
প্রায় এক মাস আগের কথা, অস্ট্রেলিয়ায় করোনা আতঙ্ক তখন মাত্র শুরুর দিকে,
একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দোকান পাঠ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বন্ধ হয়ে গেলো উইনিভার্সিটি গুলো। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীরা তখনও হয়তো সামনের দিনগুলির ভয়াবহতা আঁচ করতে পারেননি।
সরাসরি বিপাকে পড়ে গেলো নতুন সেমিস্টারে বাংলাদেশ থেকে আসা স্টুডেন্টরা। তাদের
বয়সই বা কত? ১৯-২০ হবে।
বাবা-মা এবং দেশ ছেড়ে জীবনের প্রথম অন্য মহাদেশে চলে আসা শিক্ষার্থী ওরা।
কাউকে চেনে না, কিছুই চেনে না। ক্লাস না হওয়ায় বন্ধু হওয়ার সুযোগটাও নেই।
সারাক্ষন আতঙ্কে অপরিচিত শহরের ইট পাথরের কামরায় বন্দি জীবন।
দেশ থেকে নিয়ে আসা টাকা প্রায় শেষ। দেশ থেকে টাকা আনার মত সামর্থ অনেকেরই হয়তো নেই। খাবার কিনে খেতেও অনেকে হিমশিম খাচ্ছে। কোনো জব পাওয়া যায়নি, আগে এসেছে এমন স্টুডেন্টদেরও কারও জব নেই, যারা রিটেইল বা হসপিটালিটিতে পার্ট টাইম জব করতো।

এদের কয়েক জনের সাথে সরাসরি কথা বলে আমি সবার প্রথম অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় বাংলাদেশী গ্রুপ পেজ ‘বাংলাদেশী অস্ট্রেলিয়ান’ এ ঘোষণা দিয়ে বললাম,
” অস্ট্রেলিয়ার কোনো বাংলাদেশী শিক্ষার্থী বা আর্থিক অসুবিধায় আছে এমন কাউকে একটি বেলাও খাবারের কষ্ট পেতে দেয়া হবে না”।
শিক্ষার্থীদের সহায়তায় প্রজেক্টের নাম দিলাম “আমরা খেলে তোমরাও খাবে”।
মুহূর্তেই শত শত সাড়া পাওয়া গেলো, অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটি শহর থেকে অসংখ্য বাংলাদেশী স্বচ্ছল পরিবার এখানে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী ও যে কোনো বাংলাদেশী, এমনকি বিদেশী শিক্ষার্থীদেরও সাহায্যে এগিয়ে এলেন। শুরুতে খাবার বা অন্যান্য সাহায্য প্রার্থীর সংখ্যা কম থাকলেও অস্ট্রেলিয়ার অর্থনৈতিক মন্দার সাথে সাথে এই সংখ্যাটি প্রতিদিন বাড়ছে।

“আমরা খেলে তোমরাও খাবে” প্রজেক্টের কনসেপ্ট একদমই সরল। যারা সাহায্য করতে চায়, তারা নির্ধারিত নাম্বারে টেক্সট করে বা গ্রূপে কমেন্ট করে তাদের অবস্থান জানিয়ে দেয়, তেমনি ভাবে যাদের সাহায্যের প্রয়োজন, তারা ইনবক্সে বা মোবাইলে টেক্সট করে তাদের প্রয়োজন জানিয়ে দেয়।
আমি এই দাতা আর গ্রহীতার সমন্বয়ের কাজটি করি খুব গোপনে। ভলান্টারেরা সাধারণত একই শহরের, একই এলাকার তারা ফোন নম্বর নিয়ে নিজেরা যোগাযোগ করে খাবার ও বাজার বাসার সামনে গেইটে দিয়ে আসেন।
কেউ কাউকে না দেখেও অত্যন্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে এই প্রজেক্ট চলছে। এছাড়াও প্রতিদিন সিডনির রকডেল, ল্যাকেম্বা ও ইঙ্গেল্বার্ন এলাকা থেকে যাদের প্রয়োজন তাদেরকে নিত্যপ্রয়জোনীয় গ্রোসারীজ ও খাবার সরবরাহ করা হয়। যাদের প্রয়োজন তারা আমার 0487777755 এই নাম্বারে যোগাযোগ করে গোপনে সবাই এসে বাজার ও খাবার নিয়ে যেতে পারে। যারা গ্রোসারীজ কিনে দিতে চান কিংবা টেকওয়ে খাবার দিতে চান, তারা গ্রূপে পোস্ট করে কিংবা আমার ব্যক্তিগত এই নাম্বারে যোগাযোগ করতে পারেন।
আর এই খাবার আসে ল্যাকেম্বার আসে পাশের বাংলাদেশী পরিবার থেকে। আর অনেকেই ল্যাকেম্বা এসে গ্রোসারীজ কিনে দিয়ে যান অনুদান হিসেবে।
মহতী এই কাজে আমাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেক ভাই, বন্ধু ও ব্যবসায়ীরা। তারা সমন্বিত হয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন যতটুকু সম্ভব কমিউনিটির প্রয়োজন মেটাতে। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ছেলে স্টুডেন্টদের চেয়ে মেয়েরা তুলনামূলক বেশি খারাপ সময় পার করছে, যারা হয়তো লজ্জা ভেঙে বাইরে আসে না, কারও জানা থাকলে তাদের অবশ্যই জানাবেন যোগাযোগ করতে।
“সাহায্য নয়, ভালোবাসা”; এই কনসেপ্টে এগিয়ে চলাটি আমার ব্যক্তিগত ধারণা, আর হয়তো বেশি দিন এই কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজন হবে না, অনেকেই যার যার অবস্থান থেকে কিছু না কিছু করছেন, আর অস্ট্রেলিয়ার করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতাও ধীরে ধীরে কমে আসছে। ভয়াবহতা কমে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবো, এটাই কাম্য।
এস এম আমিনুল রুবেল
সাংবাদিক, সংস্কৃতি কর্মী, সংগঠক।
অস্ট্রেলিয়া প্রতিনিধি, সময় টিভি।
সিডনি, বাংলাদেশ।