“ ও শক্ত কইরা জড়াইয়া ধরল আমারে। আমি দুই হাতে ওর মুখটা উঠাইয়া দেখি, ওর চোখে পানি টলমল করতেছে। আমি বললাম, তোমারে কিছু দেই নাই আমি। তবু মনে রেখো”।
একেবারে বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠা কথামালা। অনেকেরই মনে পড়ে যাবে কৌশোরের শেষ বিকেলের কিংবা যৌবনের প্রথম প্রহরের কোন স্মৃতি। তবে এই অনুভূতি উপন্যাসটির মূল প্রতিপাদ্য নয়, অনুষঙ্গ মাত্র; নায়িকার মানসপটে উঁকি দেয়া হাজারো আকুতির একটি। এই উপন্যাসকে যদি একটিমাত্র শব্দ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করতে হয় তবে সেই শব্দটি ‘আকুতি’। একজন মানসিক রোগীর স্বায়ত্ব সত্ত্বা (autonomy) সন্ধানের আকুতি। “তোমরা তো কিছু ডিসকাস করতে আমারে ডাকো নাই। তোমাদের মাইন্ডস আর অলরেডি মেইড আপ”। এখানে নায়িকা নিজের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলেন। তার নিজের জীবনের উপর নিজের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। সে জীবন নিয়ন্ত্রন করে অন্যরা, হোক তারা পরিবারের সদস্য, পরম শুভার্থী। নায়িকার কোন স্বায়ত্ব সত্ত্বা নেই।
আমি নিজের পেশাগত অভিজ্ঞতায় সানিয়া রুশদীর প্রথম উপন্যাস ‘হসপিটাল’ এর সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারি। আমার ফ্যামিলি মেডিসিন মাষ্টার্সের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল – দক্ষিন আফ্রিকার একটি গ্রামীন জনপদে মানসিক রোগীদের নিয়মিত ঔষধ সেবনে অনীহার কারণ সমূহ। ‘হসপিটাল’ পড়তে গিয়ে মনে হলো সেই গবেষণার উপাত্তগুলো উপন্যাসের আলোকে যেন নতুনভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। আজ থেকে ২০ – ২২ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রামীণ জনপদে যে মানসচিত্র দেখেছি তারই প্রতিফলন দেখলাম আজকের মেলবোর্ণের একজন প্রবাসী বাঙালি তরুণীর জীবন অভিজ্ঞতায়। একজন মানসিক রোগীর স্বায়ত্ব সত্ত্বার সন্ধানের আকুতি যে চিরন্তন সে সত্যটি নতুনভাবে উপলব্ধিতে এলো। আমরা যারা এমন একজন মানসিক রোগীর চারপাশে থাকি সেই রোগীর মানোবিশ্লেষনে আমরা যে কতোটাই অজ্ঞ কিংবা অনভিজ্ঞ তা এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে চমৎকার ভাবে।
“এইটা লিথিয়াম করে নাই। আমার মুড স্টেবলই ছিল। আমি রাগ হইছিলাম, আমার কাছে অন্যায় মনে হইছিল আমারে ওষুধ নিতে বাধ্য করাটা, আর সেইটারেই আমার আনস্টেবল মুড ধইরা নেওয়া হইছে। আমি এখন আর রাগ করি না কারণ আমি নিজেরে অনেক বুঝাইছি যে প্রেসক্রাইবড ড্রাগস না নিতে চাইলে আমার অন্য আরো অনেক ড্রাগস দেওয়া হবে। সেই কারণে আমি সিদ্ধান্ত নিছি যে লিথিয়াম বিষ হইলেও সেইটারে খাইতে থাকব। কারণ নয়ত অন্য আরো অনেক বিষ দিয়া আমারে আরো তাড়াতাড়ি মারা হবে”। আমরা যারা মানসিক রোগীদের খুব সহজেই একটা লেবেল দিয়ে দেই, কিংবা ওষুধের মধ্যে সব সমাধান খুঁজতে চাই তাদের জন্য নায়িকার এই উপলব্ধি ভাবনার খোরাক যোগাবে।

একবার কান্নার পটভূমি বিশ্লেষন করতে গিয়ে নায়িকা জানালো, “আমার বোন যে আমারে সিম্প্যাথি দেখাইল, সেই জন্যে আমার কান্না পাইছে। সিম্প্যাথিতে আমার কান্না পায়।“ এই কথাটি আমাদের মানসিক রোগীর প্রতি এমনকি অন্য যে কোন মানুষের প্রতি আমাদের সিম্প্যাথি প্রদর্শন নিয়ে ভাবতে শেখাবে। সিম্প্যাথি আর এম্প্যাথির ভিন্নতা অনুসন্ধানে উৎসাহ যোগাবে। তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে হয়তো ‘এম্প্যাথি’ ধারণাটির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটবে, কারণ আমাদের সমাজে সিম্প্যাথি দৃশ্যমান হলেও এম্প্যাথির যথাযথ প্রয়োগ নিত্যদিনের ব্যাপার নয়।
“কিন্তু তোমারে কনভিন্সড শোনাইতেছে না যে? তুমি কি মনে করো না যে তোমার ফ্যামিলি তোমারে ভালোবাসে?”
