
মেলবোর্ন শহরে আমি এসেছি দু বছরের কিছু সময় বেশী। সঙ্গীত প্রিয় মানুষ আমি। যে বা যারা আমার জীবনের সব রকম খারাপ সময়কে অতিক্রম করে জীবনে ধরে রাখে, তাঁদের মাঝে আমি সবচেয়ে বেশী ঋণী হয়ে আছি এমন কিছু ক্লাসিক্যাল শিল্পীর কাছে।খুব শোনা হয় এমন একজন ‘’কৌশিকী চক্রবর্তীকে’’ শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল, গেল বছর ১৪ এপ্রিল এই একই আয়োজকদের জন্যে। ভালো লেগেছিলো এবং তার অল্প কিছু দিন পরই জানা গিয়েছিলো রাশিদ খানের এই কনসার্টটির কথা। লম্বা একটা সময় ধরেই এই আয়োজক এ প্রোগ্রামকে নিয়ে কাজ করেছেন। রাশিদ খানের এই প্রোগ্রামের টিকেট কেটেছি গত বছরেই ।
আসলে মেলবোর্নে আসার পর খুব চেষ্টা করছি প্রিয় প্রিয় কোন শিল্পীকে এই শহরে পেলে মিস না করতে কিছুতেই।

প্রোগ্রাম বিকেল ৫.৩০। আমরীনের বাসা থেকে মাত্র ১২ মিনিট দূরত্ব। ঘড়িতে ৫ টা বাজতে না বাজতেই বের হবো বলে পুরোপুরি রেডি হয়ে যাই। আগামী ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ কাজে থাকবো। ঐ দিন কোন উদযাপন হয়ে উঠবেনা। তাই তার আগে এই ৬ তারিখেই নিজের বৈশাখী উদযাপনের এক ঝলক সাজ নিয়েই হই হাজির।

সাথে থাকা আমরীন আমাকে ভ্যেনুতে ঢুঁকিয়ে দিয়ে বলে আপনি একাই দেখতে থাকেন, আমি নভঃকে (ওর বাসায় থাকা আমার পুত্র) নিয়ে প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার আগেই বাকি দুই টিকেট নিয়ে চলে আসবো নে।
ঘড়িতে কাটায় কাটায় ৫.৩০টা। ভেন্যুতে আসনে বসে গেছেন প্রায় ৮০% দর্শক। বাকি যে বা যারা ঢুঁকছেন, শুধু তাঁদের সম্মানেই বোধ হয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক মঞ্চে উঠে আসেন মাত্র ১০ মিনিট পর, ৫.৪০ এই শুরু করেন ঘোষণা। হিন্দিতেই বলেন। হিন্দি গান শুনি, সুরে বুঁদ হয়ে থাকি, কিন্তু আমি বুঝতে পারি খুবই কম। তারপরও এটা বুঝতে পারি, দর্শকদের উজ্জীবিত করার কাজটা আন্তরিকভাবেই করার চেষ্টা করছেন। চেষ্টা করছেন অল্প বিস্তর হিউমার নিয়ে আসতে তাঁর বাচন ভঙ্গীতে।
খুব লম্বা সময় উপস্থাপক নেননি, তার আগেই মঞ্চে একে একে ডেকে নেন।
Vocal Support-Nagesh Adgaonkar ও Armaan Khan কে।
Tabla- Pandit Vijay Ghate
Harmonium- Pandit Ajay Joglekar
Sarangi- Ustad Murad Ali Khan
এবং
Vocal- Ustad Rashid Khan কে।
বিগত সময়ে দেখা বেশীর ভাগ অনুষ্ঠানে যা হয়, শিল্পী মঞ্চে উঠে নিজের মত করে কিছু না কিছু বলেন। এই প্রথম দেখলাম, একজন আপাদ মস্তক গানের মানুষকে। মাথা নুইয়ে দর্শকদের অভিবাদন জানিয়েই বললেন ‘’ইজাজত’ পেলে, শুরু করতে চান, আমি ভুল না করলে এর অর্থ বোধ হয় অনুমতি?

