প্রশান্তিকা রিপোর্ট: ‘গরম গোস্ত আর গান আবার আইস্যি মেজ্জান’ শ্লোগানের সাথে সিডনিতে চট্টগ্রামবাসীদের ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ উৎসব মেজবান জাঁকজমকের সাথে অনুষ্ঠিত হলো। প্রায় দুই হাজার মেজবান বা অতিথি নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর রোববার লিভারপুলের হুইটলাম সেন্টার পরিণত হয়েছিলো যেনো ছোট্ট একটি চট্টগ্রামে।
মেজবান উপলক্ষে আয়োজক বৃহত্তর চট্রগ্রাম সমিতি অস্ট্রেলিয়া ইনক সুদূর চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলো প্রখ্যাত বাবুর্চি আবুল হোসেন, জনপ্রিয় শিল্পী তপন চৌধুরী এবং চট্টগ্রামের রূপকার মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে। সঙ্গে ছিলো চট্টগ্রামের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল সি প্লাস। তারা পুরো অনুষ্ঠানটির লাইভ সম্প্রচার করে। মেজবানে আগত চট্টগ্রামবাসী ছাড়াও বাংলাদেশী কমিউনিটির গণ্যমান্য ব্যক্তি, অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিবিদ, এমপি, সাংবাদিক ও সুধীজনেরা আমন্ত্রিত হয়ে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই মিলনমেলায় অংশগ্রহণ করে।
অনুষ্ঠানে ছিলো ঐতিহ্যবাহী খাবার মেজবানি মাংস, পায়া আর ছোলা বুট দিয়ে মাংস, চায়ের সাথে চট্রগ্রামের বেলা বিস্কুট, বাচ্চাদের খেলাধুলা, গান, ফেইস পেইন্টিং সহ নানা কর্মসূচি। খাবার পরিবেশন করতে একটু দেরী হলেও মেজবানে আগত অতিথিরা বলেছেন, খাবার খুব সুস্বাদু ছিলো। অনেকেই বলেছেন তারা কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছেন।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার প্রশান্তিকাকে জানান, প্রায় দুই হাজার অতিথির আপ্যায়নে ২০ জনের রন্ধন শিল্পী দলের নেতৃত্ব দেন বাবুর্চি আবুল হোসেন। নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো পেশাদার নিরাপত্তা কোম্পানির সদস্যরা। এছাড়া প্রায় ১০০ জন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ এবং একটি পোর্টালে মেজবান অনুষ্ঠানস্থলে ঢোকার মুহূর্তে নারীদের হাত ধরে টানাটানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এবিষয়ে ইফতেখার বলেন, অনুষ্ঠান চলাকালে একজন ব্যক্তিও অভিযোগ করেননি। নিরাপত্তা কর্মিরা টিকেট দেখে হাতের উল্টো পিঠে একটি স্ট্যাম্প বা সিল দিয়েছেন। যার ফলে অতিথিরা যেমন খুশি বাইরে গিয়ে বা বাচ্চাদের খেলায় অংশ নিয়ে বা কোন কারন ছাড়াই বাইরে গিয়ে ভেন্যুতে ঢোকার সময় সিলটা দেখালেই যথেষ্ঠ ছিলো। এই ঘটনাকে হাত ধরে টানাটানি আখ্যা দেয়া সত্যিই দু:খজনক বলে জানান তিনি। আর এতো বড় আয়োজনে ভুল ত্রুটি একটু থাকলে তিনি সমিতির পক্ষ থেকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করেন।

