
বর্তমানে যারা আওয়ামী রাজনীতি করছেন তাদের অনেকেই ত্যাগী নন (হাইব্রীড বা নব্য সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ) আবার অনেকেই ত্যাগী কিন্তু আদর্শচ্যুত (ক্ষমতা আর অর্থের মোহে ভারাক্রান্ত ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত)। সমস্যা দুখানেই। আসলে রাজনীতি করা উচিত আদর্শবান ত্যাগী নেতাদের। তাদের কাছে রাজনীতি পেশা নয়, আবেগ-ভালোবাসা, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরনা !! ত্যাগী নেতারা জনগনের স্বার্থে কাজ করেন, উনারা জনসমর্থন ও জনগনের ভালোবাসা পেলেই বর্তে যান। টাকা পয়সা, পদ বা ক্ষমতা কখনই ওনাদের পদবিচ্যুতি ঘটাতে পারে না। তারা চাইলে তাদের মেধা দিয়ে ব্যবসা, বানিজ্য, সরকারী চাকুরী ইত্যাদি অনেক কিছুই করতে পারতেন। কিন্তু জনসেবায় ব্রতী হয়ে তারা তাদের জীবন জনস্বার্থে বিলিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করেন না। যেমন করে দেখিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ তৎকালীন নেতারা।

আজ অনেককেই দেখা যায় আওয়ামী লীগে বিভিন্ন পদ ও সুযোগ-সুবিধা চাইছেন। না পেলে দলের হাই কমান্ডকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিচ্ছেন, হাইব্রীড বা নব্য সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের দায়ী করছেন ইত্যাদি। যদিও এইসব অভিযোগ অনেকাংশেই সত্য এবং অযোগ্য সুবিধাবাদীদের বিভিন্ন পদে দেখা চক্ষুশুল বটে তবে আমার বক্তব্য খুব সহজ। আপনি পদ, টাকা বা ক্ষমতার জন্যে যদি রাজনীতি করতে এসে থাকেন তবে নিজেকে ত্যাগী নেতা দাবী করবেন না। কারন প্রকৃত ত্যাগী নেতারা পদ, অর্থ বা ক্ষমতার জন্যে রাজনীতি করেন না। পদ থাকুক আর নাই থাকুক তারা দলের দুঃসময়ে মাঠের রাজনীতি করেন, দলকে বাঁচান, নির্বাচনে বিজয়ী করতে সব ধরনের সহযোগিতা করেন। দলের সুসময়ে দল যখন ক্ষমতায় তখন সাধারন মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেন, সরকারের সাথে মানুষকে সম্পৃক্ত করে তাদের উপকার করেন, দলের কাজ সমালোচকের নজরে দেখেন ও চেস্টা করেন যাতে দলের দ্বারা কোন ভুল না হয়। ৬০-৭০ এর দশকে রাজনীতি করা অনেকেই প্রকাশ্যে দৃশ্যপটে নেই, তাদের অনেককেই দল সন্মান করতে পারেনি তবে তাই বলে তারা দেশকে ভালোবাসা ছেড়ে দেননি। প্রয়োজন পড়লেই তারা দেশের জন্যে এগিয়ে আসছেন। অনেকে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ছাড়াই দেশের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন।
কিন্তু এখন ত্যাগী নেতাদের মধ্যে কে যে আদর্শবান আর কে যে দুর্নীতিবাজ তা বোঝা মুশকিল। প্রথমত হাই কমান্ডের সাথে দহরম-মহরম না থাকলে পদ ও ক্ষমতা পাওয়া যাচ্ছে না। আর যাদেরকেই পদ বা ক্ষমতার সাধ দেয়া হচ্ছে দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছেন। শেক্সপিয়ারের “To be or not to be?” এর মতো এখন ত্যাগীদেরকেও প্রশ্ন করতে হচ্ছে যে ক্ষমতা পেলে তারা “দুর্নীতিবাজ হবে কি হবে না?” প্রশ্ন করতে হয় এই কারনে যে এইসব নেতাদের প্রশ্রয়ে বা সরাসরি অংশগ্রহনে লুটেরাদের দল দেশের টাকা লুট করছে। দেশে দুর্নীতি বাড়ছে।
এইসব ত্যাগী নেতারা ভুলে যান যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নামে কোন দুর্নীতির অভিযোগ নেই, নেই তাদের সন্তান হার্ভার্ড শিক্ষিত সজীব ওয়াজেদ জয় (বাংলাদেশ সরকারের অবৈতনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা), সায়মা ওয়াজেদ পুতুল (অটিজম বিশেষজ্ঞ), রেজোয়ানা সিদ্দিক টিউলিপ (যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্য), ও রাদওয়ান মুজিব ববির (CRI সহ নতুন প্রজন্মের জন্যে অনেক অসাধারন প্রজেক্ট নিয়ে যিনি কাজ করছেন) বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য আত্মীয়স্বজন যেমন প্রবীন রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য শেখ সেলিম ও তার ছেলে এফবিসিসিআই এর সভাপতি শেখ ফজলে নূর ফাহিম, শেখ হেলাল ও তার ছেলে সারহান নাসের তন্ময়, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপস, চীপ হুইপ নুরে আলম (লিটন) চৌধুরী, নিক্সন চৌধুরীসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের কারও বিরুদ্ধে তেমন কোন অভিযোগ নেই। কিন্তু আগে ত্যাগী ছিলেন এমন অনেক বড় বড় নেতার বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ প্রমানসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রদর্শিত হচ্ছে। তাই দল এবং দেশকে বাঁচাতে হলে এখন আত্মসমালোচনা ও পর্যালোচনার বিকল্প নেই। বিগত ১১ বছরে কাদের সম্পত্তি শত শত গুণ বেড়েছে, কারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে, পাচার করা টাকায় কোন কোন নেতার বা সরকারী আমলার বিদেশে বাড়ি-গাড়ি রয়েছে, কাদের প্রশ্রয়ে ও ইশারায় শেয়ার মার্কেট – হল মার্ক – ডেস্টিনি – সহ হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। খোঁজ নিলে জানা যাবে এদের অনেকেই পুরনো “ত্যাগী” কিন্তু আদর্শহীন-দুর্নীতিবাজ নেতা বা তাদের প্রশ্রয়ে থাকা সরকারী আমলা-কর্মকর্তা বা ব্যাবসায়ীক সম্পর্ক থাকা দুর্নীতিবাজ মানুষ।

তবে দলেরও সমস্যা আছে। দুঃসময়ের আদর্শবান ত্যাগী রাজনীতিবিদের সুসময়ে কাছে রাখা উচিত। আদর্শবান ত্যাগীরা সবসময় চেস্টা করবেন যাতে দলের দ্বারা মানুষের উপকার হয়, দেশের উন্নয়ন হয়। কিন্তু বাস্তবে সবসময় তা হচ্ছে না বলে শোনা যায়। তোষামোদকারীদের আর হাই কমান্ডের সাথে সম্পর্কধারীদের সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ত্যাগী নীতিবান রাজনীতিবিদরা পিছিয়ে পড়ছেন। ত্যাগীরা এখন দলের সমালোচনা করতে ভয় পান। কারন গঠনমূলক সমালোচনা গনতন্ত্রের ভিত্তি হলেও এখন সমালোচনা করলে দলে ঠাই হচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে দলে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তাদের একঘরে করে রাখা হচ্ছে, বা জামাত-বিএনপির তকমা লাগানো হচ্ছে। তাই ত্যাগী-হাইব্রীড সবাই এখন তেল দিতে পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। খন্দকার মোস্তাকের মতো তেল দেয়া লোক এখন দলে হাজার হাজার। আমি মাঝে মাঝেই ৭৫ এর ষড়যন্ত্রকারীদের ছায়া দেখতে পাই আমাদের আশে পাশে। তারা আওয়ামী লীগের ক্ষতি করার জন্যে সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। তাদের অতিদ্রুত চিহ্নিত না করা গেলে দলের জন্যে ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। তাই ত্যাগী হোক, পুরনো হোক, যতো বড় নেতাই হোক, যারাই আদর্শহীন-দুর্নীতিবাজ তাদের সমূলে উচ্ছেদ করতে না পারলে দলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আজ যারাই নিজেদের আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাকর্মী বলে দাবী করছেন, কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছেন, আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় না থাকে তবে তাদের কতজন দেশ ছাড়বেন, কতজন দল ছাড়বেন আর কতজন রাজনীতি ছাড়বেন তা বলা যাচ্ছে না !!
ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে দলের কিছু আদর্শহীন ত্যাগী নেতা (যারা হাই কমান্ডে বসে আছেন) উৎকোচের বিনিময়ে সুসময়ের পাখি, হাইব্রীড বা নব্য সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের (এমনকি বিএনপি – জামায়াত পন্থী) জায়গা করে দিচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে ও তারা দেদারসে দুর্নীতি করে যাচ্ছে আর তার জবাব দিতে হিমশিম খাচ্ছেন দলের ত্যাগী নেতারা।
নেতাদের কথা বাদ দিয়ে বলি কর্মীদের কথা। বঙ্গবন্ধুকে একবার মাওলানা ভাষানী এক কাজে নারায়নগঞ্জ যাওয়ার জন্যে “আট আনা” দেন। দিন শেষে উনি তা ফেরত দেন এই বলে যে উনি সাইকেলে গিয়েছেন, পয়সা খরচ হয়নি !! আর আজকের কর্মীরা? তারা নেতার কাছ থেকে পদ, অর্থ ও ক্ষমতার ভাগ দাবী করছেন। না দিলে নেতা পরিবর্তন করছেন। বিরাট কর্মী বাহিনী ছাড়া নেতা যেন ঢাল তলোয়ার বিহীন যোদ্ধা !! তাই কর্মীদের দাবী মেটাতে নেতাকে আরও বেশী দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরতে হচ্ছে। এ যেন এক দুস্টচক্র !! একমাত্র আল্লাহ পাকই জানেন এই দুস্টচক্র থেকে জাতি কবে রেহাই পাবে !!
যারা মনে করেন আদর্শ নিয়ে ত্যাগের রাজনীতি করা সম্ভব না তাদের জন্যে এখানে রইলো এক উদাহরন। ত্যাগের রাজনীতির এক উজ্জ্বল উদাহরন হচ্ছেন আমার বাবা অধ্যাপক মোল্লা মোঃ রিয়াছত উল্লাহ। উনি স্কুল জীবনেই বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত হন। এরপর চাঁদপুর সরকারী কলেজ অধ্যয়নরত অবস্থায় রাজনীতির প্রকৃত হাতেখড়ি ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম সাড়িতে অবস্থান করে ভর্তি হন ইংরেজী বিভাগে। পড়াশুনার সাথে চলে তুখোড় রাজনীতি। উনার বন্ধু বাংলা একাডেমীর পরিচালক বিখ্যাত কবি আসাদ চৌধুরীর মতে তখন রাজনীতি করতোই মেধাবীরা। অমেধাবীরা রাজনীতিতে স্থানই পেত না। তাই আমার বাবার মতো মেধাবীরা এগিয়ে এসেছিলেন দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের রাজনীতিতে।
ষাটের দশকের শুরুতে যখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশ উত্তপ্ত তখন উনি ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও হলের ভিপি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন ও পরে ১৯৬৩-৬৪ সালে ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচন করেন। ওই সময় বাংলার প্রাক্তন মূখ্যমন্ত্রী (১৯৪৬-৪৭) ও পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৬-৫৭) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী লেবাননে মৃত্যুবরন করায় বঙ্গবন্ধু ও যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনি উনার জন্যে কোন সময় বের করতে পারেন নি। ফলশ্রুতিতে মাত্র এক ভোটের ব্যাবধানে জিতে যায় ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি পদপ্রার্থী জনাব রাশেদ খান মেনন (জিএস পদে বিজয়ী হন ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া চৌধুরী)। এরপর বঙ্গবন্ধু ও শেখ ফজলুল হক মনির স্নেহধন্য হয়ে তাদের পরামর্শে রাজনীতি চালিয়ে যান ও ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থানের সময় আন্দোলনে শরীক হন। এলাকার মানুষের জন্যে উনার এত প্রবল ভালোবাসা ছিল যে উনি ঢাকার তেজগাঁও কলেজ ও চট্টগ্রামের সাতকানিয়া কলেজের শিক্ষকতা বাদ দিয়ে নিজের এলাকায় চলে আসেন ও মতলব ডিগ্রী কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। শুধু তাই না, বিয়ের পর উনার স্ত্রীকে রংপুর মহিলা কলেজ থেকে নিয়ে এসে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মতলবগঞ্জ পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ান। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে পুরো পাকিস্তানে ১১৪ তম হয়েও শুধুমাত্র ছাত্রলীগ করার অপরাধে উনাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়নি এবং উনি সরকারী আমলা হতে পারেন নি।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনির স্নেহধন্য হয়ে মনোনয়ন লাভ করেও ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কারনে নির্বাচন করতে পারেন নাই। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার ইচ্ছে থাকলেও হানাদার বাহিনীর কারনে যেতে পারেন নি। তরুন যুবনেতা হবার কারনে হানাদার বাহিনীর শর্তই ছিল উনাকে প্রতিদিন থানায় গিয়ে হাজিরা দিতে হবে, নইলে উনার পুরো গ্রাম তারা জালিয়ে ছাড়খার করে দেবে। তাই উনি সংগঠকের ভুমিকা পালন করেন। নিজের আত্মীয় স্বজনসহ অনেককেই উনি মুক্তিযুদ্ধে পাঠান। এটা টের পেয়ে উনার বাস ভবনে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী প্রথমে লুটপাট করে ও পরে অগ্নি সংযোগ করে ভস্মিভুত করে দেয়। এসময় উনি ও উনার স্ত্রী (মিসেস রহিমা খাতুন – প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা, মতলবগঞ্জ পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়) সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হন। এ সময় স্বামী-স্ত্রী দুই জন চাকুরীচ্যুত হন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু উনাকে বাংলার বানী পত্রিকার সম্পাদক অথবা বাংলাদেশ বেতারের ডাইরেক্টার হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি এলাকার মানুষের জন্য রাজনীতি করতে চান বলে ঢাকায় যেতে চাননি। তখনকার চাঁদপুর মহকুমায় রাজনীতি চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৯৭৫ সালের পরবর্তী দুঃসময়ে যখন আওয়ামী লীগ করার জন্যে লোক খুজে পাওয়া যেতো না তখনও তিনি অসীম সাহসে তার রাজনৈতিক কাজ চালিয়ে যান। তখন আওয়ামী লীগ বিভেদ দেখা দিলে তিনি মিজানুর রহমান সাহেবের আত্মীয় হয়েও তার সাথে যোগ না দিয়ে মুল ধারার আওয়ামী লীগে (আব্দুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে থাকা গ্রুপ – যাদের কাছ থেকে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা সভাপতির দায়িত্ব বুঝে নেন) কাজ করে যান ও পরে অবিভক্ত মতলব থানা শাখার সভপতি হন। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের দুঃসময়ে তিনি এ অঞ্চলে অওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের কে সংগঠিত করে রেখেছিলেন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে আসার পর তিনি পর পর দুই বার পুনরায় অবিভক্ত মতলব থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। জেনারেল এরশাদের শাসনামলে যখন অনেকেই জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন ও যখন বাংলাদেশে ফ্রীডম পার্টির মহোৎসব চলছিল তখন মতলবে আওয়ামী লীগের একজন প্রাক্তন সংসদ সদস্যসহ অনেকেই দল ছাড়েন, তখনও উনি দলচ্যুত না হয়ে দৃঢ়তার সাথে আওয়ামী লীগের জন্যে কাজ করে যান। ওই সময় আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাক্কা থাকায় উনি উনার কর্মীদের নিয়ে রাতের আঁধারে বৃষ্টির মধ্যে “চিকা” মারতেন যাতে লেখা থাকতো “বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই”। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে উনি শোক দিবসের অনুষ্ঠান করতেন কিন্তু তৎকালীন সরকার ও পুলিশের ভয়ে দু একজন ছাড়া কেউ অনুষ্ঠানে আসতো না। মাইক লাগিয়ে রাখতেন বাজারের দিকে। লোকে জিজ্ঞেস করতো প্রফেসর সাহেব, লোক নাই, মাইক লাগিয়েছেন কেন? উনি বলতেন মাইক লাগিয়েছি যাতে যারা এখানে আসতে সাহস পাচ্ছে না, তারাও যেন দোকানে বসে বসে বঙ্গবন্ধুর কথা শোনে। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর নাম ও প্রকৃত ইতিহাস শুনে বড় হয়। সারা জীবন অধ্যাপনা করে যা বেতন পেতেন তার সবটুকুই ব্যয় করতেন কর্মীদের জন্যে। উপার্জনকারী স্ত্রী থাকায় উনার সংসার এ যাত্রা বেঁচে যায়। সারা জীবন দিয়ে যাওয়া ছাড়া রাজনীতি থেকে পয়সা কামাইয়ের কথা উনি চিন্তাও করতে পারতেন না। জননেত্রী শেখ হাসিনার সমর্থনপুস্ট হয়ে ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর – ৩ (বর্তমানে চাঁদপুর-২ ও ৩ এর কিছু অংশ) নির্বাচনী আসন থেকে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের ভারত বিরোধী ও আওয়ামী বিরোধী প্রপাগান্ডা ও বিএনপির টাকার বিনিময়ে ভোট কেনার কৌশলে উনি অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। অনেককেই বলতে শোনা যায়, স্যার অধিকতর যোগ্য হওয়া সত্তেও স্রেফ আওয়ামী লীগ প্রার্থী হবার কারনে হেরে গেলেন। সেই প্রপাগান্ডাকারীরা অনেকেই আজও বেঁচে আছেন। তাদের প্রপাগান্ডা বুঝে হোক, না বুঝে হোক দিয়ে যাচ্ছেন তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে !!
১৯৯৬ সালে দল ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই আওয়ামী লীগ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। সুসময়ের মাছিদের ভিড়ে ত্যাগী নেতাদের রাজনীতি করা হয়ে যায় মুশকিল। উনি এরপর চাঁদপুর জেলার সিনিয়র সহ সভাপতি ও পরবর্তীতে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর উনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য মনোনীত হন। ২০১২ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর একজন মানুষের উপকারারর্থে গিয়ে উনি কুমিল্লার চান্দিনায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন।
উনি জীবিত থাকাকালীন স্বার্থের কারনে বা ভিন্ন দল করার কারনে অনেকেই উনাকে সমর্থন দেন নি, কিন্তু আজ বলছেন উনার মতো মানুষ এখন খুজে পাওয়া মুশকিল। উনার মতো রাজনীতিবিদ এখন দেশের দরকার। আজ (১৪ই সেপ্টেম্বর) আমার বাবার ৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। দীর্ঘ ৫০-৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে উনি হাজারো মানুষের উপকার করেছেন কিন্তু কেউ কখনো বলতে পারবে না উনি কোন দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন বা কারও কাছ থেকে উপকারের বিনিময় নিয়েছেন। আর আজ রাজনীতি হচ্ছে দুর্নীতিবাজদের আখড়া। রাজনীতি এখন পুরোদস্তুর পেশা – টাকা বানানোর হাতিয়ার – ক্ষমতা পাওয়ার হাতছানি। হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েও সস্তি পাচ্ছেন না অনেকেই। সবাই সৎ হওয়ার দাবী করলেও, সৎ রাজনীতিবিদ খুজে পাওয়া এখন মুশকিল।
আমরা সবাই আফসোস করি, খুজি সৎ ও ভালো নেতা কিন্তু আমরা বুঝতে চাই না যে আল্লাহ মানুষকে নেতা দেন তাদের ভিতর থেকেই, আকাশ থেকে নাজিল করেন না। তাই যতদিন জনগন দুর্নীতি না ছাড়ছে ততদিন দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতিবিদ পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া রাজপথের রাজনীতিবিদদের সাথে মেধাবী রাজনীতিবিদও দরকার। যতদিন মেধাবীরা রাজনীতিতে না আসবে ততোদিন রাজনীতি হবে অমেধাবীদের দুর্নীতির অভয়ারণ্য। আসুন আমরা দুর্নীতি ছাড়ি ও আমাদের মধ্যে মেধাবীদের রাজনীতিতে আসতে উদ্বুদ্ধ করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।
মোল্লা মোঃ রাশিদুল হক : মেলবোর্ন প্রবাসী শিক্ষক, গবেষক, রাজনীতিবিদ, কবি ও লেখক।