
দিনটি ছিলো শুক্রবার। ভাষার মাস এবং পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের প্রথম দিন। ভালবাসা দিবস।
একুশের বই মেলায় ঘুরে বেড়ানোর এরচেয়ে আনন্দময় দিন আর কোনটি! ফাগুনের সাজে পরিবারের সবাই মিলে একসাথে বের হলাম বই মেলার উদ্দেশে। সাথে আমার নাতি ছোট্ট সোনা আইমান যার বয়স দুই বছর দশ মাস। জীবনের প্রথম বই মেলা দর্শন তার,ভাবখানা তার বড় মানুষের মত,প্রশ্ন করে আমরা বুই মেলায় যাচ্ছি? আগারগাঁও থেকে জ্যামে আটকে গেলাম আমরা! বসন্ত বরণের পোষাকে রমণীদের হলুদ শাড়ী,লালশাড়ী, আর ফুলের সাজে ঢাকা শহরটা অপরুপ সৌন্দর্যে সজ্জিত ছিলো সেদিন। শেষ বিকেলের লালচে রোদও এসে পড়েছিলো সেই ফুলের বিছানায়। মানুষের স্রোতে যেন পুরো বই মেলা ভাসছে! সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত যখন এগোচ্ছে ভিড়ের বহরটা তখন হালকা হতে শুরু করলো।
ঘুরে বেড়াচ্ছি আর বইয়ের স্টলগুলো দেখছি। আগে থেকেই মনস্থির করেছিলাম নোমান শামীম ভাইয়ের ‘সাদা শাড়ীর পাড় জুড়ে নূপুরের শব্দ’ বইটি আগে কিনব! কবি নোমান শামীম সিডনি প্রবাসী। আমার দুই ভাইও সিডনি থাকেন। নানা অনুষ্ঠানে, আড্ডায় তাঁর সাথে আমার দুই ভাইকে দেখি। আগ্রহটা সেইজন্য আগেই তৈরি ছিলো। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম সেই বইয়ের প্রকাশনী ৩৩ নাম্বার অন্বেষা প্যাভিলিয়ন! নোমান শামীমের বিশাল একটি ছবি ঝুলছে সেই প্যাভিলিয়নে। সুতরাং বই খুঁজে পেতে সমস্যা হলোনা। নোমান শামীম সম্পাদিত আরেকটি বই ‘প্রশান্ত পাড়ের কবি ও কবিতা’ বইটিও সংগ্রহ করলাম।
কয়েকদিন হলো বেশ অসুস্থ আমি! শুয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ নেই! ডাক্তারের কড়া নির্দেশ বিশ্রাম নিতে হবে। সে অর্থে সংসার কর্ম থেকে পুরোপুরি ছুটি বললেই চলে। বই পড়া শুরু করলাম। প্রথমেই হাতে নিলাম নোমান শামীমের ‘সাদা শাড়ীর পাড় জুড়ে নূপুরের শব্দ’। কবির প্রত্যেকটা কবিতায় প্রতিটা শব্দে এক অন্তর্নিহিত অর্থ লুকিয়ে আছে। অথচ কতো হাল্কা চালে এগিয়েছেন কবি। যেনো পৃথিবীতে কোন সমস্যা নেই, কোন মহামারী নেই, দাঙা ফ্যাসাদ নেই, করোনা ভাইরাসের কোন প্রকোপ নেই। এ যেনো নিমিষে চুপচাপ কবিতায় ফেরা। সকল কর্মকান্ড বন্ধ, আজ শুধু কবিতার দিন।
যেমন ধরুন এই কবিতাটি..
মানুষ এত সুখী কেন
তুমি তো বেশ আছো কিছুটা ভারী হয়েছো
তাও এ বয়সে মানায়,
তবু তোমার চঞ্চলতা কমেনি,
মাথার সেই ঝুটি এখন ঘন খোঁপা,
বারবার এদিক সেদিক ছুটে বেড়ানোর ইচ্ছে তার,
ছেলেটিকে কি বললে,সে বাধ্য স্বামীর মতো
কোথায় যেন ছুটে গেলো।
অনেক কাল যেনো ভালোবাসার কবিতা পড়া হয়না। সেই কবে দ্রোহের কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও’। কবিরা চিরকাল নারীদের কাছে আসতে চেয়েছেন যেনো। এমনকি নারী কবিরাও নারীদের কাছে এসেছেন অনেক বেশি। নোমান শামীম বললেন…
ফুল রাঙা শাড়ীর লাল পাড়ের চুমুগুলো
আমি অপলক চড়ুই পাখি
তোমার নাভীর গভীরে একে দিই
এক হাজার একটি ভালোবাসার
গভীর ক্ষত
নারী তুমি অমর হও।
আবার নোমান শামীমের বেনী ভেজাবার কালে কবিতায় আরেক রকমের চাওয়া; সেই নারীর কাছেই।
বেনী ভিজিয়ো না মেয়ে
পথে পড়ে থাকে যে চোখের জল,
সে জলে ঘাস ফড়িং উড়ে বেড়ায়
বেনী ভিজিয়োনা তুমি
সেই জলে।
কবি নোমান কি রাজনীতি করেন। রাজনীতি করতেন আমাদের অকাল প্রয়াত কবি মাহবুবুল হক শাকিল। তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে তাঁর সকল কবিতা পড়া হয়ে গেছে আমার। সেখানে শাকিল তাঁর প্রেমিকা এলা’দের জন্য যেমন আঁকুতি রেখে গেছেন, যে পাওয়া না পাওয়ার কাব্য রেখে গেছেন, সেখানে রাজনীতিও এসেছে ঠিক অরাজনীতির মতো স্বার্থহীন, কেবলই মানুষের ভালোবাসার রাজনীতি। নোমান শামীম কি সেরকমই একটি কবিতা লিখলেন তাঁর ‘ভালোবাসি ফিরে আসা’ কবিতায়…
এইসব রাজনীতির শেষে
তোমার কাছেই ফিরে আসি-
যদি ভালোবাসো
অকাতর আশ্রয় দাও যদি।
বইয়ের টাইটেল কবিতা ‘সাদা শাড়ির পাড় জুড়ে’ কবিতাটা না পড়লে বা মূল্যায়ন না করলে এই লেখাটি অসমাপ্ত থাকতে পারে। কবি নিশ্চয়ই এটিকে প্রধান মনে করে শিরোনামে স্থান দিয়েছেন। এখানেও সেই অমোঘ ভালোবাসা আর নারীর কাছে ফেরার গল্প। একটা কথা না বললেই নয়, শিরোনামে নামটা দেখে মনে হয়েছিলো কবির কল্পনায় যিনি এসেছেন তিনি সাদা শাড়ি পড়েন। তার অর্থ হতে পারে তিনি বিধবা নারী। সেই ভুল হয়তো তিনি শিরোনামেই ভেঙে দিলেন তার নূপুরের শব্দ দিয়ে। কিংবা সাদা শাড়ি পড়েও নূপুরের ঝংকার তোলা যায়। আসুন কবিতাটিই কিছু অংশ পড়ি…
তবু খুন করা ভোরগুলোয় তোমাকে মনে পড়ে
বুকের ভিতরে স্পন্দন থেমে যায়
ঘুম ভাঙা চোখে বারান্দার পাটাতনে খুঁজি
নূপুরের শব্দ, সাদা শাড়ির পাড় জুড়ে
পরিপাটি ভালোবাসা আমার
তুমি রবে নীরবে।
অসম্ভব ভালো লাগা এবং ভালোবাসার বুনটে ঠাঁসা নোমান শামীমের ‘সাদা শাড়ির পাড় জুড়ে নূপুরের শব্দ’ বইখানি। একবার সময় করে বইটি ধরলে শেষ না করে রাখতে পারবেন না। বইটি বের করেছে অন্বেষা প্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী চারু পিন্টু। কবিতার সারল্যের সাথে মিল রেখে তিনি খুব সাদামাটা প্রচ্ছদ করেছেন। কবিতা যারা ভালোবাসেন তাদের জন্য এটি অবশ্য পাঠ্য বই। অশেষ শুভ কামনা কবি আল নোমান শামীমের গ্রন্থটির জন্য।
নাজমুন নাহার লিপি
কবি ও লেখক।
ঢাকা, বাংলাদেশ।