
আতিকুর রহমান শুভ: ১৪ মার্চ ২০২০ এর দিনটিতে সিডনি স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তখনও অতিমারি কোভিড-১৯ সেভাবে আক্রমণ করেনি। তবে অস্ট্রেলিয়া সব প্রস্তুতি গ্রহণ করে ফেলেছে। ১৪ মার্চের এক সপ্তাহ পর থেকেই সব ধরণের অনুষ্ঠানের নিষেধাজ্ঞা জারি ছিলো। ততোদিনে সিডনিসহ পুরো দেশে বেশ ক’টি বৈশাখী মেলা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওপার বাংলা থেকে আসছেন দুই বাংলার কিংবদন্তী জনপ্রিয় শিল্পী অঞ্জন দত্ত এবং তাঁর ছেলে হালের জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী নীল দত্ত। সেটাও দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছে। অনুষ্ঠান হবে কি হবেনা..করে হয়তো অনেক দর্শক আসবেনা। সেই শঙ্কা থেকেই অনুষ্ঠান আয়োজকদের একজন তানিম মান্নানকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন মঞ্চ রেডি, অঞ্জন দা ও তাঁর ছেলে চলে এসেছেন, আপনারাও চলে আসুন।
পকেটে ছোট্ট একটি হ্যান্ড স্যানিটাইজার গুঁজে ঢুকে গেলাম। নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটি’র বৃহৎ সায়েন্স থিয়েটার অডিটোরিয়াম সেদিন কানায় কানায় ভর্তি না হলেও ৮০ ভাগ সঙ্গীতানুরাগী এসেছিলেন। বাকী ২০ ভাগ টিকেট কেটেও আসেনি সদ্য ভীতিগ্রস্ত করোনা সংক্রমণের ভয়ে। ৮০ ভাগ এসেছেন, ভেবেছেন, কোন ভাবেই অঞ্জন দত্তের মতো লিজেন্ডকে মিস করা ঠিক হবেনা।

হিরোদের মতো মাথায় হ্যাট, চোখে রঙিন সানগ্লাস পরে চিরাচরিত স্টাইলে মঞ্চে অঞ্জন দত্ত। এক কোনায় ভদ্র ছেলের মতো চুপচাপ গীটার বাজিয়ে যাচ্ছেন ছেলে নীল দত্ত। অঞ্জন দত্ত একে একে গেয়ে ফেললেন- তাঁর জনপ্রিয় সব গান। রঞ্জনা আমি আর আসবনা; পার্ক স্ট্রিট,; স্যামসান; মালা; আমি বৃষ্টির ছবি এঁকেছি; তুমি আসবে বলে তাই। তারপর অঞ্জন একটু থামলেন। বাংলাদেশের প্রয়াত কিংবদন্তী শিল্পী ও সুরকার লাকী আখন্দকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বললেন, “ আমি এখন একটা গান গাইছি একজন বিশেষ মানুষকে নিয়ে। সেই মানুষটির দেশ থেকে এখানে অনেক মানুষ এসেছেন। অনেক দিন গাইনি গানটা, কারণ গানটা গাইলেই আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই গানটার পেঁছনে একটা গল্প আছে। আমি যখন প্রথম বাংলাদেশে যাই গান করতে। সেটি ছিলো ঢাকার যাদুঘর মিলনায়তনে। আমার অনেক বন্ধু যেমন মাকসুদ সহ অনেক মিউজিশিয়ান এসেছেন। উদ্যোক্তাদের একজন বললেন, এখানে এসেছেন খুব গুণী একজন মিউজিশিয়ান। এখন আর তেমন গান করেন না। কারণ তাঁর ভাই হ্যাপি মারা গেছেন। সকলের অনুরোধে সেদিন লাকী আমার সাথে বাজিয়েছিলেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত আমার কোন গান তিনি শোনেননি। সেদিন থেকেই লাকী আমার বন্ধু। বেঁচে থাকা অব্দি অনেক কথা হয়েছে তাঁর সাথে। লাকী আমাকে খুব কাছে টেনেছিলো, আমিও লাকীকে। মাঝে মাঝে অনেক রাতে হুটহাট ফোন করে বসতো। অথচ ক্যান্সারের চিকিৎসার সময় কলকাতা এলে আমি ওর রুগ্ন মুখ দেখতে যাইনি, আমি পারিনি।” লাকীকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় কয়েকবার মাথা নোয়ালেন অঞ্জন। তারপর সেই গানটি নিবেদন করলেন, “দু’জনেই থাকে দুটো দেশে, দু’জনেই গান বেঁচে খায়…একজন যদি হয় অঞ্জন আরেকজন লাকী আখন্দ।” সেসময়ে সিডনির দর্শকেরা দাঁড়িয়ে এবং মুহুর্মুহ করতালি দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রয়াত কিংবদন্তী শিল্পী লাকীকে।
ভিডিওতে দেখুন লাকী আখন্দকে স্মরণের মুহূর্ত, নীল দত্ত এবং অঞ্জনের গানের কিছু অংশ।
স্যামসান গানটি গাইবার সময় অঞ্জন দত্ত বললেন, শুধু কলকাতার পার্ক স্ট্রিটেই একসময় ৬৫২ জন এন্টারটেইনার ছিলো। এখন তার অর্ধেক শিল্পীই চলে গেছে বিদেশ। এই অস্ট্রেলিয়ায় এসেছে প্রায় একশ জন। মালা, হরিপদ কেরানী, রঞ্জনা বা বেলা বোস যখন যে গান ধরছেন তখনই দর্শক তাঁর সাথে গলা মিলিয়েছেন। আর এমনই তো হওয়ার কথা। ওপারের বা এপারের যে বাংলার কথাই ধরুন না কেনো সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন, কুমার বিশ্বজিৎ কিংবা লাকী আখন্দের গানগুলোই তো আমরা বুঁদ হয়ে শুনতাম।
অঞ্জন দত্ত কেবল একজন মিউজিশিয়ান নন। তিনি অভিনয় করেছেন ওপার বাংলার বিখ্যাত সব নির্মাতার নির্দেশনায়। নিজেও ছবি বানিয়ে চলেছেন। তিনি যে একজন তুখোর অভিনেতা তার প্রমান পাওয়া গেলো মঞ্চে। গানের তালে তালে কখনও হ্যাট পরছেন, আবার কখনও সেটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে চোখে রঙিন চশমা লাগাচ্ছেন। ছেলে নীল দত্ত যখন গান করছেন তখন তিনি সারা মঞ্চ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনও নত হয়ে দর্শকদের সাথে অভিনয় করে চলেছেন। আসলে এসব পাগলামীর সবই তিনি ডিজার্ভ করেন। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের পাদদেশে যে ছেলেটি জন্মগ্রহণ করেছেন-তার ক্যারিয়ারের পরিভ্রমণ তো কম হলোনা। সুতরাং একজন অঞ্জন সব পারেন। তিনি হাসতে হাসতে কাঁদতে পারেন আবার গাইতে গাইতে হাসতে পারেন।

অঞ্জন দত্তের সিডনি কনসার্টটি তাই নানাদিকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। সেই রাতটি পোহালেই তারা প্লেন ধরতে এয়ারপোর্টে চলে গেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়- ‘ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠতে হবে, এই বয়সে এটা সয়?’ তাই কোনরকম সেলফি বা অটোগ্রাফের সুযোগ না দিয়েই শেষ গানটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব বাদ্যযন্ত্র গুছিয়ে ফেললেন। সিডনি বাসী মনে রাখবে তাঁর জাদুময়ী স্টাইল সাথে পুত্র নীল দত্ত, বন্ধু অমিত দত্ত এবং আরও দুই শিল্পী দেবপ্রতিম এবং প্রশান্তের মুগ্ধকর পরিবেশনা।
অশেষ ধন্যবাদ বেঙ্গলী সিনে ক্লাব অস্ট্রেলিয়া এবং তাদের কাণ্ডারী বাসব রায়, তানিম মান্নান, সৈকত মণ্ডল এবং প্রসেনজিৎ রায় সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জীবন্ত কিংবদন্তী অঞ্জন দত্তকে প্রশান্ত মহাসাগরের এই পাড়ে নিয়ে আসার জন্য। তাঁর রেখে যাওয়া সেদিনের সুরের মুগ্ধতার রেশ থাকবে বহুকাল।
আলোকচিত্র: সরকার কবিরউদ্দিন।