একটি শব্দ গত কয়েক সপ্তাহে অনেকবার শুনেছি। ছোট্ট একটি বাংলা শব্দ। শব্দের মধ্যে একটি আলোর ঝলকানি লুকিয়ে আছে। এই ছোট্ট শব্দটি কাউকে উৎসাহিত করতে পারে। খুলে দিতে পারে নতুন জানালা। আবার এই একই শব্দ ভুল ভাবে ব্যবহার করে ভেঙ্গে দিতে পারে অনেকের স্বপ্ন।
‘মেধাবী’ হচ্ছে সেই ছোট্ট একটি শব্দ – যার ভিতরে লুকিয়ে আছে অসম্ভবকে জয় করার শক্তি। আবরার হত্যার পর পত্রিকা, টকশো, ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে শুরু করে মানুষের সাধারণ কথা বার্তায় এই শব্দটি প্রচুর ব্যবহার করা হয়েছে। সবাই যেন একই বই থেকে পড়ছিল, ‘বুয়েটের ছেলে মেয়েরা সবচেয়ে মেধাবী, দেশের ক্রিম ছেলেমেয়েরাই কেবল বুয়েট বা মেডিক্যালে পড়তে পারে … ইত্যাদি ইত্যাদি’। তার অর্থ কি এই যে যারা বুয়েট বা মেডিক্যালে পড়ে না তারা মেধাবী নয়?
আমাদের দেশে সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছিলাম যে ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারলে জীবন বৃথা। ভাল চাকরি পাওয়া যাবে না, ভাল বিয়ে হবে না, এবং বাবা-মায়ের সোসাইটিতে মুখ থাকবে না। সেই কারণেই আমাদের বাবা-মায়েদের ভিতর একটি অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। যে ভাবেই হোক আমার সন্তানকে ডাক্তার নতুবা ইঞ্জিনিয়ার বানাতে হবে। আর এই কারণেই ছেলে-মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও বাবা-মায়ের আকুতি, মিনতি বা জেদের কাছে তাদের হার মানতে হয়। স্কুলের বাইরেও সকল কিছু বাদ দিয়ে টেবিলে বসে থাকতে হয়। বাবা-মা কে আশ্বস্ত করতে হয়, ‘হ্যাঁ আমি পড়ছি’।
মেধা কি? ঐ বইয়ের অঙ্কগুলো শেষ করা? কিংবা অন্যের লেখা একটি রচনা মুখস্থ করে পরীক্ষায় টুকে দেয়া? মেধা কি দিয়ে মাপা যায়? স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট? নাকি এইচ এস সি’র রেজাল্ট? এই সব পরীক্ষায় আমি সবার চেয়ে বেশী নম্বর পেলাম, বুয়েট কিংবা মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পেলাম আর ‘মেধাবী’ হয়ে গেলাম? আর বাকি ছাত্ররা যারা বুয়েট বা মেডিক্যালে আমার পাশে বসতে পারল না তারা ‘মেধাহীন’? এই যে কেবল ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার দিয়ে আমরা মেধাবী এবং মেধাহীন নামের দুটি গ্রুপ করলাম – এর ভয়াবহতা বুঝতে পারছেন? আমরা কি অবলীলায় এই বিশাল সংখ্যার ছাত্রছাত্রীদের ‘মেধাহীন ছাত্রছাত্রীর’ সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছি। মনের গভীরে কেউ কেউ হয়তো বিশ্বাস করা শুরু করবে, ‘আমি মেধাবী নই। আমাকে দিয়ে কোন ভাল কাজ হবে না’। যে ছেলেমেয়েগুলো এখনো চলা শুরু করেনি, তাদের ভিতর এমন একটি ‘বিষাক্ত’ ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া কতখানি মানবিক?
ভাবুন তো এই পৃথিবীর সবাই ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার হোল। তাহলে পৃথিবীর রং কেমন হতো? পৃথিবীতে যদি কেবল গোলাপ ফুল ফুটতো – তাহলে কি পৃথিবীটা এতো সুন্দর লাগতো? এই যে আমরা হুমায়ুন আহমেদের গল্প পড়ি, আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনি, কামরুল হাসানের ছবি দেখি, ফারুকীর সিনেমা দেখি এই মানুষগুলো কি মেধাবী? কিন্তু আমি তো জানি এরা কেউ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার নয়। এমন কোটি কোটি মানুষের লিস্টি তৈরি করা যায় – যারা আমাদের মেধাবী মাপার ফিতায় আটকাবে না। কারণ উনারা এতো মেধাবী যা মাপার জন্য অতো বড় ফিতা আমাদের কাছে নেই। মেধাবী কেবল পড়াশুনা দিয়ে হয় না। যে মানুষটি কখনো স্কুলে যায়নি – সেও ভীষণ মেধাবী হতে পারে । আরজ আলী মাতব্বরের কথা ভাবুন। উনি কোন ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যাল কলেজে পড়েছেন?
প্রতিটি মানুষ অসম্ভব শক্তি আর সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়। এটাই তার মেধা। এই মানুষটির দরকার একটি পরিবেশ যেখানে সে নিজেকে আবিষ্কার করবে। নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা শক্তি আর গুনগুলোর সাথে বন্ধুত্ব করবে। আর একদিন জ্বলে উঠবে আপন মহিমায়। ওদেরকে মেধাহীন বলে সার্টিফিকেট দেয়া আমাদের কাজ নয়। আমার চোখে এটা অপরাধ।
পৃথিবীটি ভারী সুন্দর কারণ আমরা সবাই ভিন্ন। আমাদের ভিন্নতা দিয়ে এই চারিপাশ আরও অনেক সুন্দর করা যায়। আপনি কি করবেন? সিদ্ধান্তটি আপনার।
জন মার্টিন : অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক, মনোবিজ্ঞানী সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।