ঘটনা ১:
ছেলেটি খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। ওর গান শুনলে মেয়েটির সব কাজ ফেলে চোখ বন্ধ করে গানের গভীরে হারিয়ে যেতে ভালো লাগে। ওরা দুজনেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেয়েটি ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে ছেলেটির কণ্ঠের প্রেমে পড়ে। ছেলেটিকে ইউনিভার্সিটিতে এমন অনেক মেয়েই বলে কিন্তু ছেলেটি গানকেই ভালোবাসে বেশী।কিন্তু এই মেয়েটি নাছোড়বান্দা ।
যখন তখন হামলা করে বসে, ওর জন্যে আলাদা করে গান গাইতেই হবে। মেয়েটির যখন গান শুনতে ইচ্ছে হয় তক্ষণই ছেলেটিকে গান গাইতেই হবে নাহলে অস্থির করে ফেলে। এমন করে কেউ ওকে বেঁধে ফেলেনি এর আগে। রবীন্দ্রনাথের সেই গানটা সত্য হয়ে গেলো ওর জীবনে, বিরস দিন বিরল কাজ /প্রবল বিদ্রোহে
এসেছ প্রেম / এসেছ আজ কী মহা সমারোহে।
মহা সমারোহে প্রেমে পড়ে গেলো এই অসম্ভব চঞ্চল কিন্তু ঝকঝকে পরিস্কার মনের এই মেয়েটির। মেয়েটির যা ভালো লাগে তা সে মোটামুটি কখনো জোড় করে , কখনবা আহ্লাদ করে নিয়ে নেয়। ওর জিদে না করা যায় না। ছেলেটিকে ধরে নিয়ে যায় গান শুনতে, কখনো নদীর ধাঁরে, কখনো ক্লাসের শেষে, কিংবা কোন আড্ডায়। আর রাত হলে ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কথা নয়তো চ্যাট। দিনের কোন মুহূর্তই বাদ যায়না। এক সঙ্গে ঘর করবার মতো সম্পর্ক। ছেলেটি এমন কোন মেয়ের সাথে জীবনেও পরিচয় হয়নি। এমন আচ্ছন্নে থাকতে ভালোই লাগে ওর। প্রেমের গানে আরও দরদ ঢেলে দিতে পারে।
মেয়েটা ছুটিতে দেশের বাড়ি গেলে ছেলেটা বুঝতো মেয়েটাকে একদিন না দেখলে ওর জীবন অচল মনে হয়। এক সপ্তাহকে মনে হয় কয়েক যুগ পেরিয়ে যাচ্ছে, যদিও মোবাইলে চ্যাট হয়, গান রেকর্ড করে পাঠায়। এখন মেয়েটিকে আবদার করতে হয় না । ওর নিজেরই মেয়েটিকে সব গান শোনাতে ইচ্ছে হয়।
৭ দিন পরে ফিরে এসে ২ দিন হয়ে গেলো মেয়েটি ছেলেটির সাথে দেখা করলো না। এ এক বিশাল বিস্ময়। ছেলেটি ছটফট করছে কখন মেয়েটির সাথে দেখা করবে অথচ মেয়েটি তেমন কিছু ভাবছেই না। মেসেজ করলে উত্তর দিচ্ছে না ।
ছেলেটা যখন মেয়েটাকে জীবন সঙ্গী ভাবতে শুরু করেছে ঠিক তখনই মেয়েটি দূরে সরে গেলো। ছেলেটি সরাসরি ফোন করে জানতে চায় কেন মেয়েটি এমন করছে, মেয়েটি বলল “ তোমাকে আর ভালো লাগছে না আমার আজকাল, আমাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য, অনেক বিষয়ে মতের অমিল, তাই মুভ অন করেছি, তুমিও তাই করো” ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েটি বরাবরই সত্যি কথা বলতে পিছপা হয় না । ছেলেটির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, কারণ সারাজীবনে এমন করে ও কাউকেই ভালোবাসেনি। বুকের ভেতরে ভীষণ ভাংচুরের আওয়াজ পায় ছেলেটা, গান গাইতে ভালো লাগে না, ক্লাসে যেতে ভালো লাগে না। বন্ধু ভালো লাগে না। মেয়েটি ওর জীবনের সবকিছু ওলোটপালোট করে দিয়ে খুব নির্বিকার ভাবে ওকে ভালো লাগে না বলে দিব্বি বেঁচে আছে। আগের মতো আড্ডা চলছে, হই হল্লা যেন কিছুই হয়নি। ছেলেটার জীবনে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের পড়ে সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে, অথচ মেয়েটির গায়ে যেন সামান্য বাতাসও লাগে নি।
ঘটনা ২:
ফেসবুকের একটি পেইন্টিং গ্রুপের সাথে জড়িত মেয়েটি তার নিজস্ব আঁকা কোন ছবি শেয়ার করবার সাথে সাথে অনেক প্রশংসা পেতো , সেই সাথে বৃষ্টির মতো ফ্রেন্ডস রিকুয়েস্ট। বন্ধু হতে চায় ওরা, ছেলে মেয়ে সবাই। তবে ছেলের সংখ্যা একটু বেশী। মেয়েটি খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের একটি মেয়ে, খুব একটা লোকজনের সঙ্গে ওঠা বসাও নেই ওর। ইউনিভার্সিটি শেষ করে বাসা, বাসায় মা’কে টুকটাক কাজে সাহায্য করা, পরিবারের সাথে বসে টিভি দেখা, অবসরে ছবি আঁকা। এমনই সহজ এবং স্বচ্ছ জীবন মেয়েটির।
মেয়েটি সব রিকুয়েস্টই সাথে সাথে গ্রহণ করে নেয় না । তাদের ওয়ালে যেয়ে একটু খোঁজ খবর নিয়েই তারপর গ্রহণ করে, তাও অনেক কম । এমন করেই একটা ছেলে চলে এসেছিলো মেয়েটার জীবনে একদিন। ছবির প্রশংসা করতে করতে, মেয়েটির প্রশংসা। মেয়েটি ছবি আঁকে, ছেলেটি সেই ছবিকে ঘিরে কবিতা লেখে। মেয়েটির আগে তেমন বন্ধু ছিল না , ছেলেটির প্রচুর বন্ধু। কিন্তু বন্ধু মহলেও এখন দুজনের জয় জয়কার পড়ে গেলো।
মেয়েটিরও ভালো লাগে হঠাৎ করে জীবনের ভিন্ন রঙে রঙিন হতে। ছেলেটির সাথে অনেক কিছু নিয়ে কথা বলা যায়, ছবি আঁকা নিয়ে, জীবন দর্শন, সমাজ ব্যাবস্থা এমন আরও অনেক কিছু যা মেয়েটির অন্য কারো সাথে কখনোই বলা হয়নি। একটু আলাদা এবং স্বল্পভাষী বলে সবার সাথে চুটিয়ে আড্ডা মারবার অভ্যাস ছিল না মেয়েটির, তাই ওর এইসব ভাবনা গুলোও কাউকে বলা হয়নি। ছেলেটিকে পাওয়ার পরে মনে হলো ও আসলে এতদিন একা ছিল। এই একাকীত্ব জীবন নিয়ে ও কখনোই মাথা ঘামাইনি। এই হঠাৎ পাওয়া ভালোলাগা আচ্ছন্ন করে রাখে মেয়েটিকে।
ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথে ছেলেটার মেসেজ, “ শুভ সকাল , নাস্তা করেছো? কখন যাবে ইউনিভার্সিটি? আজ কয়টা পর্যন্ত ক্লাস? কখন ফিরবে বাসায়?”
মেয়েটাও তাই “ শুভ সকাল, এইতো নাস্তা করছি”।
ছেলেটি সাথে সাথে, “ কি নাস্তা করো?” “ওই একই, রোজ যা খাই। ডিম, রুটি হালুয়া এইসব“। মেয়েটি জিজ্ঞেস করে,” তুমি কখন উঠলে ঘুম থেকে? নাস্তা করেছো? তোমার ওষুধটা খেয়েছিলে তো? ইনহেলারটা কিন্তু মনে করে সাথে নিয়ে বের হবে, নাহলে আবার সেদিনের মতো বিপদে পড়বে”।
রেডি হবার সময় ছেলেটি জিজ্ঞেস করে “ কি জামা পড়লে? দেখি একটা ছবি দাও তো” । মেয়েটি জীবনে কোন দিন সেলফি তুলতে পারতো না , এই ছেলেটির সাথে বন্ধুত্ব হয়ে প্রতিদিন অনেক অনেক ছবি তুলতে গিয়ে শিখে গেছে এখন। ছেলেটা চাওয়া মাত্র ছবি তুলে পাঠিয়ে দেয়। ছেলেটাও পাঠায়, সকালে বিছানায় শুয়েই একটা পাঠিয়ে দেয়, শুভ সকালের সাথে সাথে তার ঘুম জড়ানো ছবি। একদিন সেই ছবি না পেলে মেয়েটি প্রশ্ন করে,” আজ ছবি দাও নি কেন?” অভ্যস্ততা মানুষকে জড়িয়ে ফেলে বেশী।
এখন আর মেয়েটির কাছে ছবি চাইতেও হয়না, ও নিজেই যখন যেখানে যায়, ছবি তুলে পাঠায়। আসে পাশে যাই দেখে, ছেলেটার সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে হয় ওর। ছেলেটাও পথ ঘাটের ছবি, রাস্তায় চা খাওয়া, কিংবা মজার কিছু যা সামনে পায় সবকিছুর ছবি তুলে পাঠায়, সাথে তার অনুভূতির বর্ণনা দেয় কবিতার ছন্দে।
দু’জন দূরে থেকেও ঠিক যেন দূরে থাকে না আর। পাশাপাশি চলার মতো জীবন। যদিও দু’জনের পথ চলা ভিন্ন, অভিজ্ঞতাও ভিন্ন কিন্তু একজনের চোখ দিয়ে আরেকজন তা দেখে নিচ্ছে। কেউ কোন কিছু জানা থেকে পিছিয়ে নেই। মেয়েটির জীবন পালটে গেছে সম্পূর্ণ। গতানুগতিক জীবনের বাইরে যে এতো সুন্দর একটা পৃথিবী থাকতে পারে, তা সে চিন্তাও করেনি।
এখন আর পরিবারের সাথে টিভি দেখা হয়না। রাতের খাবার খেয়েই নিজের ঘর এবং সাথে মোবাইল। এমনি করে বছর খানেক পেরিয়ে গেলো, ওরা একজন আরেকজনের জীবন সঙ্গিনী প্রায়, তবে দেখা হয়নি তখনও। ছেলেটি থাকে ঢাকায় আর মেয়েটি ময়মনসিং। এবারের বইমেলায় মেয়েটির ছবি এবং ছেলেটির কবিতা দিয়ে এই বই বের হবে। মেয়েটি ভাবে ওরা এখন এক আত্মা, এক জীবন হয়ে গেছে। ছেলেটিকে খুব বেশী ভালোবাসে সে। প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে আছে ছেলেটির অস্তিত্ব। ও সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকায় যাবে, দেখা করবে তার সেই অলিখিত জীবন সঙ্গীর সাথে। ছেলেটাকে ওর সিদ্ধান্তের কথা বলবার সাথে সাথে ছেলেটা চুপ হয়ে গেলো। খুশী হওয়া তো দূরের কথা মেয়েটির এমন প্রস্তাবে মনে হয় একটু বিরক্তই হলো ছেলেটি। এরপর মেয়েটির কল এলে ও ধরে না। মেসেজের উত্তর দেয় না। এই পুরো এক বছরে কখনো এমন হয়নি। মেয়েটি খুব অবাক হলো।
আস্তে আস্তে একটা দূরত্ব শুরু হলো। মেয়েটি দেখছে ছেলেটি সারাক্ষণ অনলাইনে আছে অথচ ওর সাথে কথা বলছে না। দুদিন পরে ফেসবুকে দেখে ছেলেটা এদিক সেদিক বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে অথচ মেয়েটিকে কিছুই জানাচ্ছে না । মেয়েটি প্রতিদিন মোটামুটি ২৪ ঘন্টাই অনলাইনে ছেলেটির সাথে সময় কাটাতো। এই নিরবতা, এই দূরত্ব মেয়েটাকে ভেঙেচুড়ে শেষ করে দিচ্ছে। ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকে মেয়েটি, কখন টুং করে মেসেজ আসবে। অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো। ফেসবুকে প্রেমের কবিতা ফুরিয়ে যায়নি ছেলেটার। মেয়েটি ওর জীবনে নেই বলে কোন বিরহের কবিতা নেই সেখানে, ওকি তবে অন্য কাউকে ভালোবাসে এখন? এমন ভাবনা মনে আসতে বেশীদিন সময় লাগে না মেয়েটির। আর তখনই পুরো পৃথিবী মিথ্যে মনে হয় ওর কাছে।
মেয়েটির মনে হলো ও কি তবে ভুল করেছে এই ছেলেটিকে ভালোবেসে? ছেলেটি ওর সাথে প্রতারণা করলো? কিন্তু কেন? মানসিক ভাবে ভীষণ ভেঙে পড়ে।
এই যে দুটো সম্পর্কের ভাঙন, এ তেমন নতুন কোন ঘটনা নয়। আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কিন্তু আগে এই বিচ্ছেদ সামলে নেওয়ার সামাজিক পরিস্থিতির চাইতে এখনকার সমাজ ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটনাগুলোকে আরেকদিকে নিয়ে যাচ্ছে।
এর পরের ব্যাপারগুলো কিভাবে সামাল দেয়া যায় সেখানেই আমার দুটো কথা।
সম্পর্ক তৈরি বা গভীর হবার মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া আবার সম্পর্ক ভেঙে যাবার পর সামলে নেবার সময় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সোশ্যাল মিডিয়া। যার সাথে আর সম্পর্ক নেই , হবার আর কোন সম্ভাবনাও নেই সেই মানুষগুলোর গতিবিধি চোখের সামনে দেখে ভেতরের জ্বালা একশগুণ বেড়ে যায়। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার কিংবা আরও অনেক ধরণের সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে ব্যাপারগুলো “ শেষ হইয়াও হইলো না শেষ” অবস্থায় মানুষের ক্ষতকে দগদগে ঘা করে ফেলে। শুরু হয় ডিপ্রেশন, উৎকণ্ঠা, সেলফ এস্টিম কমে যায়, খুব বেশী পরিমাণে খিটখিটে মেজাজ, রাগ, হিংসা, প্রতিশোধ নেবার প্রবণতা, অপরাধ বোধ, অপরাধ বোধ থেকে নিজের ক্ষতি করবার চিন্তা, অন্যের ক্ষতি করবার চিন্তা আরও অনেক কিছু যেগুলো নির্ভর করছে আপনি কতটুকু জড়িয়ে পড়েছিলেন তার ওপরে।
এই প্রসঙ্গে আরও কয়েক ধরণের সম্পর্কের কথা উল্লেখ না করলেই নয়ঃ
অনেক বিবাহিত পুরুষ মহিলাও জড়িয়ে পড়েন এই ধরণের সম্পর্কে। একই বয়সের মহিলা পুরুষ হতে পারে। বয়স্ক মহিলার সাথে কোন যুবকের, অথবা কোন তরুণীর সাথে বয়স্ক পুরুষের। একাকীত্ব হয়তো মানুষকে দুর্বল করে দেয়, অথবা যা পাওয়া হয়নি এক সম্পর্কে, কেউ সেই দুর্বলতার কথা জানতে পেরে নীরবে জায়গা করে নেয় আরেক হৃদয়ে। কেউ আবার সুযোগ নিতেই আসে, একটু সময় কাঁটাতে । সমস্যা হলো হালকা করে “টাইম পাস” করতে করতেই একজন হয়তো একটু বেশীই ডুবে যায় অনুভূতির গভীরে, তখনই শুরু হয় জটিলতা। সবাইকে আবার এক ক্যাটাগরিতে ফেলে দিলেও চলবে না। তবে এমন হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যতটুকু গভীরতাই হোক না কেন, এসব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবার পর মানুষ অনেক মানসিক দ্বন্দ্ব এবং টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যায়।
