“হৈ হৈ কান্ড রৈ রৈ ব্যাপার”
একসময় বাংলাদেশের শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জ শীতকালীন সময়ে এইঘোষণায় মুখরিত থাকতো। কোন নতুন সার্কাস বা যাত্রাদল পারফর্মকরতে আসলেই এলাকাগুলোতে যেন সাজ সাজ রব পড়ে যেতো। এলাকাগুলো যেন নব উদ্যোমে জেগে উঠতো। কখনও মাসব্যাপীআবার কখনও আরও দীর্ঘ সময় ধরে চলতো এই সার্কাস বাযাত্রাপালা। জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে এ ছিল এক চাঞ্চল্যকরআয়োজন বিশেষকরে সার্কাসের সব দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডগুলো মানুষপ্রাণভরে উপভোগ করতো। যারা ছোটবেলায় এটা দেখেছেনসারাজীবন তাদের স্মৃতিতে এটা থেকে যায়। গল্পের আড্ডায় স্থান পায়সার্কাসের গল্প। সার্কাস আসলে এক পরিপূর্ণ বিনোদনের কেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন এক্রোবেটিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও একসময় ছিল প্রাণীদেরদিয়ে মজার মজার কর্মকাণ্ড। এখন কোন প্রাণীকে কষ্ট না দেয়ারআইন হয়ে যাওয়ায় সার্কাসে প্রাণীদের দিয়ে আর তেমন কিছুই করাহয় না। তবু্ও এর আকর্ষণ একটুও কমেনি। আর বাড়তি অনুষঙ্গহিসেবে থাকে ভাঁড়দের ভাঁড়ামি যেটা যেকোনো বয়সী দর্শককে কিছুসময়ের জন্য দৈনন্দিন দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। আর থাকে তাকলাগিয়ে দেয়া বিভিন্ন ধরনের জাদুবিদ্যার প্রদর্শনী। সার্কাস বড় ছোটছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সবাই পারফর্ম করে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যঘটনা। এই যুদ্ধ অত্র অঞ্চলের ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ২৪ বছরের শাসন শোষনেরবিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল বাংলাদেশের মানুষ। নিজেদের অধিকারআদায়ের জন্য তারা পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সাথেলড়াই শুরু করেছিল শুধু বুকের সাহস আর দৃঢ় মনোবল সম্বল করে। নয়মাস এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জন করেছিল একনতুন দেশ – বাংলাদেশ। এই লড়াইয়ে সবাই তার নিজের সামর্থ্যেরবাইরে যেয়ে চেষ্টা করেছিল। দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষেরঅংশগ্রহণে যুদ্ধটা পরিণত হয়েছিল একটা গণযুদ্ধে। অবশেষে ত্রিশলক্ষ শহীদের রক্ত এবং তিন লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়েঅর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা।
মুক্তিযুদ্ধের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়েউল্লেখযোগ্য বিষয়। সবাই সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য মানসিকভাবে ছিলেনপ্রস্তুত। এই যুদ্ধে সার্কাসের দলগুলোও অংশগ্রহণ করেছিল। তারামুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করতো। তাদেরকেবিভিন্ন তথ্য দিয়েও সাহায্য করতো। এমন আরও বহু নজির আছেইতিহাসের পাতায় পাতায়। দি বেঙ্গল সার্কাস ঠিক এভাবেই মুক্তিযুদ্ধেজড়িয়ে যায় স্থানীয় রাজাকারদের রোষানলে পড়ে। স্থানীয়রাজাকারেরা বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিতে থাকে। কিন্তু যখন কোনকিছুতেই কাজ হয় না তখন তারা সার্কাসের মালিককে নির্মমভাবেহত্যা করে, পুড়িয়ে দেয় সার্কাসের প্যান্ডেল। এরপর পেরিয়ে যায় বহুবছর। এতসব অপকর্ম করেও একসময় মুক্তিযুদ্ধের এই বিরোধী চক্রবাংলাদেশে পুনর্বাসিত হয়। কিন্তু তাদের চরিত্র বদলায় না। পুনর্বাসিতহয়ে আবারও তারা তাদের আসল চেহারা ফিরে পায়।
অপরদিকে বেঙ্গল সার্কাসের উত্তরাধিকার হিসেবে বিউটি আবারওপ্রতিষ্ঠা করেন ‘বিউটি সার্কাস‘। খুঁজতে থাকেন নিজের শেকড়েরপরিচয়। প্রতিদিন তার ঘুম ভাঙে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। এভাবেইচিত্রায়িত হয়েছে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ছবি দি বিউটি সার্কাস। আমিকোন সিনেমা বোদ্ধা নয় তাই সিনেমার কারিগরি বিষয় নিয়ে কোনপ্রকার মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু আমার কাছে কাহিনীটা দুর্দান্তলেগেছে। আর প্রত্যেকের অভিনয়ও ভালো লেগেছে। ডায়লগগুলোওছিল সময়োপযোগী। সার্কাসের ভিতরের বিষয়গুলো এই প্রথমদেখলাম। তারা বিভিন্ন ধরনের কসরত করে মানুষকে আনন্দ দিলেওতারা আমাদেরই মতো রক্ত মাংসের মানুষ। তাদেরও কাজের শেষেটেলিভিশন সেটের সামনে বসতে হয়। তাদেরও দৈনন্দিন কাজকর্মকরতে হয় অন্য সবার মতো। আবার সবকিছু ভুলে মুখে রঙ মেখেহাজির হতে হয় সার্কাসের মঞ্চে।
চলচ্চিত্রটা মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই অপেক্ষায় ছিলাম কবে দেখতেপারবো।অস্ট্রেলিয়াতে বিউটি সার্কাস চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে এসেছে পথপ্রোডাকশন এবং দেশী ইভেন্টেস। তাই তারা যখন ফেসবুকে পোস্টকরলো এই খবরটা তখন আর দেরি করিনি টিকেট কাটতে। প্রসঙ্গতএখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন অস্ট্রেলিয়াতেও শীতকালীন অন্যান্যউৎসবের সাথে নিয়মিত আয়োজন করা হয়ে থাকে সার্কাসের৷ এমনইএকটা সার্কাস আমরা মানে আমি এবং আমাদের পুত্র ও কন্যাগতমাসে দেখতে গিয়েছিলাম সিডনির লিভারপুলে৷ উদ্দেশ্য ছিলনিজের শৈশবের স্মৃতিচারণ আর প্রবাসী প্রজন্মের মধ্যে সেটারবিস্তার। ‘স্টারডাস্ট‘ সার্কাসের সেই পরিবেশনা আমাদের মনপ্রাণ ছুঁয়েগেলো বিশেষকরে রায়ানের খুব পছন্দ হলো ভাঁড়দের ভাঁড়ামি। এরপরসে বাসায় ফিরে তাদের নকল করে বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়াকলাপ করেআমাদের মুগ্ধ করে যাচ্ছে৷ তাই এবারও ‘দি বিউটি সার্কাস‘ এর টিকেটকরার সময় ওদের জন্যও টিকেট করেছিলাম।
ক্যাম্বেলটাউনে মাত্র একটা শো রাখা হয়েছিল। সিনেমাটা দেখা শেষেআমি আমার মেয়েকে বললাম দেখো মানুষের জীবনযাপন কতসার্বজনীন! ‘দি বিউটি সার্কাস’র চাঁদোয়াটা একদম ‘স্টারডাস্ট‘ সার্কাসের মতো না? উত্তরে সে বলল, সেটাতো হবেই কারণ দুটোই তোসার্কাস। এরপর বললাম কিন্তু স্টারডাস্ট সার্কাসে কত ‘সেফটি মিজার‘ ছিল কিন্তু আমাদের দেশে পারফর্মাররা কোন ধরনের সেফটি মিজারছাড়াই পারফর্ম করেন তাই সেটা হয় আরও বেশি উপভোগ্য। আরওরা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়িটাও জানে ‘ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল’র মাধ্যমেযেখানে প্রতি রবিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শেখানো হয়বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি।
আমাদের পরিবারকে আমরা নাম দিয়েছি “দি নিউ অপেরা সার্কাস‘। যেখানে গিন্নী হলেন রিং মাস্টার, আমি ভাঁড় আর ছেলেমেয়ে দুজনপারফর্মার। আর আমি আমাদের জীবনটাকে বলি সার্কাসের মঞ্চ। সার্কাসে সবাই যেমন রিং মাস্টারের ইশারায় বিভিন্ন ধরনেরপারফরম্যান্স করে আবার ফিরে যায়। মানব জীবনেও আমরাও যেনপৃথিবী নামক মঞ্চে পারফর্ম করে আবার ফিরে যায় সেই অদৃশ্য রিংমাস্টারের কাছে। যাইহোক ‘বিউটি সার্কাস’র সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকেধন্যবাদ। সার্কাসের মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতেফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধতো আসলে ছিলএকটা সর্বজনীন গণযুদ্ধ। তাই এমন সিনেমা আরও বেশি বেশিহওয়া দরকার।
