[ সময়ের নন্দিত কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক বদরুজ্জামান আলমগীর জন্মেছেন ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জেরবাজিতপুরে। বহু বছর ধরে বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। ২১ শে অক্টোবরে বদরুজ্জামানআলমগীরের জন্মদিনে প্রশান্তিকার আয়োজন “ বদরুজ্জামান আলমগীরঃ বৃক্ষ একটি মনোহর” এ লিখেছেন তারেক হক।]
আব্বার রিটায়ারম্যান্টের পর চকচকে শাহীন স্কুল ছেড়ে এসে সরারচর শিবনাথ হাইস্কুল বড় মলিন লাগে। শহুরে শান শওকত মনকে মেকি একটা বনেদি আস্তরে ঢেকে ফেলে, নাক উঁচু করে। অনভ্যস্ত লুঙ্গির ভাঁজে পা আটকে হোঁচট খেয়ে পড়ার চেয়েও বেশি লজ্জা লাগে প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে স্কুলে যেতে। মনের রোদটা মুছে গিয়ে গুমরে থাকে মেঘলা আকাশ। বেদনা লুকাতেই বোধ হয় ক্লাসের মাঝে বৈচিত্র খুঁজতে থাকি ।
প্রথমেই সবার খাতার উপর একটা কমন স্বাক্ষর নজরে আসে। নাসির সঙ্গোপনে সবার খাতা উপরই স্বাক্ষর করে নাসির কোম্পানীর খাতা বানিয়ে ফেলছে। দ্বিতীয়ত নজরে এলো ক্লাসের মেধাবী ছাত্রদের অনেকেই একটা নির্দিষ্ট স্টাইলের হাতের লেখা আয়ত্ত করার চেষ্টা করছে অবিরত। লেখার ধাঁচ, বক্রতা আর টান সচরাচর লেখার চেয়ে বেশ ভিন্ন তবে কোথায় যেন একটা স্বকীয় সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। অচিরেই নাক উঁচু ভাবটা বিসর্জন দিয়ে আমিও সেই স্টাইল আয়ত্তের কসরতে যুক্ত হয়ে গেলাম।
ক্লাস নাইনে উঠতে উঠতে বুঝে যাই, আমাদের উপরের ক্লাসে একজন অসাধারণ মেধাবী আর অদ্ভূত ধরণের ছাত্র আছে। বাংলা স্যার অনুযোগ করেন, মেধাবী এই ছাত্রের লেখার হাত এতো ভালো, শুধু উড়ে যাবার ছটফটানির কারণে ভালো করবে না পরীক্ষায়। নাখোশ তবু ভিতরের আদরের ফল্গুধারাটা বোঝা যায়। এটিএম স্যার তো খুবই টেনশনে, বোর্ড পরীক্ষায় পরীক্ষক তার ইংরেজি লেখার মান ধরতে না পেরে বিভ্রমে ডুবে যাবে নিশ্চিত। শুধু দেখবে ছাত্রটা ভুল সব শব্দ দিয়ে খাতা ভরিয়ে রেখেছে। সেই স্যার কি করে জানবে প্রচলিত ইংরেজি শব্দ পছন্দ না হওয়ায়, নতুন ইংরেজি শব্দ বানিয়ে সে উত্তর লিখেছে? বৃটিশদের ডিকশনারিতে সেসব শব্দ না থাকার দায়ভার সে নেবে কেন? অংক স্যার দেখেন অ্যালজেব্রার হোল স্কয়ার মিলাতে পারলেও বাঁশ নিয়ে বানরের বাঁদরামি বা দূর্গ নির্মাণে শ্রমিকের দিনক্ষণের গোজামিল সে আর কিছুতেই মিটাতে পারে না। এসব পাজল না মিলাতে পারলে এসএসসিতে ভাল করবে কি করে? ক্লাসে ফার্ষ্ট বয় ছিলো কিনা সেটা কি আর অচেনা পরীক্ষক বিবেচনায় নিবে? স্যারদের এই একটা ছাত্র নিয়ে এতোসব দুশ্চিন্তার উত্তাপে নীচের ক্লাসের আমরাও টের পেয়ে যাই উপরের ক্লাসে একটা উনুন আছে, যার আঁচ দূর থেকেও সবাইকেই ছুঁয়ে যায়।

ঘটনাক্রমে তার স্কুল পরীক্ষার দুয়েকটা খাতা দেখার সুযোগ হয়, পরীক্ষার হলে বসে সে খাতায় যা লিখেছে, তাই মনে হয়েছে অসাধারণ।
সরারচর শিবনাথ স্কুলের বয়স তখন ৬৫ পেরিয়েছে। দোতলা লম্বা স্কুলে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। মোটা লোহার শিকের উলম্ব জানালাগুলো খুলে দিলে ক্লাসরুম আলোকিত হলেও চৈত্রের গরম কাটে না কোনভাবেই। ক্লাশ শেষে স্যার চলে গেলে গোল গোল ঘামের দাগ দেখে বুঝতাম নাসির তার ভিন্নতর স্বাক্ষর রেখেছে বেঞ্চের উপর। নাসির আলগোছে লুঙ্গি সরিয়ে বেঞ্চে ঘামের দাগের স্বাক্ষর করতো।