মেজবানের প্রধান অতিথি মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান সমিতির সদস্যরা। মঞ্চে তাঁকে সম্মাননা ক্রেস্ট উপহার দেয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সমিতির সভাপতি আলম, সাধারন সম্পাদক ইফতেখার সহ সমিতির সদস্যরা প্রমুখ। উপমন্ত্রী নওফেল তাঁর বক্তব্যে চট্টগ্রামের বাইরে বিদেশের মাটিতে মেজবানের সমাগম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্য এই মেজবানকে শুধু খাওয়া দাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজের কল্যানে আরও কাজ করার আহবান জানান।
অনুষ্ঠানের শেষ আকর্ষণ ছিলো জনপ্রিয় শিল্পী তপন চৌধুরীর গান। ‘কি এমন পরিচয় অনুমতি প্রার্থণা’; ‘তুমি আমার প্রথম সকাল, একাকী দুপুর ক্লান্ত বিকেলবেলা’; ‘গাইলে বৈরাগীর গীত গাইও’ সহ জনপ্রিয় সব গান শোনান। শেষ গান ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গানটি গাওয়ার সময় তিনি সিডনির শিল্পীদের মঞ্চে আসার আহবান জানান। এসময় পিয়াসা বড়ুয়া ও অভিজিৎ বড়ুয়া মঞ্চে এসে শিল্পীর সঙ্গে কন্ঠ মেলান।

মেজবানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন সিডনির কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব গামা আব্দুল কাদির। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি প্রশান্তিকাকে বলেন, “এবারের মেজবান ছিলো অসংখ্য মানুষ নিয়ে বিশাল একটি আয়োজন। এতোগুলো মানুষকে টেবিলে বসিয়ে খাবার পরিবেশন করা চাট্টিখানি কথা নয়। তবুও আমার দৃষ্টিতে ভুল ত্রুটি ধরা পড়েনি।” তিনি আরও বলেন, প্রধান অতিথি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েও তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি। বরং একজন চট্টগ্রামের সন্তান হয়েই মেজবানে আগত অতিথিদের সম্ভাষণ জানিয়েছেন।

সিডনি প্রেস এন্ড মিডিয়া কাউন্সিলের সাধারন সম্পাদক মোহাম্মাদ আব্দুল মতিন বলেন, “মেজবান অনুষ্ঠান সুন্দর হয়েছে। তবে মেহমানদের বৈষম্য, প্রবেশমূল্য এবং খাবারের আইটেম নিয়ে আমার মতামত রয়েছে। আয়োজকেরা ভিআইপি এবং সাধারন মেহমানের বৈষম্য নাও রাখতে পারতেন। আর অনুষ্ঠানে আগতদের জন্য (আমন্ত্রিতদের ব্যতিরেকে) প্রবেশমূল্য না রাখলেই ভালো হতো। খাবারের আইটেম বাড়ালে খুব ভালো হতো।”
অস্ট্রেলিয়া প্রেস এন্ড মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি রহমত উল্লাহ বলেন, “এবার মেজবানের আয়োজনটি সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়েছে। দু’একটা ত্রুটি থাকলেও আমার চোখে পড়েনি।”

মুক্তমঞ্চ সম্পাদক আল নোমান শামীম বলেন, “বিশাল আয়োজনের এই মেজবানকে সার্থক করতে যে শ্রম দরকার ছিলো আয়োজকেরা সেটা করেছেন এবং সার্থক হয়েছেন। আমি আমার জীবনে এতো সুস্বাদু গরুর মাংস ও বুটের ডাল খাইনি। এজন্য বাবুর্চি আবুল হোসেন সহ সকল রন্ধনশিল্পীকে ধন্যবাদ। আয়োজকদের আতিথেয়তাও ছিলো আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ।”
মেজবানে আগত অনেকেই সুস্বাদু খাবারের পরে স্টার বাবুর্চি আবুল হোসের সঙ্গে সেলফি তুলে পোষ্ট দেন। সিডনি প্রবাসী শাহরিয়ার পাভেল তাঁর পরিবার সহ বাবুর্চির সাথে ছবি তুলে বলেন, “কর্ণফুলির তীর হতে তিনি এসেছেন প্রশান্তপারে, তাঁর হাতের যাদু দেখাতে। সে যাদু-হাতের ছোঁয়ায় রান্না হয়েছিল তিন পদ। কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া শেষে তাই গিয়েছিলাম তাকে শুকনা একটা থ্যাঙ্কস্ দিতে।”
ফাহাদ আসমার বলেন, “চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহি মেজবানে এসে আমি এক কথায় অভিভূত, মনে হয়েছিল অনেক দিন পরে দুম করে আমার বাংলাদেশে চলে এসেছি। দেশ থেকে এত দূরে দেশের ঐতিহ্য বহন করে হাজার মানুষের এই আয়োজন যেমন বিশাল এবং বর্ণিল ছিল, তেমনি চমৎকার ছিল আয়োজক এবং স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দের আন্তরিকতা এবং ব্যবস্থাপনা। প্রায় শতাধিক স্বেচ্ছাসেবকদের আতিথেয়তা এবং সমন্বয় ছিল প্রশংসা করার মত। বলতেই হবে, চট্টগ্রামের সুবিখ্যাত আবুল বাবুর্চি তাঁর নামের প্রতি সুবিচার রেখেছেন, খাবারের স্বাদ ছিল অসাধারণ।
একটা ব্যাপার হল যত বড় আয়োজন, ভুল ত্রুটি হবার সম্ভাবনা ততোটাই বেশি এটা আমরা জানি তাই অন্যান্য সকল অনুষ্ঠানের মত স্বাভাবিকভাবেই এখানেও চোখে লাগার মত কিছু বিষয় ছিল। খাবারে বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল কিন্তু যতটুকু জেনেছি তাঁদের চেষ্টা ছিল সবাইকে একসাথে খাবার দেয়ার, নিয়মতান্ত্রিক জীবনে কিছু মানুষের একটু বেশি কষ্ট হলেও আয়োজকদের এই বিশাল চেষ্টাটাকে সাধুবাদ জানাই। পরেরবার তারা হয়তো আরো কার্যকরি কোন ব্যবস্থা নিয়ে আসবেন।
তাছাড়া খাবার শেষে যারা তপন চৌধুরীর গান শোনার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন, দুর্বল সাউন্ড সিস্টেমের জন্য তারা ঠিকমত তা উপভোগ করতে পারেননি। যদিও আমার কাছে ব্যাপারটা নিতান্তই আরেকটি দূর্ঘটনা মনে হয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম সমিতির সাংগঠনিক কাঠামো এবং আন্তরিকতা দেখে আমি আশাবাদী যে এবারের ভুলত্রুটি ছাপিয়ে পরেরবার তারা সিডনিবাসিকে আরো চমৎকার অনুষ্ঠান উপহার দেবেন এবং সে ক্ষমতা তাঁদের আছে বলে বিশ্বাস করি। সবশেষে, এই প্রবাসে এত চমৎকার একটা আয়োজনের মাধ্যমে সবাইকে একত্রিত হবার, চমৎকার একটি ছুটির দিন উপহার দেবার জন্য আয়োজকদের অসংখ্য ধন্যবাদ।”

চট্টগ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে তৌফিক বলেন, আমরা চেস্টা করেছি মেজবানের মেহমানদের আতিথেয়তায়। তারা খুশি থাকলেই আমাদের শ্রম সার্থক।”
সমিতির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন বলেন, “আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়া মেজবানে অংশগ্রহনকারীরা ১৫ ডলার প্রবেশমূল্য দিয়ে মেজবানে এসেছেন। তবুও মেজবানের কয়েকদিন আগে আমাদের সকল আসন সংখ্যা শেষ হয়ে যায়। এই ১৫ ডলার দিয়ে আমরা খাবারের ব্যবস্থা করিনি। ভবিষ্যতে কমিউনিটির কল্যানেই এই অর্থ ব্যয় হবে। এছাড়া মেজবান থেকে অর্জিত অর্থের ১৫ ভাগ চিল্ড্রেনস চ্যারিটি ফান্ডে দেয়া হবে।”
সবশেষে সমিতির সভাপতি আলম উপস্থিত মেজবান অতিথিদের ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।