“বাসে হয়ত, কিন্তু সেইটা তাদের মতো কইরা। আমার আমি’রে ভালোবাসে না”।
‘আমার আমি’কে ভালোবাসা আর ‘তাদের মতো করে’ ভালোবাসার মধ্যে যে যোজন যোজন দূরত্ব তা আমরা অতিক্রম করতে পারি না। কারণ, মানসিক রোগীর পায়ে ভর দিয়ে আমরা পৃথিবী দেখি না; উলটো আমাদের পায়ে ভর দিয়ে তাকে পৃথিবী দেখতে বাধ্য করতে চাই। এই দ্বন্দ্বই এমন রোগীর ‘সুস্থ’ হয়ে উঠার অন্যতম প্রধান অন্তরায়। এই দ্বন্দ্বটিই এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য।
এমন বিভিন্ন দ্বন্দ্ব, আকুতি, অনুসন্ধান আর আমাদের চিন্তার জগতকে আন্দোলিত করার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের গল্প এগিয়ে যায়। সানিয়া রুশদী তার উপন্যাসে একজন মানসিক রোগীর মনোজগতে আমাদের ভ্রমণ করান আর তার মাধ্যমে আমাদের ভাবনার সনাতন ভিতকে নাড়িয়ে দিয়ে যান। সে কারণেই ‘হসপিটাল’ একই সাথে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস আবার মনোবিজ্ঞানের পাঠ। উপন্যাসটি কেবল কথাসাহিত্যের মনোযোগী পাঠকই নয়, মনোবিজ্ঞান ও ফ্যামিলি মেডিসিনের ছাত্র এবং পেশাজীবী, এমনকি যাদের পরিবারে কোন মানসিক রোগী আছে তাদের সবারও আবশ্যিক পাঠ।
এখানে উদ্ধৃত অংশগুলো পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন উপন্যাসটি প্রমিত বাংলায় লেখা হয়নি, লেখা হয়েছে আমরা সচরাচর যে ভাবে কথা বলি সে ভাবে। এখানেই উপন্যাসটির ব্যতিক্রমতা এবং চমৎকারিত্ব। তাই বলে এটা মনে করি না যে অপ্রমিত বাংলায় লেখা উপন্যাস আমাদের কথাসাহিত্যের নতুন ধারা হওয়া উচিত। কিন্তু প্রমিত বাংলায় লেখা নিরানব্বইটি উপন্যাসের মধ্যে হঠাৎ অপ্রমিত বাংলায় লেখা একটি আমাদের স্বাদে ভিন্নতা নিয়ে আসবে। সানিয়া রুশদী আমাদের কথাসাহিত্য পাঠে নতুন আস্বাদন দিয়েছেন। পড়তে গিয়ে মনে হবে আমাদের নিজের মুখের কথা। পাঠক সহজের একাত্ম হতে পারবেন। লেখিকার এই পারদর্শীতা দৃষ্টি কাড়ার মতো। তবে অন্তত এক জায়গায় সাবধানী পাঠক ধাক্কা খেতে পারেন। এখানে উক্ত প্রথম উদ্ধৃতিটি আরেকবার দেখা যেতে পারে। “তবু মনে রেখ” না বলে “তবু মনে রাইখো” বললে ছন্দপতন মনে হতো না। তবে ধাক্কা লাগার মতো আর কোন ছন্দপতন দৃশ্যমান হয়নি।
একটি চমৎকার বিষয়বস্তু নিয়ে অসামান্য পারদর্শীতায় লেখা এমন একটি উপন্যাসে আরেকটি সীমাবদ্ধতা পাঠকের চোখে পড়তে পারে। অষ্ট্রেলিয়ার হাসপাতাল ব্যবস্থা সম্পর্কে যাদের সম্যক ধারনা নেই তাদের এখানকার মানসিক রোগীদের চিকিৎসার অনুষঙ্গ গুলো বুঝে উঠতে প্রথম দিকে একটু বেগ পেতে হতে পারে। তবে এই সীমাবদ্ধতার অপর পিঠে একটি শক্তিমত্তাও আছে। তা হচ্ছে, এখানকার হাসপাতাল ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পাঠককে আগ্রহী করে তোলা।
জৈব বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী সানিয়া রুশদী বাংলাদেশ ছেড়েছেন ১২ বছর বয়সে। সেই থেকে অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। অথচ বাংলা ভাষায় তার স্বাচ্ছন্দ্য দেশে বেড়ে উঠা এবং দেশে বসবাস করা কারো চেয়ে বিন্দুমাত্র কম বলে মনে হয়নি। রচনাশৈলির স্বাচ্ছন্দ্য আর ভাষার দখলে তাকে কোনভাবেই দেশে বেড়ে উঠা এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করা কোন লেখক থেকে আলাদা করার উপায় নেই। তার এই মুন্সীয়ানায় চমৎকৃত না হয়ে উপায় নেই। লেখা অব্যাহত রাখলে নিঃসন্দেহে তিনি অনেক দূরে যাবেন।
লেখিকার নিজের আঁকা প্রচ্ছদে ‘হসপিটাল’ প্রকাশ করেছেন ব্রাত্য রাইসু ‘বহিঃপ্রকাশ’ থেকে। মূল্য ৫০০ টাকা। উপন্যাসটির বহুল প্রচার কামনা করি। সেই সাথে কামনা করি সানিয়া রুশদীর নতুন লেখার অপক্ষাটি দীর্ঘ হবে না।
আহমেদ শরীফ শুভ
কবি, গল্পকার ও কলামিস্ট
চিকিৎসক, মেলবোর্ন।