ঘাম আর গরমের সাথে কসরত করতে করতেই এসে যেতো বার্ষিক পরীক্ষার পুলসেরাত পার হওয়ার সময়। পরীক্ষা শেষে এক পশলা দক্ষিণা বাতাস যেনো বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সে বছর “আঁচল হিমাদ্রী”তে অভিনয়ের সুবাদে নতুন করে পরিচয় হয় নাট্যকার উপরের ক্লাসের সেই মেধাবী ছাত্রের সাথে।
এরই মাঝে আরেকটা চমৎকার লেখার স্টাইল স্কুলে চর্চা শুরু হয়ে গেছে, সেটা আগেরটার চেয়েও সুন্দর। সৌন্দর্যও যে বিরক্তির কারণ হতে পারে আমাদের ক্লাসের অনেককে পুরাতন স্টাইল ছেড়ে নতুন স্টাইল চর্চার প্রচেষ্টা দেখে টের পাওয়া যায়।
সহপাঠীদের মাঝে যেমন এক অদেখা রেশারেশি থাকে তেমনি উপরের ক্লাসের মেধাবীদের জন্য এক দূরত্বের সম্ভ্রম থাকে, আর সে যদি হয়ে ওঠে উদীয়মান কবি, নাট্যকার ও লেখক তবে সম্ভ্রমটা একটা উঁচু দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। তাই উত্তাপ ছড়িয়ে যাওয়া সেই মেধাবী ছাত্র, কবি, নাট্যকার ও নতুন হাতের লেখার উদ্ভাবক বদরুজ্জামান আলমগীর আরো দূরবর্তী হয়ে যায় যখন সে স্কুল পাশ করে কলেজে চলে যায়।
এরই মাঝে শাহ আজিজ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, শিক্ষামন্ত্রী বদরুদ্দৌজা চৌধুরী শিবনাথ স্কুল ঘুরে গেছেন। একদিন সকালবেলা প্রচার হতে থাকে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হয়েছেন। এমন সব বহতা ঘটনাবলী আমাকেও কখন স্কুলের চৌকাঠ পার করে দেয়, ঠিক ঠাহর করতে পারি না।
এ কলেজ, ও কলেজ ঘুরে আমি যখন বাজিতপুর কলেজে আসি ততদিনে ফার্ষ্ট ইয়ার প্রায় শেষের পথে। কলেজে এসে এক রাজনৈতিক দলের কিছু ছাত্রের রোষানলে পড়তে হয়। অন্য কোন রাজনৈতিক দলের আশ্রয় প্রয়োজন, আলমগীর ভাইয়ের সাথে আবারও দেখা হয়। এবার সে সমাজতন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত। প্রথমেই রাহুল সাংকৃত্যায়ন থেকে শুরু করে সমাজতন্ত্রের একগাদা বই ধরিয়ে দিলেন।
সমাজতন্ত্র নিয়ে পড়াশোনা, ভালোলাগা, মানুষ, মানবতা, মূল্যবোধের নতুন ধারাপাতের সেই যে শুরু পরবর্তী জীবনে ক্রমাগত তা ফল্গুধারায় বদলে গেছে।
এরপর আমরা জড়ো হতে থাকলাম সরারচর বাজার পার হয়ে দক্ষিণে এলএসডি গোডাউনের পর বড় মাঠ তার মাঝামাঝি কোথাও। সরারচর তখনও এতোটা শোরগোলের জায়গা হয়ে যায়নি। বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে ঈশা খাঁ এক্সপ্রেস চলে গেলে মাঠের পাশ দিয়ে ষ্টেশনের লোকজনের আনাগোনা কমে যেতো। বিকালের কোন একটা সময়ে একজন দুজন করে এসে বসে পড়তাম সবুজ ঘাসের উপর। গোবিন্দপুর থেকে জয়দেব, উত্তর সরারচর থেকে শিশির, রণেন, বাজারের পশ্চিম পাশ থেকে টান টান ইস্তিরি করা জামা পরে সুজিত, উত্তরের রেললাইন ধরে ভান্ডার ফটিক, মজলিশপুর থেকে তালেব, তেঘরিয়ার হারুন ভাই, মতিন ভাই আর শার্টের তিন বোতাম খুলে সবচেয়ে সুদর্শন শ্যামলদা এসে পড়লে আড্ডা চটুল হয়ে জমে উঠতো। একদল তরুণের মাঠের আড্ডা চটুলই হওয়ার কথা তবু সেটা সিনেমার চটকদার প্রচল কোন কাহিনী না হয়ে বরং চলমান সামরিক শাসন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বা সামনের কোন তাৎপর্যপূর্ণ দিবসে প্রতিবাদী কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতির খুটিনাটি, তারই মাঝে গল্প, হাসি, আনন্দ। সবচেয়ে দূরের গ্রাম সরিষাপুর থেকে যেদিন সরিষার তীব্র হলুদ রংয়ের মাঠ পেরিয়ে আলমগীর ভাই এসে পৌঁছাতো সেদিন আড্ডা হতো অন্যরকম, কোথায় যেন একটা স্রোত বয়ে যেতো। এরই মাঝে প্রায়সই ফটিক ও আলমগীর ভাইয়ের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের উপভোগ্য খুনসুটি লেগে যেতো। জোছনা যখন কুয়াশার সাথে মিশে দুধের মতো গায়ের উপর আস্তর ফেলতে শুরু করতো তখন সে আড্ডা ভাংগতো।
কোন পার্বণে বেশভুষা একটু সফেদ হলেই দল বেঁধে জীবনদার স্টুডিওতে ছবি তুলে রাখতে যেতাম, সে শুধুই কিছু মুখ ফ্রেমে বাধার জন্য? তার সাথে কি কিছু কিশোরের বদলে যাওয়ার প্রগলভ আনন্দকে বেঁধে রাখার প্রচেষ্টাও ছিলো না?
এই মাঠটা শিবনাথ স্কুলের সম্পত্তি। প্রায় বছরই শীতের সময় যাত্রা, সার্কাসের দল মাঠ দখল করে মাসের পর মাস প্রদর্শনী চালায়। যাত্রার আড়ালে চলে হাউজি ও জুয়ার আসর। রাত গভীর হলে তা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সম্ভবত ১৯৮৪ সালে এমনই বেপরোয়া জুয়ায় এলাকায় এক অরাজক অবস্থা। সিদ্ধান্ত হলো, জুয়াকে আমরা রুখে দাঁড়াবো। স্থানীয়ভাবে রুখতে গিয়ে অপদস্ত হতে হলো। তাই পরদিন কয়েকজন কিশোরগঞ্জ ডিসির সাথে দেখা করার জন্য রওনা হলাম। ডিসির অফিসে দেখা করার আর্জি জানিয়ে বারান্দায় অপেক্ষা করছি। সকাল গড়িয়ে দুপুর, ক্ষিদায় সবাই অস্থির, তখন ডিসির রুমে ডাক পড়লো। গ্রামের কয়েকটা কিশোরের দিকে তাকিয়ে ডিসি সাহেব অনেকটা তাচ্ছিল্যভরে তাড়াতাড়ি আর্জি পেশ করতে বললেন। আলমগীর ভাই এগিয়ে দাঁড়ালেন, দৃঢ় হলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন। আমরা লক্ষ করলাম তার মুখ থেকে গলগলিয়ে আলো বের হচ্ছে, তা ক্রমেই কড়া হয়ে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। সে উত্তাপে এতাটাই তেজ যে ডিসি সাহেব প্রথমে উত্তেজিত হলেন, পরে দ্রবীভূত হলেন। তিনি বললেন, গ্রামের ছেলেদের কাছ থেকে এতো শক্তি, যুক্তি ও তেজপূর্ণ বক্তব্য সে চিন্তাও করেনি। সে মুগ্ধ। জুয়ার আসর বন্ধে সে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। সে কথা রেখেছিলো।
আর আমরা ফিরে আসতে আসতে বুঝতে পারছিলাম সরিষাপুরের কোমল মোলায়েম সরিষার হলুদ রঙের এক কোমল বালক বদলে গিয়ে কি করে গনগনে এক সূর্য হয়ে জ্বলে উঠছে।
তারেক হকঃ জন্ম – কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার কালেখার ভান্ডা গ্রামে ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। শহর ও গ্রাম মিলিয়ে ছোটবেলা কেটেছে। বাবার চাকরীর কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম আর সবশেষে বাজিতপুরের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি, জগন্নাথ কলেজ থেকে ষ্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে পড়াশোনা এবং পরবর্তীতে কেনাডিয়ান স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ করেছেন।
উন্নয়ন কর্মী হিসাবে দীর্ঘদিন বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেছেন। সর্বশেষ প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে এডভাইজার হিসাবে কাজ করেছেন। বর্তমানে ফ্লোরিডায় বসবাস করেন।