রাগাশ্রয়ী শিল্পী… রাগ দিয়েই শুরু। আমি সঙ্গীত প্রিয় মানুষ হলেও সব রাগের নাম আমার জানা নেই, তারপরও যদি ভুল না করি, রাগ মারওয়া, মধুরঞ্জিনী(Raag Marwa, Madhuranjini) এমন কিছু ধারা নিয়েই চলে লম্বা সময় ধরে সুরের খেলা, সাথে ছোট্ট করে সাপোর্ট দিয়ে যায় তাঁরই দুই যোগ্য শীস্য। ‘পিয়াকে’ নিয়ে এমন আলাপ সুর সপ্ত সুর পার হয়ে যেতে থাকে, যেতেই থাকে… অল্প একটু সময় ওভাবে ক্লাসিক্যাল লাভার না হলে একটু ধৈর্যচুত্যি ঘটলে ঘটতেও পারে কারো কারো। লাগতে পারে এক ঘেয়েমী। আমি মাঝে মাঝেই চোখ বুজে অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম সুরের সেই যাদু। না আমার একবারও মনে হয়নি, এই আলাপ এক্ষুনি শেষ হোক, মনে হয়েছে চলুক, চলতেই থাকুক।
রাশিদ খানের কন্ঠ থেকে যে সুরেলা ধ্বনি বের হয়, প্রতিটি নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে যে সুরের খেলা তা উপভোগ না করার কোন কারণই নেই। তার সাথে দর্শকদের মুন্ত্রমুগ্ধ নীরবতা। উপমহাদেশের এমন সেরা হারমোনিয়াম, তবলা এবং সারোঞ্জি শিল্পীর কাজ। মঞ্চের পিছনের বিশাল পর্দায় প্রাসঙ্গিক দৃশ্যপট। আহ, সেই সুর শুনতেই মন কেমন করে উঠে, বুকের মাঝে হু হু ঢেউ, মনে হতে থাকে সুরের এই পৃথিবী কী ভীষণ রহস্যে ঘেরা। যারা সুর ভালোবাসেন শুধু তাঁরাই বুঝবেন, সুরের মূর্ছনা মনকে কী ভীষণভাবে আচ্ছন্ন করতে পারে… আমার দুই পাশে কেউ না থাকায় বলাই বাহুল্য খুব খুব বেশী প্রিয় এক দুইজন বন্ধুকেই মিস করছিলাম যেন।
রাশিদ কানের গলায় এমন দরদ, মায়া, উঠানামা… মনের ভিতরটা নিজের অজান্তেই ভাঙ্গতে থাকে, ভিজতে থাকে। মনে হয় প্রিয় কারো হাত ধরে কাঁদি। মনে হতে থাকে, এই সুর নিয়ে কাজ করা মানুষগুলো কী ভীষণ ব্লেসড। আমি গাইতে পারিনা, এই আফসোসটা আমাকে ভীষণ পোড়ায় মাঝে মাঝেই। বিশেষ করে এমন সুরের মানুষদের শুনলেই আমার ভালো লাগায় চোখে পানি চলে আসার উপক্রম হয়।
ঘন্টাখানিক ধরে এমন কিছু রাগই শুনি আমরা। কানে বাজতে থাকে দুইটা শব্দ খুব বেশী ‘’পিয়া’’ ‘’পরদেশী’’। এই রাগের মাঝেই সুরে সুরে চলে হারমোনিয়াম, সারোঞ্জি এবং তবলার অপরূপ কাজ। দর্শক, রাশিদ খানের কন্ঠ মায়া, সুরের যাদুর পাশাপাশি যন্ত্রেও হয় মুগ্ধ। যদিও সেই যন্ত্রের পিছনে থাকা মানুষগুলোই একেকটা বিস্ময়।
২০ মিনিটের ইন্টারভেলে বের হয়ে আসি, তখনই আসে আমার কাছে আমরীন ও আমার পুত্র নভঃ। একটু চা কফি পপকর্ন খাবো বলে, ক্যাফের দিকে তাকিয়ে দেখি এলাহী কারবার। প্রায় ৩০০/৪০০ মানুষের কিউতে না দাঁড়িয়ে আমরা আর দুই একজন বাংলাদেশী ভাইসহ পরিচতি কজনের সাথেই করি কুশল বিনিময়। ১০/১৫ মিনিট পার হতেই কিউ অনেকটাই ছোট হয়ে আসে। এবার আমরা আইসক্রিম, চিপস, বাদাম কিনে খেতে না খেতেই এনাউন্সমেন্ট আসনে একটু সময় আগে ভাগে ফিরে গেলেই আয়োজকরা ধন্য হবেন। আমি আমার অর্ধেক খাওয়া আইসক্রিম ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে ঢুঁকে যাই আমার আসনে । আমরীন নভঃকে নিয়ে আইসক্রিম চিপস শেষ করে একটু পরই আসে।
ইন্টারভেল সময় শেষ হতেই এবার উপস্থাপকের আহ্বানে মঞ্চে উঠে আসেন মূল আয়োজক মিঃ মানগিরিশ।এই ভদ্রলোক আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক। একটা মানুষ যতোটা বিনয়ী হতে পারে, তার সবটুকু তিনি।থ্যাংকস গিভিংটুকু এতো সুন্দর করে করেন, দর্শকদেরবিরামহীন হাততালি অভিবাদনেই বুঝা যায় সে কতোটা
ওয়েলকামড।পরিষ্কার ইংরেজীতে বলেন বলেই বুঝতে পারি তাঁর কথা এবং সে ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে জানান আজ এই অডিটরিয়ামে বসে আছেন আপনারা ৭৪০ জনের মত দর্শক।দর্শক নিজেদের জন্যেই দিয়ে যান উচ্ছসিতহাত তালি।
একদমই লম্বা করেননা তাঁর বক্তব্য। ছোট্ট করেই জানান তাঁদের আগামী ইভেন্টটি হতে যাচ্ছে, প্রোথিতযশাঃ কোন শিল্পীকে নিয়ে নয়। বরঞ্চ নুতন মুখ, ভালোবেসে সুরের সাথে আছে গান করছে এবং যাঁদের মাধ্যমে উঠে আসবে আগামী দিনের ইন্ডিয়ান মিউজিক এমন কাউকে নিয়েই তাঁরা করবেন আয়োজন, চাইলেন আগাম সহযোগিতা।
রাশিদ খান সুরেই ডুবে থাকা একজন মানুষ। বাড়তি কোন কথাতেই তিনি নেই। আবার মঞ্চে উঠে আসেন। দর্শকদের মাঝে দুই একজন ক্ষীণ স্বরে বলার চেষ্টা করেন তার অসম্ভব জনপ্রিয় সেই যাব উই মিট সিনেমার গানটির কথা… ‘’আউগে যাব তুম’’! তিনি এবার কন্ঠে তুলে নেন, ইয়াদ কী পিয়া। অনেকগুলো ভার্সন শ্রুত তারপরও তাঁর সুর নিয়ে হারমোনিয়াম তবলা আর সারোঞ্জির সাথের খেলা দারুণ উপভোগ করেন দর্শক।
এবং ফাইনালি… সেই কাঙ্ক্ষিত সুর… আহা কী যে মায়া, কী যে মায়া… ‘’আউগে যাব তুম’’ শুনেছেন আর প্রিয় হয়ে উঠেনি এমন সঙ্গীত প্রিয় মানুষ খুব কমই হবে। আমি উড়ে গেলাম যেন আরো একবার যেন, নিয়ে ঘোর, হলাম বিভোর! এই গান দিয়েই হয় অনুষ্ঠান শেষ। একটু আফসোস থেকেই যায়… বুঝতে পারিনা।
আয়োজকরা আবারো ধন্যবাদ দেন এবং সবাইকে অনুরোধ করেন যারা শিল্পীর সাথে দেখা করতে চান, বাইরে লাইনে যেয়ে অপেক্ষার লাইনে দাড়াতে।আমি এইসব ব্যাপারে যখন তখন গুটিয়ে যাওয়া মানুষ। অল্প বিস্তর তিক্ত অভিজ্ঞতা। সাহস পাইনা। আমরীন বলে আপনি চাইলে আমি আপনার পাশে থাকবো আজ আপু, চলেন যাই লাইনে, কী আছে জীবনে। এমন একজন শিল্পীর জন্যে অপেক্ষা করাই যায়।
আমার মন কোণে জমে আছে একটু মেঘ… আজি ঝড়ের রাত না, তারপরও মনে হলো, আহা একটা বাংলা গান যদি শুনতে পারতাম এই মঞ্চে। সুযোগ ছিলোনা সে আব্দারের। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কথারা হয় এলোমেলো, তারপরও আমি বলি ‘’আমি বাংলাদেশের মেয়ে’’… আপনার ভক্ত, এইটুকু ইংরেজীতে বলেই হুট করে বলে ফেলি ‘’মেঘ জমে আছে মন কোণে’’। উনি একটু হাসি হাসি করেন বলেন আমি বাংলা বলতে পারি।
না এতো লম্বা কিউ আর কথা আগানোর সুযোগ নেই। দুইটা ছবি আমরীনই উঠিয়ে দেয়, এবং আমরীন আর আমার সাথের একটা আমার পুত্র নভঃ। অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, ছেড়ে দেই জায়গা…। শিল্পীর জন্যে মনে মনে সবটুকু শুভাশিস যাই রেখে। গাড়ীর দিকে আসতে আসতে দেখি, তৃপ্ত সব দর্শকের মুখ… একটু আফসোস হয়, আচ্ছা উনার সাথের পারফর্মারদের যেয়ে কেন একটু থ্যাংকস বলে আসলামনা। অভিবাদন জানালাম না, ধুর কেন এমন করলাম!
আয়োজকদের গোটা আয়োজনেই ছিল একটা টানটান ব্যাপার, পরিচ্ছন্নতা এবং সময় সচেতনতা। তাঁদের ধন্যবাদ।রাশিদ খানের মঞ্চ উপস্থিতি, তাঁর এক্সপ্রেশন এবং বাস্তবে দেখে মনে হয়েছে গানেরই সাধক এই মানুষ। তাঁর জন্যে ভালোবাসা, সুস্থ থাকুক সুন্দর থাকুক তাঁর সঙ্গীতের সাথে থাকা একটা জীবন।
নাদিরা সুলতানা নদী
কলামিস্ট, সংস্কৃতি কর্মী
উপস্থাপক, বাংলা রেডিও
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা
মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়া।