সহোদর -এস এম জাকির হোসেন

  
    

অপুর দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিলো কেবল। ঠিক তখনই শব্দ করে মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ঘুমটা কেটে যেতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। এমনিতেই গত কয়েকদিন ধরে ঠিকমত ঘুম হচ্ছে না, এখন কাচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় আর সহজে ঘুম আসবে না। সকাল ছ’টায় অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। অপু বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘এই মোবাইল হল এক মহা যন্ত্রণা। মানুষের শান্তি নষ্ট করার জন্য এমন একটি যন্ত্রই যথেষ্ট’। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাত একটা। এত রাতে কেউ কাউকে ফোন করে! অপু চুপচাপ শুয়েই থাকলো। মনে মনে বলল, যে-ই হোক ফোন না ধরলে এমনিই রেখে দেবে।
তবে ফোনটা বন্ধ হলো না। সাইড টেবিলের উপর তখনও অনবরত রিঙ বেজে চলেছে। অপু খেয়াল করলো, ফোনটা এতক্ষণ ধরে একটানা বাজছে, একবারের জন্যও রিঙ বন্ধ হয়নি। অপু সময় দেখলো। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে রিঙ হচ্ছে। এমন তো হবার কথা নয়। এত লম্বা সময় ধরে কখনও মোবাইলে একটানা রিঙ হয়!
অনিচ্ছা সত্বেও অপু বিছানা থেকে নামলো। ফোনটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দেখলো- ওটা তপুর ফোন।
– কী-রে তপু, তুই এত রাতে!
– দাদা, তুই কবে বাড়ি আসবি?
– তুই এই কথা বলার জন্য এতরাতে ফোন দিয়েছিস?
অপর প্রান্তে কোন সাড়া নেই। অপু কিছুটা রাগত স্বরে আবার বলল, কী-রে, কথা বলছিস না কেন?
অনেকক্ষণ পর তপু বেশ নরম স্বরে বলল- দাদা, তুই বাড়ি আসবি না?
ভাইয়ের কণ্ঠে আকুতি শুনে রাগটা পড়ে গেলো অপুর। সে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল,
– মাত্র তো দুই মাস আগে বাড়ি থেকে ফিরলাম। এখন কী করে আসবো?
– মা’র খুব কষ্ট হচ্ছেরে দাদা। সারাক্ষণ তোর কথা বলে।
– কেন? মা’র কি হয়েছে? অপুর কণ্ঠে উদ্বেগ।
– মা’র শরীরটা ভাল যাচ্ছে না রে।
– তুই আছিস না, মা’র দিকে খেয়াল রাখতে পারিস না?
– তা তো রাখি, কিন্তু মা তোকে খুব মিস করছে। বলে, অপুর চাকরি করার দরকার নাই, ওরে বাড়ি আইতে ক।
– তুই মাকে একটু বুঝা তপু।
– আমারও তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, তুই বাড়ি চলে আয় দাদা।
– কী-রে! তোদের হল কি? তুইও কি মা’র মত অবুঝ হলি?
– দাদা, তুই বুঝবি না। তোকে ছাড়া বাড়িটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
– তোরা এমন করলে চলবে কী করে বল তো?
তপু কিছুক্ষণ চুপ থেকে অভিমানী কণ্ঠে বললো- তাহলে তুই আসবি না?
– এমন করছিস কেন রে তপু? এত দূর থেকে চাইলেই যখন তখন আসা যায়? মাকে বলিস, আমি আগামী মাসে আসবো।
– থাক, তোর আসা লাগবে না। তপুর কণ্ঠে অনুযোগ।
– এমন অবুঝের মত কথা বললে হবে? বললাম তো আগামী মাসে আসবো।
– হুম, আমি অবুঝ। আমি কিছু জনিনা, তুই কালই বাড়ি আসবি। আমি কালরাতে তোর জন্য ষ্টেশনে অপেক্ষা করবো।
দু-প্রান্তেই কিছুক্ষণ নীরবতা।
তপু আবার বললো- কী- রে দাদা, আসবি না?
– নতুন চাকরী, ছুটি পাব না।
– চাকরী করা লাগবে না। তুই চলে আয়। বাড়িতে যা আছে, তাতে তোর চলে যাবে।
– তোরা এমন করলে আমি এতদূরে কী করে থাকি বলতো?
– অতসব বুঝিনা, কালরাতে আমি তোর জন্য ষ্টেশনে অপেক্ষা করবো।
– বুঝছি, তোরা আমাকে ঢাকায় থাকতে দিবি না। তোর অপেক্ষা করতে হবে না। আমি একাই আসতে পারবো।
– এহ! আমি বুঝি জানিনা তুই কেমন বীরপুরুষ। কালীবাড়ির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একা আসতে পারবি? ঐ-পথে আমি কোনদিন তোকে একা আসতে দিয়েছি?
অপু হেসে ফেললো।
– তুই আমাকে কতকাল আর পাহারা দিবি?
তপু হাসতে হাসতেই বলে- সারাজীবন।
– ঠিক আছেরে ছোটু, আমি আসছি।
– আয়। দাদা, তোকে আমি অনেক মিস করি।
অপু হাসে। – তুই একটা পাগল।

ঢাকা থেকে শিমুলপুর ষ্টেশনে প্রতিদিন একবারই ট্রেন আসে। তা-ও রাতে। অপুর ট্রেনটা এসে পৌঁছালো রাত সাড়ে দশটায়। বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। শীতের রাত। অপুর জামার উপরে কেবল একটা হাফ সোয়েটার। ট্রেনের বাইরে আসতেই হিমেল হাওয়ার ধাক্কাটা অনুভব করলো। হাড় কাঁপানো শীতে এ সোয়েটার যেন কিছুই না। মনে মনে ভাবল, বড় ভুল হয়ে গেলো। জ্যাকেটটা সাথে আনা উচিৎ ছিল। গ্রামের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলে তো জমে যাব। এখন আর কিছুই করার নেই। অপু ট্রেন থেকে নামলো। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে চারিদিকে একবার চোখ বোলালো কিন্তু তপুকে কোথাও দেখতে পেল না। ষ্টেশনের বাইরে আসতেই চোখে পড়ল রাস্তার একপাশে আধো অন্ধকারের মাঝে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তপু। চোখ দু’টো আর মুখটা দেখা যাচ্ছে শুধু। অপুকে দেখেই সেই সহজ সরল হাসি।
– তোর খুব কষ্ট হয়েছে দাদা?
– না-রে! মা এখন কেমন আছে?
– আছে কোন রকম।
– তোর ফোনে কি হয়েছে? আজ সারাদিন ট্রাই করে তোকে পেলাম না।
– তোকে তো বলা হয়নি, আমার ফোনটা পুকুরে পড়ে গেছে। তোর নম্বরটা কোথাও লেখা ছিল না, তাই তোর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।
দু’ভাই ষ্টেশন ছাড়িয়ে এগিয়ে চললো বাড়ির দিকে। ষ্টেশন থেকে দূর্গাপুর প্রায় চার মাইল পথ। পুরাটাই কাঁচা রাস্তা। পায়ে হাঁটা ছাড়া কোন গত্যান্তর নেই। ছোট্ট জংশনটা ছাড়িয়ে কিছু্দূর এগিয়ে কাঁচা রাস্তায় নামলো দু’জন। তখনই কুয়াশার দেয়ালটা চোখে পড়লো অপুর। একটা হিম শীতল ঠাণ্ডা বাতাস তার ভেতরে কাঁপন ধরিয়ে দিলো। ঠকঠক কর কেঁপে উঠলো।
– কী-রে দাদা, তুই তো শীতে কাঁপছিস!
– আমি কী জানতাম গ্রামে এত ঠাণ্ডা পড়েছে? ঢাকায় তো এখনও তেমন শীত পড়েনি।
– ভয় নাই। আমি তোর জন্য এক্সট্রা চাদর নিয়া আসছি।
তপু ওর গা থেকে একটা শাল অপুর দিকে বাড়িয়ে দিলো। অপু শালটা গায়ে জড়াতেই অদ্ভুত এক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়লো তার সারা শরীরে। একটুও শীত অনুভব করছে না আর। অপু কিছুটা অবাক হলো। এত দ্রুত ঠাণ্ডা কেটে গেল!
– দাদা, শীত কমেছে?
– হুম।
– আমি এতক্ষণ গায়ে জড়িয়ে ছিলাম তো, তাই চাদর গরম হয়ে ছিল।
সামনে কুয়াশা আরও গাঢ় হয়ে আসছে। তপু পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো ফেললো ফাঁকা রাস্তায়। তাতে সামান্যই আলোকিত হলো। সেই আলোতে অপু দেখলো বৃষ্টির মত হিম পড়ছে। শিশির ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে দু’জনে হাঁটছে। ভেজা ঘাস আর ধুলো-কাদায় একাকার হয়ে যাচ্ছে দু’জনের জুতো। পায়ে স্লিপার থাকায় তপুর পা কাদায় মাখামাখি। চারিদিকে নিকষ কালো আঁধার। এক ধরনের ভৌতিক স্তব্ধতা। এই নিস্তব্ধ রাত্রিতে ঝিঁঝিঁপোকা আর ব্যাঙের ডাক ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। জনমানবহীন প্রান্তরে এখন কেবল ওরা দু’ভাই, আর কারো অস্তিত্ব নেই।
– তুই এমন পাগলামি করলি কেন তপু?
– কি পাগলামি করলাম?
– আমার এখন বাড়ি আসা কী জরুরি ছিল?
– হ্যা ছিল। দাদা, তোর আর ঢাকা যাওয়ার দরকার নেই।
– তাহলে আমি কি করবো? তুই-আমি, দু’জনই বাড়ি থাকার দরকার কী?
– বাজারে এতবড় দোকান, প্রয়োজনের তিনগুণ ফসল বছরে জমি থেকে আসে, তিন-তিনটা বড় পুকুরে মাছের চাষ হচ্ছে। এতে তোর চলবে না?
– এগুলোর জন্য তো তুই আছিস। আমি চাকরি করলে কিছু বাড়তি আয়ের সংস্থান হয়।
– আমি তো আর পারছি না।
– তুই পারছিস না মানে!
তপু নিরুত্তর। অন্যদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে।
অপু আবার প্রশ্ন করে- তপু, হঠাৎ এমন কী হল তোর? এমনভাবে বলতেছিস যেন তুই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিস।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপু বললো- আমি কখনই তোর কিংবা মায়ের কোন কাজে আসতে পারলাম না। আর মা সবসময় আমার চেয়ে তোর উপরই বেশি নির্ভরশীল ছিল। তাই মার কাছে এখন তোর থাকাটা খুব দরকার।
– কী-রে! মা’র সাথে ঝগড়া হয়েছে?
– নাহ! মা’র সাথে ঝগড়া হবে কেন? এটা সময়ের বাস্তবতা।
– আমি বুঝতে পারছি না, তুই এমন হেঁয়ালি করছিস কেন?
– হেঁয়ালি না দাদা, আমি সিরিয়াসলি বলছি। তোর আর চাকরি করার দরকার নাই।
– এটা কোন কথা হল? কত মানুষ শহরে চাকরি করে! তাছাড়া আমাদের দু’ভাইয়ের একসঙ্গে বাড়ি থাকার দরকার কী?
– আমার কথা বাদ দে। মা তোর জন্য মেয়ে দেখছে।
– ওহ! এটাই তাহলে মূল কথা। এই জন্যই তোমাদের এত তোড়জোড়?
– তোড়জোড়ের কী আছে? মা’র বয়স হয়েছে। এখন তার সেবা দরকার।
– বুঝছি। তোর কথামত আমার বাড়ি আসা ঠিক হয়নি।
– তোর ভাবনাটা ঠিক না। এই মুহূর্তে তোর বাড়ি ফেরা ভীষণ জরুরি। মা বড় একা। আমি সত্যি বলছি দাদা, আজ তোকে মা’র বড় প্রয়োজন।
– আমি তোর কথার কোন মাথামুণ্ড বুঝতে পারছি না তপু। তুই যেন জোর করেই আমাকে বাড়িতে আসতে বাধ্য করছিস। এতদিন তো ভালই চলছিলো, এখন তুই এমন করছিস কেন?
তপু কোন উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। রাতের অন্ধকারে নির্জন রাস্তায় এই নিরবতা অসহ্য লাগে অপুর।
তপু প্রসঙ্গ পাল্টায়। এসব কথা বাদ দে দাদা, সামনে কালীবাড়ির জঙ্গল। তুই এই পথে একা আসতে পারতি? হাসতে হাসতেই বললো তপু।
– না রে। তুই এসে ভালই করেছিস।
দু’পাশে ঘন জঙ্গলের মাঝের রাস্তায় ঢুকে পড়লো ওরা। অন্ধকার- চারিদিকে একটা ভয়াল অন্ধকার। উত্তর দিক থেকে হিসহিস শব্দে ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছিলো হাড়গোড় কাঁপিয়ে দিয়ে। মাথার উপরে তুষার ঝরে, গাছের পাতার উপরেও টপটপ শিশির পড়ার আওয়াজ শোনা যায়। অপু যেন কিছুটা কুঁকড়ে যায়। শালটা আরও ভাল করে জড়িয়ে নেয় গায়। ফড়ফড় করে কি একটা উড়ে গেলো পাশের ঝোপের উপর দিয়ে।
– ওটা কী রে? তপুকে জিজ্ঞেস করলো অপু।
– গুইশাপ কিংবা বেজি হবে হয়তো। তোর ভয় করছে দাদা?
অপু কিছু বললো না। বাগানে বিচিত্র প্রাণির ডাকাডাকি, গাছের ডালের ঘর্ষণের শব্দ অদ্ভুত ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করেছে। অপুর গা ছমছম করে।
– দাদা, তোর ভয় লাগছে? আবার জিজ্ঞেস করে তপু।
– একলা হলে লাগতো। তুই সাথে থাকায় লাগছে না।
তপু হাসে। – আমি জানতাম, এ পথে রাতে একা আসতে পারবি না। তুই যা ভীতু!
– হুম। অপু ছোট্ট করে উত্তর দিলো।
– দাদা, তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস?
– তা তো কিছুটা করেছিই।
– রাগ করিস না, দাদা। আমি ভুল কিছু করিনি। কিছু কিছু সময় সত্যটা দেখা যায় না, পরে বোঝা যায়- কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক।
– হয়েছে, আর ফিলসফি আওড়াতে হবে না। আমার মেজাজ এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে।
তপু হাসে। – মেজাজ যতই খারাপ হোক, আমি জানি তুই আমার উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবি না।
অপু কপট রাগের ছলে বললো- আমি কালই চলে যাব।
– আচ্ছা যাস।


জঙ্গল কিছুটা হালকা হয়ে আসছিলো। দু’জনে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। হঠাৎ মৃদু কথাবার্তার শব্দ শুনে অপু সামনে তাকালো। তখনই চোখে পড়লো ওদের থেকে প্রায় একশো গজ সামনে দু’জন মানুষের অবয়ব, লোক দু’জন হঠাৎ জঙ্গলের বামদিকের সরু পথে নেমে পড়লো।
– এতরাতে এরা কারা? বাজারের দিক থেকেই তো আসলো মনে হয়। তপু, তুই চিনোস ওদের?
– মনে হয় জমির খাঁ আর কবির খাঁ।
– এতরাতে জঙ্গলের মধ্যে কোথায় গেলো ওরা?
– সোনা মিয়ার দিঘির পাড়েই তো ওদের বাড়ি। তোর মনে নেই দাদা, ঐ দিঘির পাড়ে কতদিন আমরা ঘুড়ি উড়াতে গেছি!
– হুম, মনে আছে। সে তো আট-নয় বছর আগের কথা।
তপু হেসে বলে- এমনিতে তুই সবকিছুতেই আমার থেকে এগিয়ে ছিলি কেবল অন্ধকারকেই তোর যত ভয়।
অপু কিছু বলল না। সে কেবল ভাবছিলো লোক দু’জন এতরাতে কোত্থেকে এলো। তপুর কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকালো।
– দাদা, মনে আছে একদিন সন্ধ্যাবেলা তুই একলা এই জঙ্গল পেরিয়ে বাড়ি যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলি?
অপু স্মিত হাসলো। – সেদিনের পর থেকে তুই আর আমাকে এই জঙ্গলের পথে একা আসতে দিস নি।
– ওটা শুধু আমার একার ইচ্ছায় ছিল না, মা-ই আমাকে বলেছিলো।
অপুর হঠাৎ ভীষণ খারাপ লাগে কিন্তু মুখে কিছু বলে না। তপু আর মা ছাড়া যে তার আর কেউ নেই। বাবা মারা গেছেন সেই দশ বছর আগে। তখন থেকেই দু’ভাই আর মা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়েই বেঁচে আছে। অপু অন্য প্রসঙ্গে যায়।
– মার ভালমত চেকআপ করানো দরকার। শিমুলপুরে ভাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কে আছে এখন?
– নতুন একজন আসছে শুনেছি, নাম জানি না।
– কালই একটা এপয়েন্টমেন্ট কর।
– আচ্ছা।
একসময় জঙ্গলটা শেষ হয়ে আসলো। আর কিছুটা পথ হাঁটতেই ছোট্ট বাজারটায় চলে আসলো ওরা। বাজারের পেছনেই ওদের বাড়ি। এখন মধ্যরাত্রি। কোন মানুষজন চোখে পড়ছে না; দোকানপাট বন্ধ করে ইতিমধ্যেই বাড়ি ফিরে গেছে সবাই। বাজারজুড়ে সুনসান নিরবতা। কুকুর দু’টো অলসভাবে শুয়ে আছে তপুর বন্ধ দোকানের সামনে। সারাদিন এ দু’টো বাজারেই ঘোরাঘুরি করে। তপু মাঝে মধ্যেই খাবার দেয় ওদের। ওরা দু’ভাই কাছাকাছি আসতেই ও দু’টো চিঁ-চিঁ উঠলো, যেন ভয় পেয়েছে। তারপর লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল দুই দোকানের মাঝের করিডোর ধরে। দু’জনে বাজার ছাড়িয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।
প্রায় তিন একর জায়গা জুড়ে বিশাল বাড়িটিতে মাত্র একঘর বাসিন্দা। অপুকে বাদ দিলে কেবল তিনটি প্রাণির বাস। মা, তপু আর কাজের ছেলে মনা। বাড়ির মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করে নারিকেল আর সুপারির সাজানো গোছানো বাগানটির এক পাশে পুকুর; শান বাঁধানো ঘাট। আর বাগানের মাঝখান দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পথ। পথের শেষ প্রান্তে ওদের বাংলাঘরটি দাঁড়িয়ে। এ ঘরে কেউ থাকে না। কেবল অতিথি সমাগম হলে এখানে বসার ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাঘরটি ছাড়িয়ে একটা লম্বা প্যাসেজ পার হয়ে উঠোনে আসতে হয়।
বাড়িতে ঢুকে পুকুর ঘাটের সোজাসুজি এসে তপু বললো,
– দাদা, তুই ভেতরে যা, আমি পা ধুয়ে আসছি।
– আচ্ছা, তাড়াতাড়ি আয়।
অপু নারিকেল বাগানের মাঝের পথ ধরে এগিয়ে যায়। বাংলাঘরের কাছাকাছি আসতেই বাড়ির ভেতর থেকে লোকজনের মৃদু কথাবার্তা ভেসে আসে। অপু মনে মনে ভাবলো, এত রাতে বাড়িতে কারা কথা বলছে। এখন তো মা আর মনা ছাড়া বাড়িতে আর কারো থাকার কথা না। বাংলাঘরের পাশ দিয়ে ভেতরের প্যাসেজে আসতেই হঠাৎ চোখে পড়লো বড়মামা আর মামাতো ভাই হাসান দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে ছুটে আসলো হাসান। হাসানের পেছনে বড়মামাও এগিয়ে আসলেন।
– অপু ভাই, তুমি কখন খবর পাইলা?
