সাম্প্রদায়িক সহিংসতা : হোক সর্বাধিক প্রতিবাদ ও বিচার । রণেশ মৈত্র

  
    

বাংলালাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশতম বছর বা সুবর্ণ জয়ন্তী চলছে। এই পঞ্চাশটি বছরের মধ্যে দু’চার বছর বাদ দিলে অপর প্রতিটি বছরেই এদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এই হামলা হয়েছে সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষদের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে। প্রত্যাঘাত কদাপি ঘটে নি। হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান এই তিনটি সম্প্রদায় মিলে যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাঁরা তো আক্রান্ত হচ্ছেনই-এ ছাড়াও আক্রান্ত হচ্ছেন এ দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ও-যাঁরা বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন-তাঁরাও জাতিগত পৃথক সত্তার হলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়িভূক্ত।

অতীতে যতগুলি ঘটনা ঘটেছে তার উল্লেখযোগ্য অংশ ঘটেছে মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডা আক্রমণ। তাতে অগ্নিসংযোগ, প্রতিমাভাংচুর, পুরোহিত হত্যা, গ্রাম ধরে শতাধিক বাড়ী প্রকাশ্য দিবালোকে জ্বালিয়ে দেওয়া, লুটপাট করা, নারী অপহরণ, নারী ধর্ষণ, জমি-জমা বাড়ীঘর দোকানপাট ও পৈত্রিক সম্পত্তি কৃষি ও অকৃষিজমি জবরদখল, দেশ থেকে সংখ্যালঘুদের হাজারে হাজারে বিতাড়ন প্রভৃতি। এত বেশী সংখ্যক সহিংসতা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানেও ঘটে নি। এটা ইতিহাস এবং ইতিহাসের সর্বাধিক করুন দিক।
এর কি কোন প্রতিবাদ হতো না? কী পাকিস্তান আমলে-কী বাংলাদেশ আমলে? প্রকৃত তথ্যের দিকে তাকালে অবশ্যই মানতে হবে পূর্ব পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে (ভূখন্ড একই) এ যাবত যত প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বাধিক কার্য্যকর প্রতিবাদ সংগঠিত হতো পাকিস্তান আমলেই। তখন ঢাকাসহ প্রদেশের অন্য কোথাও দাঙ্গা শুরুর খবর পাওয়া মাত্র ছুটে যেতেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু ও হাজার হাজার মুসলিম জনতা। ঢাকাতে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করতে গিয়ে মুখোমুখি দাঙ্গাকারীদের সাথে সংঘাতে দু’একজন বিশিষ্ট মুসলিম নাগরিক তাৎক্ষণিকভাবে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও সম্মিলিত প্রতিরোধের শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে কাপুরুষের মত পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছে। বিজয় ঘটেছে সাম্প্রদায়িকতা ও দাঙ্গা-বিরোধী জনগণের-যার সুফল পেয়েছেন সারা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
কিন্তু রাষ্ট্রটি (পাকিস্তান) যেহেতু সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল-তাই সংখ্যালঘুরা ১৯৪৬ ও তারও আগের দাঙ্গাগুলির করুণ অভিজ্ঞতার ফলে মাতৃভূমির প্রতি আস্থা হারিয়ে জলের দামে বাড়ীঘর বিক্রী করে দেশত্যাগ করতে থাকেন। সেই দেশত্যাগের ইতি আজও ঘটেনি। প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, যেখানে ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের পর ১৯৫১ তে অনুষ্ঠিত জনগণের প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিলো মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ হলেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সহ সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়সমূহ। প্রতি দশ বছর অন্তর অনুষ্ঠিত জনগণের দেখা যায়, প্রতিবারই সংখ্যালঘুদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে। এভাবে কমতে কমতে এখন এই সংখ্যা শতকরা ৭ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। শতকরা শূন্যতে আসতে তা হলে আর দেরী কত? যদিও বাংলাদেশ কখনোই পূরোপুরি হিন্দুশূন্য একটি রাষ্ট্রে নানা কারণে পরিণত হবে না-শতকরা দুই এক ভাগ “দেশ ছাড়বো না” ও “অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই” এ দুটি কারণে থেকে যাবেন তাবৎ অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা মাথায় নিয়ে।
পাকিস্তান আমলে কার্য্যকর প্রতিবাদে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি যদিও ছিল পার্টিটি বে-আইনী। মূলত: ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে তাঁরা কাজ করতেন।
তবে এ কথা ঠিক, পাকিস্তান আমলে অনুষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক সংঘাতগুলিকে নিয়ে সাজাও পায় নি। ওই দেশের কাছে সংখ্যালঘুদের তেমন প্রত্যাশাও ছিল না কারণ দেশটির উদ্ভবই ঘটেছিল সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের রাষ্ট্র হিসেবে।

দেশটি গঠনের আগে প্রতিশ্রুতি জাতীয়ভাবে দেওয়া হয়েছিল-বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্ব থাকবে না। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-আদিবাসী-যাঁরাই বাংলাদেশের নাগরিক তাঁদের সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করা হবে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে কারও প্রতি রাষ্ট্র কোন প্রকার বৈষম্য করবে না, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে-ন্যায় বিচার সকল নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করা হবে। অপরাধ করলে কেউই তা থেকে নিস্তার পাবেন না-দলমত নির্বিশেষে সকল অপরাধী আইনের হাতে ন্যস্ত হবেন।
কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে?
১৯৭২ এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাষায় জাতীয় ঐ অঙ্গীকার সমূহ লিপিবদ্ধ করলেন-ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে বাংলাদেশের চার মৌল রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে। সকল নাগরিকের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দিলেন ।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাঁচলেন না-তাঁকে বাঁচতে দেওয়া হলো না। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট রাতের অন্ধকারের সপরিবারে নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হলো। এই হত্যাকারীরা দেশী-বিদেশী মদদপুষ্ট। সকলের পরিচিত এবং আত্মস্বীকৃতও বটে।
সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট বদলে গেল। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি সমৃদ্ধ সংবিধানটি রাইফেলের খোঁচায় পাকিস্তানের সংবিধানের কাছাকাছি নিয়ে গেল রাষ্ট্রের বাংলাদেশ নামটির কোন পরিবর্তন না করে। খোন্দকার মুশতাক খুনীদের খাতে বিচার না হয় সেজন্যে আইন প্রণয়ন করলেন-যা ছিল সংবিধান-বিরোধী। সামরিক শাসক জিয়া সংবিধান সংশোধন করে জামায়াতে ইসলামী সহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলকে বৈধতা প্রদান করে ও বিসমিল্লাহ সংযোজন করেন। অপর সামরিক শাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ আর একটি সংশোধনী এনে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ঘোষণা করেন-ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবশত: নয়, ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে। সামরিক শাসকদের আনা রাজনৈতিক ঐ সংশোধনীগুলির বিরুদ্ধে সম্মিলিত আন্দোলন রাজপথে বহুদিন চালানোর পর ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া ও ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আসীন হলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণ-বিরোধী বে-আইনগুলি যেমন ছিল তেমনই থাকলো। অত:পর এলো তত্বাবধায়ক সরকার দুই নেত্রীকে পরিত্যাগ করার আর এক অযৌক্তিক তত্ত্ব নিয়ে।
যা হোক ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন ঐ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে আওয়ামী ীগ পুনরায় ফিরে এলো ক্ষমতায় এবং আজ পর্য্যন্ত তার পরবর্তী নির্বাচগুলিতেও একই দল নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন রয়েছেন। তাঁরা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেন-যুদ্ধাপরাধীদের বেশ কয়েকজনের বিচার করে রায় কার্য্যকর করতে ফাঁসিও দেন। কিন্তু বিসমিল্লাহ্ রয়েই গেল, জামায়াতে ইসলামী সহ ধর্মাশ্রয়ী দলগুলির বৈধতাও রয়ে গেল, ইসলাম ইসলামের জন্ম হলো সন্ত্রাসী দলের সংখ্যা বাড়লো।
অপরদিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ২০০১ থেকে আজ পর্য্যন্ত নির্বিবাদে ঘটে যেতেই থাকলো। কোন বিচার নেই-প্রতিবাদ যা করার তা সাধ্যমত কতিপয় সংখ্যালঘুদের প্রতিষ্ঠান ও বাপন্থী দলগুলি তাদের ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে করলেন।

রামুর বৌদ্ধ মন্দির ভাঙ্গার ঘটনা বেশী দিনের নয়। থাইল্যা- ও কতিপয় বৌদ্ধ অধ্যূষিত রাষ্ট্রের চাপে সে মন্দির পুন:নির্মিত হলো। বাদ-বাকী হাজার হাজার মন্দির বাড়ীঘরের অবস্থার কোন পরিবর্তন হলো না-বিচার তো নয়ই।
এবার অক্টোবরের ১৩ বা ১০ তারিখে কুমিল্লায় সহিংসতা ঘটার পর পরিকল্পিতভাবে সিরিজ হামলা চালানো হলো দেশ জুড়ে। কিন্তু কোন মন্ত্রী, এম.পি-এমন কি প্রধানমন্ত্রী ছুটে গেলেন না ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও তাৎক্ষণিক উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। আসামী ধরা হচ্ছে কিন্তু তারাই প্রকৃত আসামী কি না জানা যাচ্ছে না।
মনে পড়ে গেলো ইংরেজ আমলের কথা। তখনও দফায় দফায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়েছে সারা ভারত জুড়ে। মহাত্মা গান্ধীঐ দাঙ্গার বিরুদ্ধে অনির্ধিষ্টকালের জন্য অনশনে যেতেন। শুধু তাই নয়, তিনি ছুটে যেতেন ঘটনা স্থলে। মুহুর্তে দাঙ্গা বন্ধ হতো-মানুষের জীবন-সম্পত্তি রক্ষা হতো।
কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ও জামায়াত প্রকৃতির বৈধতার পর জামায়াতের বেশ একটা অংশ আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়লো-সহিংসতা বেড়ে গেল। অনেক ক্ষেত্রে ২/৪ জন আওয়ামী লীগারও ধরাও পড়লো।
অপরদিকে বাংলাদেশের মানুষ সারা দেশে দল-মত-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে নেমে পড়লেন রাজপথে। কিছু কিচু মামলাও দায়ের হেেছ কয়েক শত অপরাধী ধরাও পড়েছে।
জনতার এই চাপ অভ্যাহত থাকুক। দ্রুত বিচার হোক, সাক্ষীদের ভয়মুক্ত রাখা হোক-অপরাধীদের কঠোর শাস্তি হোক-এই প্রত্যাশা।

রণেশ মৈত্র
রাজনীতিবীদ, কলামিস্ট
একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।
বাংলাদেশ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments