী অস্ত গেছেন সন্ধ্যা তারার ভীড়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে বলেন, রাতের যতো তারারা আছে দিনের আলোর গভীরে…. কোথাও আছেন কোথাও থেকেই যাবেন তাঁরা।
সিডনি, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২।