– কীসের খবর?
– কেন তুমি কিছু জান না?
– না! কি জানবো? আমাকে তো তপু ফোন করে একরকম জোর করে আসতে বাধ্য করলো। বললো, মা অসুস্থ। রাতে ষ্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো আমাকে এগিয়ে আনার জন্য। মা কেমন আছে রে হাসান?
– ভাল। তপু তোমাকে ষ্টেশন থেকে নিয়ে এসেছে? কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল হাসান।
– হ্যা। কালিবাড়ির জঙ্গলের পথ ধরে আসতে ভয় পাবো বলে ও ষ্টেশন থেকে আমাকে এগিয়ে নিয়ে এলো। এখন পুকুর ঘাটে পা ধুচ্ছে।
বড়মামা আর হাসান পরস্পরের দিকে তাকালো।
– তপু কখন ফোন করেছে তোকে? বড়মামা জিজ্ঞেস করলেন।
– গতকাল রাতে। রাত একটার দিকে।
– কাল রাত একটায়! হাসান বিড়বিড় করে বললো।
– কেন, কি হয়েছে?
– চলো, ঘরে চলো। হাসান অপুকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে এগিয়ে চলল।
অপু উঠোনে প্রবেশ করতেই দেখলো আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন জড়ো হয়েছে সেখানে। ওকে দেখে এগিয়ে আসলো কয়েকজন। হাসান ইশারায় কি যেন বললো তাদের। ঘরের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।
– হাসান, কি হয়েছে রে? অপু অস্থির হয়ে উঠলো।
হাসান কিছু বললো না। অপুকে নিয়ে ওদের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। অপু বারান্দায় পা রাখতেই আগরবাতির তীব্র গন্ধটা নাকে এসে লাগল। বারান্দা পেরিয়ে মূলঘরে ঢুকেই নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘরের মধ্যখানে শোয়ানো তপুর নিথর দেহ, পাশে নির্বাক পাথরের মত বসে আছে মা।
– গতকাল সকালে তোমাদের পুকুর পাড়ের বড় আমগাছটা থেকে পড়ে গিয়েছিলো। মাথায় আঘাত লাগে। কাল সকালেই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর জ্ঞান ফেরেনি, আজ সন্ধ্যায় সব শেষ। পাশে দাঁড়ানো হাসান বলল।

অপুর কোনদিকে খেয়াল নেই। ভাইয়ের নিষ্প্রাণ মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু। বহুদূর থেকে কানে ভেসে আসছে তপুর কণ্ঠস্বর-
“এই মুহূর্তে তোর বাড়ি ফেরা ভীষণ জরুরি। মা বড় একা। আমি সত্যি বলছি দাদা, আজ তোকে মা’র বড় প্রয়োজন।’

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা 

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments