যা ভাল লাগে তাই পড়ি এবং লিখি। এটাই স্বাভাবিক। ভাল লাগার প্রধান্যটি সর্বাগ্রে। এটা একধরনের বিনোদন। অনেক প্রকার বিনোদনের মধ্যে একটি।এ বিনোদন মানে জীবন দর্শন। তাই, আমরা প্রতিনিয়তই নিজেদেরকে নিজেদের অজান্তে সাহিত্য জগতের মধ্যে নিমগ্ন করে ফেলছি। বই পুস্তক ছাড়াও বাইরের ও ঘরের জগতটাও সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ চারণক্ষেত্র। সাহিত্য চর্চা কি? কেন দরকার? সাহিত্য চর্চার সাধারন ব্যাখ্যাতো আমরা সবাই জানি। তবে যা জানি, তা কি কখনো নিজের দর্শন দিয়ে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছি ? তথ্যের চেয়ে তত্ত্বটির গুরুত্ব আমার কাছে বেশী; তবে বেশিরভাগ মানুষই তাত্ত্বিক কথা শুনতে চায় না। বোমা হামলায় শতাধিক মানুষের হতাহতের তথ্যবহুল খবরটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষনে কতজন মানুষ আগ্রহ দেখায়? খবরটি যেমন জানা দরকার, তেমনি হামলাকারীর অসুস্থ দর্শনটি বের করে তা নির্মূল করাটা তার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য চর্চার মাহাত্ম্য এটাই। বই-পুস্তক পড়ার অর্থ শুধুই উপভোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা নয়, বরং যথার্থ বক্তব্যটি বের করে নিজের দর্শনকে উপযুক্ত করা। সাহিত্যিকেদের কাজ তাদের ভাষাগত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ঘটনা বা বিষয় গুলির নিগূঢ় রহস্য বের করে ঘটনা ও বিষয়কে রহস্যহীন করা, যাতে করে পাঠক অর্থাৎ মানুষ রহস্যের ধুম্রজালে আবদ্ধ না থেকে কারন গুলি উপলব্ধি করতে পারে। ভাষাবিদের কাজ ভাষার গুণগত মান নিয়ন্ত্রন করা আর সাহিত্যিকের কাজ ভাষা ব্যবহারের পারদর্শিতায় দর্শনটিকে বক্তব্য রূপে উপস্থাপন করা। সাহিত্যমনা মানুষটি সর্বদাই সাহিত্যিকদের দর্শন ও পারিপার্শ্বিক প্রতিটি উপাদানের সাথে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় নিজেকে সংশ্লিষ্ট করে। এই মিথস্ক্রিয়াগুলির ফলাফল থেকে লব্ধ ধারনার আদর্শ ও উপযুক্ত রূপটির আলোকে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করার প্রচেষ্টাটি চলতে থাকে জীবনভর। নিজের এই অস্তিত্বের সংজ্ঞাটিকে মাঝে মাঝে অন্য আর একজনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মিলিয়ে দেখার প্রবনতাটিই মানুষকে সাহিত্য চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে। ভাল অথবা আদর্শ সাহিত্য আমি তাকেই বলবো, যে সাহিত্যে বিরাজমান কিন্তু অনাবিস্কৃত বা অসংজ্ঞায়িত ধারনা, উপলব্ধি, অনুভূতি ইত্যাদি মানব সংশ্লিষ্ট বিষয় গুলি উঠে আসে। বোধ গুলি আমাদের মধ্যেই থাকে, আদর্শ চেতনাটিও থাকে, শুধু এগুলির প্রায়োগিক উপযোগিতার ব্যাপারে আমরা সর্বদাই দ্বিধান্বিত থাকি। উপযুক্ত অথবা যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্য পেলেই তখন সেগুলির লালনে ও প্রয়োগে সচেষ্ট হই। সাহিত্যিকদের কাজ কাহিনী, উদাহরণ, উপমা, বিশ্লেষণ বা খন্ডায়নের মাধ্যমে বিষয় বা ধারনাটিকে স্বচ্ছ বা উপযুক্ত করা। সমগ্র কাহিনীর একটি বিশেষ খন্ডাংশকে সামনে এনে তার প্রেক্ষিতে দর্শন লাভের কিংবা সাহিত্যিকের গুনগত বা আদর্শগত মান বিচারের প্রয়াশটি সাহিত্য চর্চাকে কলুষিত করে। রবীন্দ্রনাথ পড়তে সবাই পারবে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দর্শনটি পেতে হলে, রবীন্দ্রনাথ পড়ার পূর্বে নিজেকে তৈরী করা আবশ্যক। আয়রনিক্যালি বললে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে হলে বা সমালোচনা করতে হলে রবীন্দ্রনাথ হতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরী করার পূর্বে পাত্রটিকে জীবানুমুক্ত করা জরুরী অথবা তৈরী করতে করতে একসময় পাত্রটি বহুবার ব্যবহারের কারনে জীবানুক্ত হয়ে যায়; যেমন পড়তে পড়তে একসময় দর্শনটি উন্মুক্ত হয়ে যায়। তাহলে আপাতত: দুটি পদ্ধতিতে মানুষ বা পাঠক আদর্শ সাহিত্যিকের উদ্দেশ্যটি উপলব্ধি করতে পারে; ধ্যান বা সাধনার মাধ্যমে নিজেকে উপযুক্ত করা অথবা চর্চা করতে করতে উপলব্ধি করার ক্ষমতায় পৌঁছানো। দেহে আবৃত সংস্কার, ধর্মীয় কুসংস্কার, সাধারন অনুপযোগী অাচরনবিধির প্রভাব ইত্যাদি রূপ কাপড়গুলির একটি একটি পরত খুলে, দেহটিকে অনাবৃত না করলে বা সক্ষম না হলে, বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় সূর্যালোকের স্পর্শ মানুষ আর কিভাবে পাবে, তা আমার জানা নেই। আমি সাধারণত: কাউকে কোন বিষয় বা ধারনার উপর আমার দর্শন বা তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বলি না, যদি সেটা বোঝার মত মানসিক অবস্থায় বা সেই পর্যায়ে ব্যক্তিটি নিজেকে উন্নীত করতে না পারে। কারন তাহলে তা হবে অরণ্যে রোদন করার মত। প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যকরা সাধারণত: পাঠকের গ্রহন করার ক্ষমতা বা তার মানসিক উপযুক্ততা বিচার করে লিখেন না, তবে তাদের আকাংখা থাকে প্রতিটি পাঠক যাতে নিজেকে উপযুক্ত করে নিতে পারে। এখন প্রতিষ্ঠিত বা আদর্শ সাহিত্যিক আমরা কাদের বলবো, এ ব্যাপারও আমাদের পরিস্কার ধারনা থাকা জরুরী।
আমার মতের সাথে বেশিরভাগ মানুষের অমত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, তারপরও বেশিরভাগ মানুষের মতামত সংশ্লিষ্ট হলে মতামতের চিরন্তন আদর্শটি নিরূপিত হয় না ; যার প্রমাণ মানব ইতিহাসে বহুবার মিলেছে এবং সমাজ পরিবর্তন ঘটেছে। সুতরাং মতামতটি আমার এবং তা হলো, একজন প্রতিষ্ঠিত ও আদর্শ সাহিত্যিক তিনিই যার দর্শন চিরন্তনের ভাবনাকে স্পর্শ করে; অর্থাৎ মৌলিকতার বিচারে বিশুদ্ধ। সুতরাং, কেউ দশটি বা বিশটি বা শতাধিক বই রচনা করেছেন তার উপর সেই লেখকের গুণগত মান নির্ভর করে না। ভাষায় দখল থাকলে অনেকেই অনেক কিছু লিখতে পারে, তার অর্থ এই নয় যে, তার কথিত সাহিত্যে উপযুক্ত দর্শন রয়েছে। বিচারক হলো উপযুক্ত পাঠক, মানুষ আর তার প্রভাবমুক্ত মন। উপযুক্ত পাঠকও সবাই নয়, একথা আগেই বলেছি। সহশ্রাধিক বই পড়ে বা সেগুলিকে সেলফে সাজিয়ে রেখে সাহিত্যমনা বা তার ধারক ও বাহক এ বিশেষণটি পেলেও আসলে সে তা নয়। বিশেষণটি অর্জিত হয় ধ্যানে ও সাধনায়।

উপরের ব্যাখ্যার উদ্দেশ্য হলো পাঠককে সাহিত্য সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয়ের উপর ও এগুলির অন্তর্নিহিত দর্শন ভাগাভাগির জন্য মানসিক ভাবে উপযুক্ত করা। দর্শন আমার নিকট খুব প্রয়োজনীয় একটি শব্দ, তার কারন সর্বসম্মতিক্রমে, জ্ঞানের ধারক ও বাহকেরা দর্শনকেই সর্বজ্ঞানের শীর্ষে এর অবস্থান দিয়েছেন। সেই সাহিত্য দর্শনকে সামনে রেখে সম্প্রতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের “শাড়ি” বিষয়ক লেখাটির সমালোচনার অযৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পর্কে আমার মনে হয় কোন ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন নাই, কারন এ নামটির সাথে সাহিত্য প্রেমী সবারই ভাল পরিচিতি আছে এবং নামটি মনে আসার সাথে সাথে ভেসে উঠে একজন চমৎকার মনের মানুষের প্রতিকৃতি যে কিনা সদাহাস্য ও চিরযুবা। যার কাছে জীবনের অর্থ সকালের সবুজ ঘাঁসে শিশিরের সৌন্দর্যে মুগ্ধতায়, বিকেলের হেলে পরা সূর্যের লালাভ রশ্মিতে মায়াময় সৌন্দর্যে বিলীন হওয়ায়।তার দৃষ্টির প্রসারতা যেখানে তার কাছে পৌঁছাতে সাধনা দরকার। আমি পৌঁছাতে পেরেছি তা নয়, তবে প্রসারতা যে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তারিত, তা উপলব্ধি করতে পারি। নারী সর্বকালেই পুরুষের স্বপ্নরাজ্যের কাংখিত মুকুট । পুরুষের যুদ্ধ জয়ের অঙ্গীকারের প্রধান চালিকাশক্তিই ছিল নারী, এটি ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সহজেই ধরা পড়ে। সাহিত্যের বেশিরভাগ ক্ষেত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুগে যুগে এই নারীই কবি, সাহিত্যিকেদের সৌন্দর্যবোধের উপমায় অধিষ্ঠিত ছিল। কেন? দর্শনটি কোথায়? প্রকৃতিগতভাবেই একটি পুরুষের অন্তরে একটি নারী প্রতিমূর্তি সর্বদাই অবস্থান করে। তার সৌন্দর্যবোধের ধারনায় সেই নারীটি সর্বদাই প্রতিনিধিত্ব করে। কালিদাস, রবীন্দ্র , নজরুল, সুনীল কার সাহিত্যে স্থান পায়নি নারী সৌন্দর্য্যের মহিমাটি? সৌন্দর্য্যবোধ ধারন করা, এটিকে লালন করা, এ বোধে নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করা এবং তা মনের আবেগ, আহলাদ ও মুগ্ধতা দিয়ে প্রকাশ করা ইবাদত বা পূজা বলতে যা বুঝায়, তার সামিল।
এ অনুভূতি প্রকাশের বাসনা এতটাই প্রবল যে, মাঝে মাঝে ভাষার ক্ষমতা অতিক্রম করে যায়। তখন কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকেরা প্রকৃতির বিভিন্ন সুন্দরের মহিমায় উদ্ভাসিত উপাদানকে উপমা হিসাবে বেছে নেয়। এটাই শিল্প এবং উপস্থাপনাটি শৈল্পিক। শৈল্পিক ধারনায় চিরন্তন দর্শন প্রকাশ পায়। ফুলের সৌন্দর্য্যে আবেগ তাড়িত হয়ে কবিতা লিখলে এক্ষেত্রে কবির প্রগাঢ় অনুভূতিটিই প্রকাশ পায়; অপরদিকে ফুলটিকে ভোগ করার বাসনাটি ফুলটির উপর সৌন্দর্য্যবোধের ধারনায় সংজ্ঞায়িত রূপটিকে শুধুই মৃত করে; যেমনি করে শুধুই কামনার লালসায় সৌন্দর্যটি সর্বদাই কলঙ্কিত হয়। শুধু মাত্র কামনাটি কলঙ্কিত কিন্তু সৌন্দর্য্য মহিমা মিশ্রিত কামনাটি কাংখিত। কামনাটি সর্বদাই প্রচ্ছন্ন এবং সৌন্দর্য্যবোধটি প্রকাশ ও প্রকট। সৌন্দর্য্যবোধটি ভালবাসা আর কামনাটি তার উপজাত। এটা স্বর্গীয়। এ বোধটিতে কোন দ্বন্দ্ব রাখা সাহিত্য পূজারীদের মানায় না।
নারী সম্পর্কিত এ সৌন্দর্য্যবোধটিতে নারীটি কখনোই পুরুষের ভোগের সামগ্রী হিসাবে প্রকাশ পায়না বরং নারী রূপের স্বর্গীয় দেবীটিকে পূজা করার বাসনাটিই প্রকাশ পায়। প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষটিই কেন নারীর সৌন্দর্য্য প্রকাশ করে কিন্তু নারীটি কেন পুরুষের সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয় না। এর কারন হতে পারে পুরুষ প্রকাশমূখী কিংবা নারী সম্পর্কে তার বোধটি তুলনামূলক ভাবে বেশী প্রবল। অপরদিকে নারীটি হয়তো সম পর্যায়ের অনুভূতি পোষন করে কিন্তু সামাজিক প্রেক্ষাপটের বৈরী পরিবেশের কারনে প্রকাশটি প্রচ্ছন্ন রূপেই তার মধ্যে অবস্থান করে। অনেকটা ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ ধরনের। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘শাড়ি’ টি উপরে বর্ণিত এ দর্শনটিতেই উদ্ভাসিত। তিনি শাড়িকে বাঙ্গালী নারীদের উপযুক্ত ও মানানসই পোশাক হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন শাড়ি শুধু বাঙ্গালী নারীদেরকেই সৌন্দর্য্যের শীর্ষে স্থান দেয়। এর পক্ষে তিনি ব্যাখ্যা করে দৈহিক গঠনের উপযুক্তায় পোশাকটিতে অাদর্শ করেছেন। বলুনতো, আপনারা কোথায় সমস্যা খুঁজে পেয়েছেন? বর্ণনায়? শব্দ চয়নে? ছি! এ ‘ছি’ এর মানে করুণা। করুণা তাদের জন্য যারা উপযুক্ত দর্শন লাভ না করে সমালোচনা করছেন। করুণা সে নারীদের জন্য যারা দেবীর আসন থেকে নিজেদেরকে অপসারণ করে নিজেকে ভোগের সামগ্রীতে রূপান্তর করেছেন। দর্শনে সমস্যা থাকলে পড়ুন এবং আরো পড়ুন অথবা ধ্যানে মগ্ন হয়ে সাধনা করুন। সাহিত্য জগতের সত্যিকারের দর্শনের আলোকে নিজেকে আলোকিত করুন।
দীন মোহাম্মদ মনির
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।