সিডনিতে বইমেলা এবং অতঃপর-শাখাওয়াৎ নয়ন

  
    

(এক)
ভালো কবি-সাহিত্যিক হবার জন্য কি পড়বেন, কি পরবেন, কখন লিখবেন, কিভাবে লিখবেন, কি লিখবেন? এ জাতীয় প্রশ্ন উত্তর সম্বলিত বই-পুস্তক পাওয়া যায়। এছাড়াও পত্র-পত্রিকায় ছোট-বড়-মাঝারি ধরনের কবি-লেখকদের উপদেশমূলক সাক্ষাৎকার তো হাজারে-বিজারে পাওয়া যাচ্ছে। এসব দেখলেই আগে খুব যত্নসহকারে পড়তাম। এখন আর খুব একটা পড়া হয় না।
রবীন্দ্রনাথ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন, এক গ্লাস চেরতার পানি খেয়ে লিখতে বসতেন। এক্কেবারে এগারোটা পর্যন্ত লিখতেন। কারো কারো আবার রাত গভীর না হলে লেখার মুড আসে না। এ বিষয়ে মহাত্মা চরম উদাস রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এসো নিজে করি’ পড়লাম। বইটি আবার আমার এক আপনজন রওনক ভাই গিফট করেছেন। চরম উদাস উক্ত গ্রন্থে কবি-লেখকদের বিষয়ে অত্যন্ত গভীর কথা বলেছেন, ‘ভালো সাহিত্যিক হবার জন্য আপনাকে দুটো জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। আপনি কি পড়ে লিখছেন এবং কি পরে লিখছেন? লক্ষ্য করুন ‘পড়ে’ এবং ‘পরে’। প্রথমটি বই-পুস্তক এবং দ্বিতীয়টি পোশাক। অনেকেই মনে করেন, আপনি কি পোশাক পরে আছেন, সেটা মোটেও গুরুত্বপুর্ন নয়। একেবারেই ভূল ধারণা। পোশাক খুবই গুরুত্বপুর্ণ। আপনি কি পড়ছেন সেটা যেমন আপনার লেখায় ছাপ ফেলবে, তেমনি আপনি কি পরে আছেন, সেটাও আপনার লেখায় ছাপ ফেলতে বাধ্য। দিনরাত রসময় গুপ্ত পাঠ করলে আপনার লেখায় মাসিমা, মেসোমশাই, ভাবী, পাশের বাড়ি, বেড়ার ফাঁক দিয়ে…এসব নানা শব্দ আপনি না চাইলেও আপনার লেখায় ঢুকে পড়বে। তেমনি দিনরাত কবিগুরু পড়ে লিখতে বসলে আপনার সাহিত্যে ঝরঝর, বাদল, প্রভাত, রবি, বর্ষা- ইত্যাদি তো আসবেই। সেই সাথে বোনাস হিসেবে সকল ক্রিয়াপদের শেষে একটি ‘ু’ কার যুক্ত হয়ে যেতে পারে। যেমন-এসেছিনু, দেখেছিনু, করেছিনু করতে করতে নু তে নু-ময় হয়ে যাবেন।

একইভাবে পোশাকের ক্ষেত্রেও। আপনি কি লুঙ্গি পরে একখানা অমিত-লাবণ্যের প্রেমগাথা লিখতে পারবেন? কক্ষনো না। আপনাকে অবশ্যই মালকোঁচা দিয়ে ধুতি সাথে পাঞ্জাবি পরে মাঝ দরিয়াতে বজরায় বসে লিখতে হবে। সব কিছুর একটা নিয়ম-কানুন আছে। আর লুঙ্গির কথা তো জানেনই। মানুষের লুঙ্গি এবং কপাল যেকোনো সময় খুলে যেতে পারে। গদ্য লিখতে হয় শার্ট-প্যান্ট…ইত্যাদি পরে। তাতে গদ্য জমাট বাঁধে। পদ্য লিখতে হয় ধুতি পরে, তাতে পদ্যে খোলা হাওয়া চলাচল করতে পারে।‘
বিদ্রোহী কবিতা লেখার জন্য একটু বাবরি চুল থাকা আবশ্যক। তবে এটা প্রমানিত সত্য নয়। আমাদের ফ্যামিলিতে আবার নজরুল সিনড্রোম ব্যাপক। ক্লাস সিক্স থেকে এইটে পড়াকালীন সময়ে প্রায় সবাইকেই (আমি বাদে) কোথাও না কোথাও কোনো রুটির দোকান থেকে ধরে আনতে হয়েছে। তারা সবাই দুঃখমিয়া হতে চেয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি।

(দুই)
সিডনিতে প্রতি বছর পুরো একদিন ব্যাপী বইমেলা হয়। একুশে একাডেমি নামক একটি সংগঠন এই মেলা আয়োজন করে। এবছর ছিল তাদের ২১তম আয়োজন। উক্ত বইমেলা উপলক্ষ্যে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয়। এ বছর উক্ত ম্যাগাজিনটির সম্পাদনার দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর। অনেকে ভালো ভালো লেখা দিয়ে যেমন কৃতজ্ঞ করেছেন, তেমনি কেউ কেউ মর্মাহতও করেছেন। এক কবি একাই কবিতা পাঠিয়েছেন মাত্র ছয়টি, যদিও একটি লেখা চাওয়া হয়েছিল। যাউকজ্ঞা কবিকে ছেড়ে দেই। কবিদের সকল দোষ-ত্রুটিই বাঙ্গালি মাফ করে দেয়। এবার গদ্যকারের দিকে যাই।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক, একজন তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন (নাম প্রকাশ করছি না), ‘যখন মেলা পরিচালনা কমিটির মাইকে শুনলাম, তাঁরা গত বিশ বছর এই মহৎ কর্মযজ্ঞ করে আসছেন, তখন আমার কেবলই মনে হতে থাকে, এই মানুষগুলোই আমাদের দেশের সবচেয়ে ভালো মানুষ, খ্যাতিমান মানুষ, গুণী মানুষ। এদেরকে আলাদা একটা শ্রদ্ধা বা মর্যাদার আসনে সমাহিত করা উচিৎ।‘ কথাগুলো কয়েকবার পড়লাম। ভাবছি, একুশে একাডেমির আয়োজকদের প্রতি উনি এত ক্ষ্যাপা কেন? এদেরকে উচ্চাসনে কবর দিতে চান কেন? মানুষের প্রতি মানুষের রাগ-ক্ষোভ থাকে, তাই বলে এতটা! আমি আস্তে করে ‘সমাহিত’ শব্দটিকে ‘সমাসীন’ করে দিলাম। ধরে নিলাম এটা নেহায়েত একটা বানান ভূল ছাড়া কিছু না। যাউকজ্ঞা…কেল্লা ফতে…। সকল কাঁটা ধন্য করে ফুল ফুটানোর দায়িত্ব সম্পাদকের, তাই অস্থির এবং কাপাকাপি জটিল চেষ্টা নিলাম।

(তিন)

সিডনি বইমেলায় যেসব বইয়ের বিক্রি চোখে পড়েছে

সিডনিবাসি বাঙ্গালি কবি-লেখকদের প্রসঙ্গে কিছু কথা না বললে, ক্যাম্নে হয়? প্রথমে অনুজপ্রতীম কবি ফাহাদ আসমার এবং এস এম আমিনুল রুবেল এর কথা বলি। এদের দুজনেরই এবছর প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে। এরা দুজন ঘনিস্ট বন্ধু। প্রথম বই প্রকাশের আগে সব লেখকই ‘ফার্স্ট বুক পাব্লিশিং সিন্ড্রোম’ এ ভোগে। এই সিন্ড্রোম বেশ ভয়ংকর হয়। এরা দুজন যতটা ভোগার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি ভুগেছে প্রবাসে থাকার কারনে। প্রকাশকরা কথা দিয়ে কথা রাখে না, ফোন রিসিভ করে না, সর্বোপরি শেষ মুহুর্তে পান্ডুলিপি সম্পাদনা এবং ‘বানান ভুল’ ঠিক করা নিয়ে যারপরনাই নাকাল হয়েছে বেচারারা।
একটা উদাহরণ দেই- রুবেলের বইয়ের প্রচ্ছদ হয়ে গেছে, মুদ্রণও হয়ে গেছে, শুধু বাঁধাই করা বাকি। অত্যন্ত লাজুকভাবে আমাকে মোবাইলে তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদ দেখালো-বইয়ের নাম “নিঃসঙ্গ বিলাশ”। অমনি বজ্রপাত। আমি বললাম রুবেল! বিরাট ভূল হয়েছে, এটা হবে ‘নিঃসঙ্গ বিলাস’। লাশ মানে মৃত দেহ। তুমি নিশ্চয়ই তা বোঝাওনি। বেচারা খুবই আপসেট হয়ে গেল। হবারই কথা। বইয়ের নামের বানানই ভূল। না জানি ভিতরে কী আছে! তখন এসব ঠিক করার সময় নেই বললেই চলে। প্রিন্ট হয়ে গেছে। আমি তাকে সান্তনা এবং সাহস দিয়ে বললাম, ‘এটা নতুন কিছু না। এরকমটা অনেকের সাথেই হয়ে থাকে। প্রকাশকরা ঠিকমত প্রউফরিড করায় না। তুমি যে কোনো মূল্যে ঠিকমত প্রউফরিড করাও’।
রুবেলের পরবর্তী কয়েকটি দিন-রাত কেমন গেছে, বুঝতেই পারছেন। ফাইনালি সে ঠিক করিয়েছে। এবার ফাহাদ আসমারের কথা বলি, বিনয়ী ছেলে পেশাদার আলোকচিত্র শিল্পী, আবৃত্তিও করে। কবিতার বই লিখেছে। জানুয়ারী মাসের শেষের দিকে আমার কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে বলে, ‘ভাইয়া একটু দেখে দিবেন?’ আরে ভাই আমি কবিতার কি বুঝি? আমি কি কবি? সে নাছোরবান্দা। এক পৃষ্ঠা দেখেই বললাম, পেশাদার সম্পাদকের মাধ্যমে এই পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করাতে হবে। তারপরে অন্যকথা। সে বাধ্য ছেলের মতো তাই করলো। তাঁর বইয়ের নাম ‘ডাকাতিয়ার জন্য ভালোবাসা’। প্রথম বই। সেই একই অসুখ ‘‘ফার্স্ট বুক পাব্লিশিং সিন্ড্রোম’ । কথায় আছে, ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তাঁর’। যতদূর জেনেছি, আমাদের সিডনি শহরের একুশে বইমেলায়; এই প্রিয় দুই অনুজ কবিদের বই দুটি সর্বাধিক বিক্রি হয়েছে। কায়মনে দোয়া করি, তাদের কবি জীবন আরো সফল এবং দীর্ঘ হোক।

এখানে শুধু কবিতা লেখা হয় না। গদ্যও লেখা হয়। ইসহাক হাফিজ এর ছোটগল্পের বই ‘প্রণীত শেকল’ এবং আরিফুর রহমানের উপন্যাস ‘নিঃশব্দ প্রহরে’ ভালো পরিমানে বিক্রি হয়েছে। প্রচ্ছদের দিক থেকে ইসহাক হাফিজের ‘প্রণীত শেকল’ এবং আরিফুর রহমানের উপন্যাস ‘নিঃশব্দ প্রহরে’ দারুন। এছাড়া বাংলাদেশে এই সময়ের আলোচিত লেখক সাদাত হোসাইনের উপন্যাস ‘নির্বাসন’ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিক্রি হয়েছে।
উল্লেখ্য, আবুল হাসনাৎ মিল্টন এর উপন্যাস ‘আমি ভালো নেই, তুমি?’ আল নোমান শামীম এর প্রেমের কাব্যখানি ‘সাদা শাড়ির লাল পাড় জুড়ে নূপুরের শব্দ’ এবং কাজী সুলতানা শিমি’র নিবন্ধের বই ‘শুরু হোক পথচলা’ যথাসময়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় নি।

পুনশ্চঃ
এই লেখাটি উৎসর্গ করছি সেই সব মহান ভদ্রলোকদেরকে, যারা জেনে-শুনে বইমেলায় এসে ‘পকেটে ক্যাশ নেই, ক্রেডিট কার্ডে পে করা যাবে?’ জিজ্ঞেস করেন। সকল প্রশংসা তাহাদের করকমলে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments