সিডনির নজরুল ভাই । স্মরণ । রণেশ মৈত্র

  
    

গত ২০ জুন সকলকে হতবাক-শোকস্তব্ধ করে দিয়ে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন সিডনী প্রবাসী ঈশ্বরদী পাবনার সন্তান নজরুল ইসলাম। খুব একটা অপ্রতাশিতভাবেই খবরটি প্রথম টেলিফোনে দিল প্রবীর। সে ‘বাবা দিবস’ উপলক্ষ্যে আমাকে প্রণামও জানালো। পর পরই ফেসবুক ও প্রশান্তিকা মারফত খবরটির বিস্তারিত জানলাম। গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম-পূরবীও।

ইয়াসমিন ভাবী ও সন্তানেরা রইলেন। রইলেন তাঁর অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীকে। নজরুল ভাইয়ের স্মৃতিকে ধারণ করে। তাঁদের সবার প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা জানাই। আমরাও তাদের সকলের শোকের অংশীদার।
নজরুল ভাই আমাকে আগে থেকেই চিনতেন-তেমনটাই বলেছিলেন সিডনীতে ২০০০ সালে প্রথম সাক্ষাত ও আলোচনা কালে। কিন্তু আমাদের সাক্ষাত পরিচয় হলো সিডনীতেই। এরপর যতবার সিডনী গিয়েছি খবর পেলেই ছুটে আসতেন প্রবীরের বাসায় আমাদের সাথে দেখা করতে। যতদিন সিডনী থেকেছি, প্রায় প্রতি মাসেই একবার করে আসতেন আমার ও পূরবীর সাথে দু’এক ঘন্টা করে সময় কাটাতে। সঙ্গে আনতেন নানা রোগে জর্জরিত ইয়াসমিত ভাবীকেও। উভয়েই ছিলেন শতভাগ অসাম্প্রায়িক ও বাঙালি সংস্কৃতি অন্ত প্রাণ।

নজরুল ভাই ছিলেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানী, উচ্চশিক্ষিত। চাকুরী করেছেন করাচীতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। ঐ অবস্থায় একদিন এক সংবাদপত্রে দেখলেন, অষ্ট্রেলিয়ায় মৃত্তিকা বিজ্ঞানী পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। যে যে গুণাবলী চাওয়া হয়েছিল তার সবগুলি যোগ্যতাই থাকার ফলে তিনি একটি দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন যথাস্থানে। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর নিয়োগপত্র এসে গেল অষ্ট্রেলিয় সরকারের কাছ থেকে। তিনি সেখানে গিয়ে কাজে যোগদান করলেন সপরিবারে সেখানেই থেকে গেলেন।

পরপরই এসে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানী নৃশংসতার খবরে গভীরভাবে বিচলিত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের কাজে সহায়তার জন্য অষ্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার সরকার ও মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত তাজউদ্দিন সরকারের সাথে যোগাযোগ, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অষ্ট্রেলিয়ান সমর্থন সংগ্রহের কাজ সাফল্যের সাথে করতে সমর্থ হলেন। আত্ম প্রচার বিমুখ নজরুল ভাই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ সরকারের সাথে কোন দেন দরবার করেননি তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বা সম্মানিত করতে। মৃত্যুর পরে হলেও, প্রবাসী বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা (মরণোত্তর) হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি দেয়া অতি জরুরী।

গত ২০ জুন ৮২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন নজরুল ইসলাম।

নজরুল ভাই সিডনিতে গড়ে তুলেছিলেন অষ্ট্রেলিয়ান-বাঙালি এসোসিয়েশন। তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন ওই সংগঠনের প্রথম সভপতি। দিবারাত্র সচেষ্ট থেকেছেন সেখানকার বাঙালি সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে। বেশ কিছুকাল তিনি ঐ ঐক্য ধরে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু সে মুহূর্তে সেখানে দলীয় ভিত্তিতে বাঙালিরা বিভক্ত হতে শুরু করলেন। নজরুল ভাই নীরবে সরে এলেন। তাঁর কথা ছিল অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালিদের অনেক সমস্যা আছে-দলমত নির্বিশেষে সকলকেই যার মোকাবিলা করা পয়োজন। কিন্তু বিভক্তি এলে, ঐক্যবদ্ধ না থাকলে তা মেটানো সম্ভব নয়। তাই সত্য হলো। দলীয় কমিটিগুলো, বিশেষ করে সেখানকার আওয়ামী লীগের নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপি-জামায়াতের খবর জানি না-তবে বিএনপির মধ্যেকার দলাদলির খবর মাঝে মাঝে কানে আসতো সিডনীতে থাকাকালে। পরিণতিতে প্রবাসী অষ্ট্রেলিয়ান সমাজের ঐক্যবদ্ধ মূল সংগঠনটির অস্তিত্বই বিলুপ্ত হলো।

তবুও অষ্ট্রেলিয়ার বাঙালি সমাজের যে কোন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলেই সস্ত্রীক সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেন এবং শেষ পর্য্যন্ত মনোযোগ সহকারে অনুষ্ঠানগুলি দেখতেন। নজরুল ইসলাম প্রতি বছর সন্ত্রীক দেশে আসতেন নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে। সর্বশেষ এসেছেন ২০১৯ সালে। দেশে এসে দু’এক মাস করে থাকতেন-নানাস্থানে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন বন্ধু বৎসল নজরুল ভাই। প্রতিবারই দেশে পাবনা শহরে এসে আমার ও আমার সহধর্মিনী পূরবীর সাথে সাক্ষাত ও গল্পগুজব করতেন। অস্ট্রেলিয়াতে হোক বা বাংলাদেশেই হোক-যখন যেখানেই যেতেন, তাঁর অসুস্থ স্ত্রী ইয়াসমিন ভাবীকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কোথাও কদাপি একা যেতে তাঁকে দেখিনি।

তাঁর আহারাদি ছিল অত্যন্ত বিজ্ঞান সম্মত। বাড়ীর বাইরে কোথাও গেলে সাধারণত: ফল-মূল খেতেন। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন খাবার কখনও তাঁকে খেতে দেখিনি।
অষ্ট্রেলিয়াতে প্রথম দু’দফায় গিয়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই যেতে হতো তাঁর বাসায়। সন্ধ্যাথেকে রাত ১০টা পর্য্যন্ত চলতো দেশের সাম্প্রতিক বিষয় এবং অন্যান্য সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা। এতে যোগ দিতে সেখানকার চিন্তাশীল বাঙালি অধ্যাপক, সাংবাদিক ও সমাজকর্মীরা। চমৎকার আলাপ-আলোচনা তর্ক-বিতর্ক চলতো বিভিন্ন বিষয়ে। ভিন্নমত শ্রদ্ধার সাথে সভা শেষে সবাই মিলে রাতের খাবার খেয়ে নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরতেন। আমাকে তো নজরুল ভাই সন্ধ্যায় নিয়ে যেতেন ও রাত্রিতে তাঁর গাড়ি করেই রেখে যেতেন। আবার ছেলে প্রবীরের বাসায় বেশ কিছুকাল চলার পর ঐ চমৎকার প্রোগ্রামও কিছু লোকের উৎসাহের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তবে নজরুল ভাই যেমন ছিলেন তার্কিক-তেমনই মিষ্টভাষী।
নোবেল জয়ী ড. ইউনুসের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। তিনি সিডনী গেলে তাঁর সম্মানে একটি বিশাল সভার আয়োজন করেন তিনি। নজরুল ভাই ঐ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বলে শুনেছি। তাঁর উপর গ্রামীন সাপোর্ট গ্রুপের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। ঐ গ্রুপের সহায়তায় তিনি সেখানকার বাঙালিদের কিছু কিছু করে টাকা দিতে উদ্বুদ্ধ করতেন। এভাবে অর্জিত টাকা দেখে ঐ সংস্থার কাছে পাঠাতেন গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার জন্য মাসিক ভাতা হিসেবে। আমাকে একবার তিনি বলেন, গরীব মেধাবী ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে ঐ বৃত্তির জন্যে দরখাস্ত সংগ্রহ করতে। প্রথম বছর পাবনা মহিলা কলেজের দুটি ছাত্রীর দরখাস্ত পাঠালাম-ওরা মাসে ১,৫০০ টাকা করে বৃত্তি পেল। এভাবে প্রতি বছরই ৮/১০ জন করে ছাত্র-ছাত্রীর দরখাস্ত পাঠাতে শুরু করি। বছর তিনেক হলো তা আর পাঠাই না। ৫/৬ বছরে আমার মাধ্যমেই মোট প্রায় ৫০ জন গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী ঐ একই হারে বৃত্তি পেয়েছে। এর দ্বারা দেশের গরীবের প্রতি তাঁর টান কতটা তা উপলব্ধি করা যায়।

পোষাক-আশাকেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাদাশিধা। প্যান্ট ও খাটো একটা পাঞ্জাবি ছিল তাঁর সাধারণ পোষাক। শীতকালে কোথাও যেতে হলে সাধারণ স্যুট পরতেন। ঢোলা পাঞ্জাবির তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। বলতেন ঢোলা পাঞ্জাবী যাঁরা পরেন তাঁরা যে অপ্রয়োজনীয় বাড়তি কাপড় ব্যবহার করেন যা দিয়ে হয়তো একটি ছেলের হাফ শার্ট হতে পারে। সুতরাং ঢোলা পোষাক কারও পরা উচিত নয়।
তিনি কখনও কোথাওযেতে হলে নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছে যেতেন-দেরী করতে না এক মিনিটও। কঠোর সময়ানুবর্তিতা পালনের জন্য সিডনীতে তাঁর খুব নাম ছিল।
করোনাজনিত কারণে ২০২০ সালে তিনি দেশে আসেননি। আর আসবেনও না। একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষকে হারালাম। ৮২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়-এ কারণে তাঁর মৃত্যুকে অকালমৃত্যু বলা যাবে না। তবে যেহেতু তিনি সুস্থ, সবল ও কর্মঠ ছিলেন-তাই তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যু অত্যন্ত বেদনা দায়ক।
ইয়াসমিন ভাবী একা হয়ে গেলেন। সন্তানেরা তাঁর দেখাশুনা ও পরিচর্য্যা করবে-এই ভরসা।
নজরুল ভাইকে জানাই শেষ শ্রদ্ধা।

রণেশ মৈত্র
কলামিস্ট, রাজনীতিবীদ
একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।
পাবনা, বাংলাদেশ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments