[কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে বিশ্বজুড়ে প্রায় প্রতিটা দেশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এই লেখাটি প্রকাশ কালে সর্বশেষ করোনা আক্রান্তের তথ্য:
বিশ্ব: মৃতের সংখ্যা ৩০৩১৩, মোট আক্রান্ত ৬ লাখ ৫২ হাজার ৭৯ জন, সুস্থ ১লাখ ৩৭ হাজার।
অস্ট্রেলিয়া: মৃতের সংখ্যা ১৬; মোট আক্রান্ত ৩৮৭৩; নিউ সাউথ ওয়েলসে আক্রান্ত ১৭৯১, ভিক্টোরিয়া ৭৬৯, কুইন্সল্যান্ড ৬৫৬, সাউথ অস্ট্রেলিয়া ২৮৭, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া ২৭৮, এসিটি ৭১, তাসমানিয়া ৫৯, নরদার্ন টেরিটোরি ১৫।
বাংলাদেশ: মৃতের সংখ্যা ৫, আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮, সুস্থ ১৫ জন।(সূত্র: আইইডিসিআর)
করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশান্তিকায় লিখছেন চিকিৎসক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ,সচেতন নাগরিক এবং নিয়মিত লেখকেরা। আজ লিখেছেন মেলবোর্ন প্রবাসী চিকিৎসক ও লেখক আহমেদ শরীফ শুভ।]

একজন চিকিৎসক রাজবাড়ি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে তার ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে পুলিশের হাতে নিগৃহিত হয়েছেন। তার অপরাধ, তিনি কেন করোনাভীতির সময় বাইরে বের হলেন। চিকিৎসক নিজের পরিচয় দেয়ার পরও পুলিশের প্রহার থেকে নিস্তার পাননি। সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে এখনো কোন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানা যায়নি। এমনকি কোন কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয়া হয়নি। চিকিৎসক সহ জরুরি কাজে নিয়োজিতদের চলাচল সীমিত করার মতো ভ্রান্ত কোন অধ্যাদেশ জারি হয়েছে বলে জানা নেই। তাহলে পুলিশের এই ন্যাক্কারজনক কাজটি কি সরকারি বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন নয়? তাহলে তার যথোপযুক্ত শাস্তি হবে না কেন?
যশোহরের মণিরামপুর উপজেলার এসিল্যান্ড মাস্ক না পড়ে বের হওয়ার অপরাধে তিনজন বৃদ্ধকে কানে ধরে দাঁড় করিয়ে শাস্তি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আবার তাদের ছবিও তুলে রেখেছেন। জনসাধারণ এই বৃদ্ধদের অপরাধ বুঝে উঠতে অক্ষম। অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে আসার ব্যাপারে সরকারী বিধি নিষেধ রয়েছে সত্য। কিন্তু এই বৃদ্ধরা কেউ প্রয়োজনীয় ভোগ্যপন্য কিনতে আর কেউ তা বিক্রি করতে বের হয়েছিলেন। তাছাড়া দেশে কোন ১৪৪ ধারা কিংবা সান্ধ্য আইন জারি করা হয়নি যে ঘরের বাইরে বের হওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এই বৃদ্ধদের অপরাধ হিসেবে তাদের মাস্ক না পড়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সুস্থ লোকদের ঘরের বাইরে বের হলে বাধ্যতামূলক মাস্ক পড়ার কি কোন অধ্যাদেশ জারি হয়েছে? তা ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বারবার বলা হচ্ছে, করোনা ভাইরাসের রোগীর সেবা কাজে নিয়োজিত না থাকলে কিংবা প্রত্যক্ষ সংস্রবে না থাকলে সুস্থ মানুষের মাস্ক পড়ার কোন দরকার নেই। শুধু তাই নয়, সঠিকভাবে মাস্ক পড়ার নিয়ম না জানলে এবং ব্যবহার শেষে তা কোথায় কিভাবে ফেলতে হবে তা না জানলেও মাস্ক ব্যবহার না করতে বলা হয়েছে। তাহলে এই এসিল্যান্ড কোন ক্ষমতা কিংবা বিধি মোতাবেক এই বৃদ্ধদের কানে ধরে দাঁড় করিয়ে শাস্তি দিলেন? এই বৃদ্ধদের হয়তো তার মতো মেয়ে আছে, আছে মেয়ের জামাই, নাতি নাতনী। এসিল্যান্ডের আত্মসম্মান বোধ না থাকতে পারে, কিন্তু এই অসহায় বৃদ্ধদের আত্মসম্মান বোধ নেই তা তিনি কিভাবে জানলেন? আরো অবাক ব্যাপার হচ্ছে, তার সাথে যিনি মাস্ক পড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার মাস্কই ঠিকমতো পড়া ছিল না; মাস্ক শুধু মুখ ঢেকেছিল, নাক নয়। তাহলে তিনি কী পর্যবেক্ষন করছিলেন? বাধ্যতামূলক মাস্ক পড়ার বিধানটি কি তিনি নিজে জারি করেছেন? যদি তাই হয় তাহলে সরকারকে ডিঙ্গিয়ে নিয়ে বিধান জারি করা এবং বয়োবৃদ্ধদের বিনা অপরাধে প্রকাশ্য রাজপথে অবমাননা করার অপরাধে দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে এই এসিল্যান্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হওয়ায় তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রত্যাহার করা কোন শাস্তি নয়। তাতে তার কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। তার যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেখছি ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের রাজপথে বের হলে পুলিশ কোন রকমের জিজ্ঞাসাবাদ না করেই মানুষকে লাঠিপেটা করছে। তাদের কেউ কেউ হয়তো একেবারেই অনোন্যোপায় হয়ে প্রয়োজনে বের হয়েছেন। কেউ হয়তো জরুরি সেবাদান কাজে নিয়োজিত। পুলিশ যদি ত্রাস সৃষ্টি করে শুরুতেই লাঠিপেটা করতে থাকে তাহলে এই মানুষগুলো নিজের প্রয়োজনীয়তার কথা কিভাবে জানাবেন?
সধারণ মানুষ মোটেও জনচলাচল সীমিত করার বিরুদ্ধে নন। তারা বরং শক্ত হাতে এই চলাচল সীমিত করার পক্ষে। বিভিন্ন সচেতন মহল থেকে বারবার আহ্বান জানানো হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ লক ডাউন করে প্রয়োজনে সান্ধ্য আইন জারি করে তা সুনিশ্চিত করতে। তা না করলে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের করণীয় নিয়ে মিশ্র ইঙ্গিত যাবে। এভাবে মিশ্র ইঙ্গিত দেয়া অবাঞ্চিত। আর পূর্ণাঙ্গ লক ডাউন ঘোষণা না করে কিংবা সান্ধ্য আইন জারি না করে রাস্তায় রাস্তায় মানুষকে লাঠিপেটা করা কিংবা অপমান করা শুধু সুশাসনের বিচ্যুতিই নয়, অন্যায়ও বটে। তা বরং সরকারের সমুদয় সদিচ্ছাকে পরাজিতই করবে।
অনেকেই বলছেন, পূর্ণাঙ্গ লক ডাউন করলে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কি হবে! কিন্তু পূর্ণাঙ্গ লক ডাউন না করে তাদের রাস্তায় লাঠিপেটা করা হচ্ছে কেন তাহলে? সরকার সম্প্রতি গার্মেন্টস মালিকদের ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছেন কর্মীদের বেতন দেয়ার জন্য। এই গার্মেন্টস মালিকদের অনেকেই শত শত কোটি টাকার মালিক। তাতেও জনগণ আপত্তি করেনি। সরকারের এই প্রণোদনা দেয়ার সামর্থ্য আছে। তাহলে শহরের খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে দুই সপ্তাহ দুই বেলা খাওয়ানোর সামর্থ্যও আমাদের আছে। এই মানুষগুলোকে দুই সপ্তাহ দুই বেলা খাওয়ানোর নিশ্চয়তা সাপেক্ষে সারা দেশ দুই সপ্তাহের জন্য পূর্ণাঙ্গ লক ডাউন ঘোষণা করা হোক। আর যদি সে সামর্থ্য সরকারের না থাকে তবে ভুখা নাঙ্গা মানুষকে দুই বেলা খাওয়ানোর জন্য ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে অনেকেই এগিয়ে আসবেন। ১৯৭১ এর ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়।
এই দূর্যোগ মোকাবেলায় সরকার, সরকারি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্যকর্মী ও জনসাধারণ কারোই জবাবদিহিতা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। জনগণের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার আগে রাজবাড়ির পুলিশ ও মণিরামপুরের এসিল্যান্ডের জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা চাই।
আহমেদ শরীফ শুভ
অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।