কেউ হয়তো নিত্যই এমন সম্পর্ক গড়ছে আর ভাঙছে, কিন্তু কারো জন্যে এটা হয়ে দাঁড়ায় জীবন মরন সমস্যা । একজন হয়তো ভাবলো , “আর কখনো ওর কথা ভাববো না “। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথেই ফেসবুক নোটিফিকেশন মনে করিয়ে দিতে পারে তার কথা, কিছু অপ্রতিকর ছবি বা স্ট্যাটাস কিংবা মেমোরিতে চলে আসে অনেক কিছু। যে ক্ষত মাত্র শুকোতে শুরু করেছিল তা আবার ঘুরে ফিরে দগদগে ঘা হয়ে যায়। একজন প্রতিটা মুহূর্তে এতো কষ্টে আছে, অন্যজনের যেন মহা আনন্দের সময় যাচ্ছে। আজ এই পার্টি, কাল অন্যটা, আজ এই বন্ধু তো পরের দিন অন্যজন। তখন এসব দেখে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়, মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়।
আমার কাছে বিভিন্ন বয়সের প্রচুর মানুষ আসে এই সমস্যা নিয়ে। যারা কষ্ট পায় তারা সত্যি খুব বেশী কষ্ট পায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ছেলেরা কাউন্সেলিংয়ে যায় কম। বেশীর ভাগ সময় মেয়ে ভিকটিমরাই আসে। ছেলেরা হয়তো ভাবে এটা তাদের দুর্বলতা, তাই একাই সামলাতে যেয়ে অনেক কষ্ট পায়। কিন্তু আমি খুব দৃঢ়তার সাথে পরামর্শ দিতে চাই, দয়া করে কারো সাথে কথা বলুন। এটাই হবে আপনার শক্তি এবং সাহসের পরিচয়।
প্রথম পদক্ষেপ হলো সিদ্ধান্ত নেয়া, সম্পর্কটা আদৌ আপনি চান কিনা। অর্থাৎ এই সম্পর্কের কোন গন্তব্য আছে কিনা। উল্লেখিত দুটো সম্পর্কের বিচ্ছেদই কিন্তু পরিষ্কার নয়।একটা ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। কোন একজনকে এটা শেষ করতে হবে। সাধারণত যে কষ্ট পাচ্ছে সেই ছেড়ে দিতে চায়না, একটা আশার আলো টিম টিম করে বুকের ভেতরে জ্বলতে থাকে, যদি আসে সেই প্রত্যাশায়।
সিদ্ধান্ত নেবার জন্য নিজেকে প্রশ্ন করুন:
• আপনার সঙ্গে মিথ্যে বলছে কিনা
• আপনাকে মানসিক বা শারীরিকভাবে অ্যাবিউস করছে কিনা
• তার গল্পের সাথে ঘটনার হেরফের হচ্ছে কিনা
• আপনার প্রতি কোনোরকম অশ্রদ্ধা মূলক ইঙ্গিত বা কথা বলেছে কিনা
• বিবাহিত কিনা
• বয়স ঠিক বলেছে কিনা
• একাধারে অনেকের সাথে ফ্লার্ট করছে কিনা
• অথবা আপনার মনে অন্য কোন প্রশ্ন এলে তারও উত্তর খুঁজতে পারেন
এবার নিজের সাথে বোঝাপড়া করুনঃ
• যদি বিবাহিত কারো সাথে সম্পর্ক হয়, ধরেই নিতে পারেন (ধরে নেয়াই যুক্তিযুক্ত) এটার কোন গন্তব্য নেই । থাকলেও আপনি সেই গন্তব্য চান কিনা, কারো সন্তান থাকলে সেটাও বিবেচ্য বিষয়।
• গন্তব্য নেই জেনেও যদি সম্পর্ক দীর্ঘায়িত করতে চান, তাহলে এটাও ধরেই নিতে হবে যে, এতে কষ্ট অনিবার্য, নিয়মিত মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে পারেন। যেমন এই ছেলেটা যদি এখনও মেয়েটার আশায় বসে থাকে তাহলে কষ্ট পেতেই থাকবে, কারণ মেয়েটা সত্যি সত্যি “মুভ অন” করেছে। তাই সেটা এটা স্বাস্থ্যকর হবে না।
• সময় নিন, ১০ মাস বা ১ বছর যথেষ্ট সময় নয়, একটা মানুষকে বিয়ে করবার মতো গুরুতর একটা সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আরও সময় দরকার। মানুষকে ভালোবাসা এবং তার সাথে জীবন যাপন করা এক বিষয় নয়। ভালোবাসা ছাড়াও এতে অনেক কিছু নিয়ে ভাববার প্রয়োজন আছে।
• ছবি দেবার বেলায় বা ভিডিও চ্যাট করবার সময় অথবা ভিডিও শেয়ার করবার ব্যাপারে অত্যন্ত, আবারো বলি “অত্যন্ত সচেতন” থাকবেন। যদি দিয়েও থাকেন, সম্পর্ক শেষ করবার আগে একটা সমঝোতার মধ্যে তা সরিয়ে ফেলবার চেষ্টা করুন। অনেক বিশ্বাসী প্রেমিক বা প্রেমিকাও কিন্তু ব্ল্যাকমেইল করতে পারে।
• সিদ্ধান্ত নেবার সাথে সাথেই আপনাকে অনেক শক্ত হতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নেবার আগেই সব চিন্তা ভাবনা করে নিন, পরে নয়। “ You have to be cruel to be kind”.
• জোর করবেন না। জোর করে কারো সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক সম্ভব নয়। নিজেকেও ছোট ভাববার কারণ নেই। মনে রাখবেন এতে আপনার কোন ভুল ছিলোনা, প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজের অবস্থান থেকে কাজ করে। অন্যজন যদি অন্যায় করে সেটা তার কর্ম। আপনার কিছু কমতি নেই, শুধু হয়তো ভিন্ন মানসিকতার ফল।
• দুঃখ পেলেও কাজগুলো সমঝোতার মাধ্যমেই করবেন কারণ ঝগড়া ঝাটি, চেঁচামেচি, কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি কোন কিছুই সুস্থ সমাধান দিতে পারে না।
একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে সেটাই হবে আপনার লক্ষ্য এবং আপনি আপনার সেই লক্ষ্যের দিকে এগুতে শুরু করবেন ।
• সব সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ব্লক করে দিতে হবে। তার জীবনের গতিবিধি আপনার জানবার দরকার নেই। মন চাইলেও – না।
• ফোন নাম্বার মুছে ফেলবেন, যেন মন চাইলেও মেসেজ করবার উপায় না থাকে।
আমি জানি আমি যত সহজে বললাম , কাজটা অতো সহজ নয়। কষ্ট হবেই, যার সাথে ২৪ ঘন্টার সম্পর্ক গড়েছিলেন তার সাথে আর কথা বা চ্যাট না করলে ২৪ ঘন্টাকে যন্ত্রণাময় ৩৬ ঘণ্টা মনে হতে পারে। ডিটক্স করবার মতো, কিছুদিন কষ্ট হলেও আপনি পারবেন। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন, একবার সিদ্ধান্ত নেবার পরে ব্যাপারটা সহজ হবে। তবুও কুল কিনারা না পেলে কাউন্সেলিং এর সাহায্য নিন। মানসিক ভাবে সুস্থ থাকা প্রত্যেকটি মানুষের জন্মগত অধিকার। নিজেকে কষ্টে রাখবেন না। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন এবং নিজেকে ভালবাসবেন সবচেয়ে বেশী।
শিল্পী রহমান: গল্পকার, কবি, সংস্কৃতিকর্মী, কাউন্সেলর ও গবেষক। স্থায়ী নিবাস ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়ায়। কর্মসূত্রে এখন রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে।