সময়ের জনপ্রিয় ধ্রুপদী শিল্পী সমরজিৎ রায়

  
    

সিন্টু কুমার চৌধুরী, কক্সবাজার থেকে: বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের এই সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ও গুণী সঙ্গীতশিল্পী সমরজিৎ রায়। বাংলদেশের কক্সবাজারে জন্ম নেওয়া সমরজিতের বাবা নেপাল চন্দ্র রায় একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। মা রত্না রায় গৃহিণী। সমরজিতের সঙ্গীত জীবনের প্রথম গুরু হলেন চট্টগ্রাম আর্য্য সঙ্গীতের উপাধ্যক্ষ পন্ডিত নির্মলেন্দু চৌধুরী। এরপরে তিনি সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন ভারতের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ পদ্মশ্রী পন্ডিত মধুপ মুদ্গল এবং পদ্মভূষণ পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী সহ আরো অনেকের কাছে।

নিজ মাতৃভূমিতে শিল্পী সমরজিৎ রায়

বিশ্বব্যাপী করোনার ছোবলে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ। ঘরবন্দী জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। কিন্তু আর ক’দিন এভাবে চলবে? মানুষ কাজ না করতে পারলে খাবার পাবে কোথায়? কেমন কাটছে এই দু:সহ করোনাকাল? এই প্রশ্নের জবাবে সময়ের জনপ্রিয় ধ্রুপদী শিল্পী সমরজিৎ রায় বললেন, রেওয়াজে প্রার্থনায় মা-বাবাসহ পরিবারের সাথে সময় কাটছে কিন্তু অজানা আশঙ্কা কাটাতে সময় লেগেছে। প্রথমদিকে মন খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ফুসফুসের ব্যায়াম,ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে নিজে ফিট থাকার চেষ্টা করছি।

বিশ্বব্যাপী তার রয়েছে অসংখ্য গানের ভক্ত, বাবা ও মা তার সবচে’ বড় ভক্ত। সমরজিতের রেওয়াজ ঘরে বাবা ও মায়ের সাথে।

দেশের হাজার হাজার শিল্পী, অভিনেতা, সাংস্কৃতিক কর্মী গত চার মাস ধরে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। হাতে গোনা কিছু মানুষ অনলাইনে বা টেলিভিশনের লাইভে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু এভাবে তো সম্মানী মেলেনা, মিললেও খুব অপ্রতুল। এ প্রসঙ্গে সমরজিৎ বলেন, অনলাইনে লাইভ অনুষ্ঠানে গান করা আর সরাসরি দর্শক ভর্তি মজলিসে গান করা তো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। তবুও গাইতে হয়। আর গান গাওয়াতেই যেখানে আনন্দ সেখানে সেটা অনলাইনে হলেও কিছুটা দর্শকের সান্নিধ্য তো পাওয়া যায়। এই পরিস্থিতিতে আমরা কেউ একশ’ ভাগ সন্তুষ্ট না হলেও কিছু করার আছে কি? স্বাভাবিক জীবন তো একে বলা যাচ্ছেনা। অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ অনেক বেশি। আর গান বন্ধ হলে তো দমই বন্ধ হয়ে যাবে।

ভারতের গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে একটি পরিবেশনায় সমরজিতের সাথে সহশিল্পীরা।

ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে দিল্লীর গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয় থেকে সঙ্গীতে উচ্চতর ডিগ্রী নেন সমরজিৎ। সারা ভারতবর্ষের গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিশারদের চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি অর্জন করেন বেশ কিছু সাম্মানিক এওয়ার্ড, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পন্ডিত ডি.বি পলুস্কর এওয়ার্ড, হরি ওম ট্রাস্ট এওয়ার্ড, সঙ্গীতা বসন্ত বেন্দ্রে এওয়ার্ড, বাসুদেব চিন্তামন এওয়ার্ড, নলিনী প্রতাপ কানবিন্দে এওয়ার্ড, সুশীলা এওয়ার্ড, সুখবর্ষা রায় এওয়ার্ড ইত্যাদি। তিনি ভারতের চন্ডীগড়ের প্রাচীন কলাকেন্দ্র থেকেও তবলা এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের উপর ‘সঙ্গীত বিশারদ’ ডিগ্রী নেন।

ভারতের ইন্ডিয়া গেটের সামনে কিংবদন্তী শিল্পী কুমার বিশ্বজিতের সাথে সমরজিৎ রায়।

শিল্পী সমরজিৎ যে সমস্ত গুণী সঙ্গীতজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন এবং একান্ত সান্নিধ্য পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মান্না দে, মৃণাল চক্রবর্তী, অনুপ জলোটা, পন্ডিত যশরাজ, পন্ডিত শিবকুমার শর্মা,পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া,ওস্তাদ জাকির হোসেন, জগজিৎ সিং, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, নির্মলা মিশ্র, হৈমন্তী শুক্লা,অজয় দাস, বটকৃষ্ণ দে, শ্রাবন্তী মজুমদার প্রমুখ।

ভারতের দূরদর্শন চ্যানেলে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন সমরজিৎ। তিনি ‘ডিডি ভারতী’ চ্যানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী কবিতা কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে।
জার্মানী, বেলজিয়াম, ভারত সহ বেশ ক’টি দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান তিনি। ভারতে মৈথিলী ভাষার ‘মুখিয়া জী” ছবিতে সমরজিৎ প্রথম প্লেব্যাক করেন।

২০১৫ সালে আরটিভি এওয়ার্ড নিচ্ছেন সদ্য প্রয়াত সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমানের কাছ থেকে।

সমরজিৎ এর প্রথম হিন্দী এলবাম ‘তেরা তসব্বুর’ ২০১১ সালে ভারতের জিমা এওয়ার্ডে “সেরা জনপ্রিয় আ্যলবাম” বিভাগে মনোনয়ন পায়।
“অচেনা একটা দিন’ শিরোনামের বাংলা আ্যলবামে সমরজিতের সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায় কিছু গান করেন কিংবদন্তী শিল্পী অনুপ জলোটা।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের আ্যলবাম “রবি রঞ্জনী” এবং হিন্দী গানের “প্রতিধ্বনি” ও “ফিকর” এর মোড়ক উন্মোচন করেন যথাক্রমে প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, প্রখ্যাত শিল্পী অনুপ জলোটা এবং ঊষা উত্থুপ প্রমুখ।
বিভিন্ন আ্যলবামে সমরজিতের সঙ্গে দ্বৈত কন্ঠে গান করেন বলিউডের জনপ্রিয় শিল্পী অন্বেষা দত্তগুপ্ত, রূপরেখা ব্যানার্জী, সঞ্চিতা সহ অনেকেই।
বাংলা গানের কিংবদন্তী গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা এবং কিংবদন্তী সুরকার অজয় দাসের সুরে ৪ টি গান এবং কিংবদন্তী শিল্পী ও সুরকার মৃণাল চক্রবর্তীর কথা ও সুরে ৭ টি গান সমরজিৎ তাঁর মৌলিক গান হিসেবে পেয়েছেন। এই ৭টি গানকে তিনি নিঃসন্দেহে তাঁর সঙ্গীত জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া বলে মনে করেন। কথা প্রসঙ্গে আরও একটি গৌরবের কথা জানালেন সমরজিৎ। আর সেটি হলো তার কথা, সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায় কিংবদন্তী শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার সঙ্গে গাওয়া দ্বৈত কন্ঠের “তুমি ভোরের পাখির মতো” ভীষণ শ্রোতাপ্রিয় একটি গান সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য একক গান প্রকাশও তার সেই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অসংখ্য একক গান। বাংলা ও ইংরেজী মিলিয়ে এ পর্যন্ত শিল্পীর ৮টি আ্যলবাম বেরিয়েছে।

মান্না দে’র মতো বড় এক শিল্পীর খুব কাছে যেতে পারা জীবনের অন্যতম পাওয়া।

সমরজিৎ দীর্ঘ ১২ বছর দিল্লীর নামকরা গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন।সেই সুবাদে তিনি অসংখ্য গুণী শিল্পী ও সাংস্কৃতিক মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন। তিনি ২০১৫ সালে
বাংলাদেশে ‘আরটিভি স্টার এওয়ার্ড’ এর সম্মান পান।
মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, চরণ সিং সহ ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে সরকারিভাবে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিতভাবে অংশ নিতেন সমরজিৎ। সেসব অনুষ্ঠানে ভারতের বিভিন্ন সময়ের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপস্থিতি তাকে অনুপ্রেরনা দিয়েছে। স্মৃতি হাতড়ে সমরজিৎ বললেন, ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালামের আমন্ত্রণে তিনি তিনবার রাষ্ট্রপতি ভবনে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। সেই সঙ্গে স্বয়ং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে সমরজিতের। এতো কাছে থেকে দেখা সকলের জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতিকে তিনি দেখেছেন নির্মোহ এবং সাধারণ এক মানুষকে।

কক্সবাজারে আমাদের প্রিয় স্যার নেপাল চন্দ্র রায়ের ছেলে সমরজিৎ ভারতীয় উপমহাদেশে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আর সুযোগ পেলেই সে মাটির টানে ফিরে আসে এই সমুদ্র পাড়ে। আমরা তার দীর্ঘ সঙ্গীত জীবন কামনা করছি।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments