বড় বোন ও ভাইয়ের পর তৃতীয় সন্তান হিসেবে আমার পৃথিবীতে আগমন।
যৌথ পরিবার। দাদা দাদি, মা বাবা, চাচা চাচী এবং বড় ফুপুকে নিয়ে। আর্থিক স্বচ্ছলতা পৈত্রিক সূত্রেই পাওয়া। নেই অভাব, অভিযোগ।আদি বাড়ি ময়মনসিংহ শহরের অদূরে হলেও। আমাদের বেড়ে উঠা ময়মনসিংহেই কলেজ রোডের বেশ বড় একটা বাড়িতে।
দাদীও এসেছেন এক খানদানী পরিবার বলতে যা বুঝায় তেমন পরিবার থেকে। দাদার বেঁচে থাকা এবং না থাকা দুই সময়েই দাদীর একচ্ছত্র আধিপত্য এ সংসারে। পরিবারের প্রায় সকল বিষয়ে তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, বাকি সবাইকে তা অম্লান বদনে মেনে নিতে হয়। এটাই নিয়ম এবং এই নিয়ম নিয়ে চাপা কোন অসন্তোষেও ভোগা বারণ।
মা আর চাচিকেও পুত্রবধু হিসেবে তিনিই বেঁছে, পছন্দ করে নিয়ে এসেছেন এই সংসারে। দাদীর নানান আদেশ উপদেশের মাঝে বিশেষ করে এই পরিবারে সন্তান জন্ম নেয়ার পুরো সময়টাতে মা চাচিদের একটা বিশেষ নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অনাগত সন্তানের গায়ের উজ্জ্বল রঙ থেকে শুরু করে শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে একটু বেশীই উদগ্রীব থাকেন এবং রাখেন তিনি। কী পরিমানে দুধ, ফলের রস বা অন্য খাবার খেতে হবে, দাদীর দেয়া সেই রুটিন মা চাচীদের প্রতিটা সন্তান জন্মদানের পুরো সময়টিতেই মানতে হয়েছে।
দাদীর নিজেরও অতীব দুধে আলতা বলতে যা বুঝায় তেমনই গায়ের রঙ, লাল টুকটুকে ঠোঁট নিয়ে তিনি যতোটা না গর্বিত তার কোন নাতি বা নাতনী যেন পারিবারিক এই ঐতিহ্যের বাইরে না যেতে পারেন তার জন্যে ততোটাই সচেষ্ট।
আমার বড় বোনের মুখ দেখেই দাদী নাম দিলেন রানী। রাজরানী হয়েই নাকি বড় হয়েছে বড় আপা। আমার বড় ভাই এসে দাদীর আরো পোয়া বারো হলো, যেন এক রাজপুত্তুর, দাদীই নাম দিলেন ’মহারাজ’।
আমার পরিবারের এইরকম দুই রূপকথার জীবন্ত চরিত্রের পাশাপাশি চাচার ঘর জুড়ে এলো লায়লী আপা ও বাদশা। আমার আগমন বাদশার কিছু সময় আগে। আমার সেই গ্রেট দাদী আম্মা, এই পৃথিবীর বুকে আমার অস্তিত্ব ঘোষণা করা মাত্রই তিনি নাকি আমার কিঞ্চিৎ গোলাপী গাত্র বরন দেখে ঘোষণা দিলেন এ আমাদের ’সুবর্ণা’!
কিন্তু দাদীর এবারের হিসেব এবং মনোঃবাসনা দুটোই মাঠে মারা গেলো। সময়ের সাথে সাথে সবাই দেখলো আমি আমার মা বা দাদীর গায়ের রঙ না পেয়ে হয়ে গেছি তাদের মন খারাপ করা এক কালো কন্যা শিশু। গল্প উপন্যাসের ‘কালো মাইয়ার’ মাঝে কিছু না কিছু শ্যামবর্ণের ভালোলাগা থাকে। আমার তেমন কিছুও কৈশোর পর্যন্ত দেখা গেলোনা!
বড় হতে থাকলাম এবং বুঝে গেলাম এই পুরো পরিবারে আমার আকার আকৃতি গায়ের রঙ নিয়ে সবাই একটু বেশীই বিব্রত। আমি বুঝে গেলাম দাদী আমাকে যত যত্ন নিয়েই চুলে বিলি কেটে তেল দিয়ে দিক আমাকে ঘিরে তাঁর মাঝে আছে এক সীমাহীন দীর্ঘশ্বাস!
আমি এক কালো মেয়ে।

মা শুধু হাইস্কুলে উঠার পর, প্রায়ই খুব নীরবে বলার চেষ্টা করতেন, মুখে একটু কাঁচা হলুদ আর ডাল বাটাটা যেন প্রতিদিন নিয়ম করে লাগাই। যেভাবে আমার চাচাতো বোন লাইলী তার অতি হলুদে গায়ের রঙ প্রতিদিন আরো হলদে করার চেষ্টায় নিমঘ্ন।
বাবা কাছে নিয়ে যখন আদর করেন তখন তাঁর চোখেও একটা অন্যরকম মায়া খুব লক্ষ্য করতাম। উনার চোখ যেন বলতো আহারে আমার মেয়েটা সব রেখে কেন যে আমারই মতন হতে গেল দেখতে!!
বাবার মায়া, মায়ের একটা অপরাধবোধ, ভাই বোনেদের কারো কারো কিছুটা বিব্রত, দাদীর নানান খবরদারী এবং অনেকের করুনা সব নিয়েই ছিল আমার শৈশব, কৈশোর।
আমাকে ঘিরে বাড়ির সবার এমন দৃষ্টি বা দৃষ্টিভঙ্গী বা আমার হীনমন্যতা, যাই হোক, আমি যখন বাড়ী পার হয়ে স্কুলের রাস্তা ধরে হেঁটে যেতাম নিজের অজান্তেই মাথাটা একটু বেশী গুঁজে হাঁটতাম। চোখ একটু বেশীই মাটির দিকে থাকতো আমার সব সময়।
এবং এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই আমি একদিন আয়নার মুখোমুখি হয়ে দেখি কেমন কুঁজো হয়ে গেছি! টান টান হয়ে দাঁড়াতেই পাচ্ছিনা আর!
বাড়ি বা স্কুল কোথাও আমার খুব কাছের কোন বন্ধু হলোনা। কেউ ভালো করে কথা বলতে এলেই মনে হতো আমায় করুনা করছে তাই নিজেও ভুলে গেলাম স্বাভাবিক কথা বলতে।
সেইবার পাড়ায় বছরের প্রথম দিন দুষ্টু ছেলের দল সব মেয়েদের খেতাব দিলো… আমি পেলাম – কালায় কালায় ব্যাশ কম আছে তোমার কালায় চিলিক মারে… এমন নোংরা জঘন্য কিছু।
আমি স্নানের ঘরে বাষ্পে ভিজে উথাল পাতাল কান্না করলাম সেদিন দুপুর পেরিয়ে বিকেল পর্যন্ত। সন্ধায় ছাদের এক কিনারায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখি, বাতাস মাখি আর ভেতরের একা আমির সাথে কথা বলি, তোমাকে আরো গুটিয়ে চলা শিখতে হবে মেয়ে। এই পৃথিবী তোমার নয়…
এবং নিজেকে সবার কাছ থেকে অন্য রকমের এই দুঃখী আমিটাকে লুকাতে সাথী করলাম ‘বই এবং বইয়ের মাঝে’! গল্পের নানান চরিত্রের সাথে মিলেমিশে একটু একটু করে গড়ে তুললাম যেন আমার পৃথিবী, গোপন এবং আপাত সুখী একান্ত এক পৃথিবী।
আহ কে জানতো শুধু এই বই আমাকে একদিন এই রকম ভালোবাসাময় কাংখিত পৃথিবী গড়তে সাহায্য করবে।
পরিবারের মিশ্র আবেগ অনুভব পেয়ে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। আমার বড় বোন নিখুঁত রুপে গুনে, স্কুল পেরিয়ে কলেজে যেতেই একের পর এক বিবাহের সম্বন্ধ এবং দাদী প্রায় সন্ধায়ই বাবা চাচার সাথে বসছেন আপার বিয়েটা কত ভালো সুপাত্র এবং উচ্চবংশীয় ছেলে হয় তা দফারফা করতে।
আপার কলেজ পাশ দিতে না দিতেই এক শীতে শহরে যেয়ে বিএ ক্লাসে ভর্তি প্রক্রিয়ায় ইস্তফা দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবার প্রস্তুতি নিয়েই নিতে হল। আমাদের বাড়িতে আমার দেখা প্রথম কোন আয়োজন।
আমি ওভাবে সাজগোজ করিনা তারপরও হলুদ, বিয়ে, বউভাতে লাইলী আপার পরামর্শে অনেকটা বাধ্য হয়ে শাড়ী এবং মাথায় ফুল টুল গুজলাম।
আপার বিয়ের পর সব ছবি ওয়াশ হলো। সেই ছবি আমি এ্যালবামে সাজালাম। দুই একটা গ্রুপ ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস লুকালাম। সবার মাঝখানে বেশীর ভাগ ছবিতেই আমাকে যেন ম্লান লাগছে।
বউ ভাতের পর আপা দুলাভাই বেড়াতে আসার পর এক সন্ধ্যায় সবাই আমাদের ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রের তীরে বেড়াতে গেলাম। পার্কে বসে বাদাম খেতে খেতে তুমুল আড্ডা, আপার কজন বান্ধবী, লাইলী আপা, ওর বান্ধবী, আমি বাদশা, দুলাভাইয়ের বোন, ভাই সব মিলে বিশাল এক গ্রুপ।
সেই আলাপেই, বিয়েতে কাকে কেমন লেগেছে, কেউ কারো প্রেমে পরেছে কিনা এমন বিষয়ও উঠে এলো। আমি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলিনা। এই আড্ডায়ও না। নীরব এক হাসি ঝুলিয়ে অন্যেরা কে কি বলছে তাতেই থাকি মেতে।
আমি দেখতে চোখে পরার মতো নই, তারপর প্রয়োজন ছাড়া কথা বলিনা বললেই চলে। স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন উত্তর পর্বে কেউ আমাকে যুক্ত করেনি।
দুলাভাইয়ের সাথে এর মাঝেই টুকটাক কথা হয়েছে। তার নামটা যেমন আমার পছন্দ হয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্বও আমাকে রীতিমত মুগ্ধ করেছে। আপা আসলেই যে রাজরাণী হয়ে থাকবে আমি যেন অনেকটাই বুঝতে পারি।
ভাইয়াও যেন আমার চোখ, চলা, বলা দেখেই বুঝে যায় আমার গুটিয়ে চলা জীবনের অনেকটা। সেই সন্ধ্যার আড্ডায় অন্য কেউ জিজ্ঞেস না করলেও ভাইয়া বলে কী গো, স্বপ্নকন্যা, সুবর্ণা আছে নাকি মনের মানুষ!
আমি সারাক্ষণ বই পড়ি, একটা স্বপ্নের জগতে বাস করি এইসব বোধ হয় আপা কিছুটা শেয়ার করে ফেলেছে। দুলাভাই সেই জেনেই দিয়েছে এই নামকরণ। আমি শুধু নীরব হাসি,
নেই আমার জন্যে কোথাও কেউ নেই, আমিও নেই কারো জন্যে।
দারুন এক সন্ধ্যে কাটলো। সার্কিট হাউসের বিশাল মাঠ ধরে হাঁটি আমরা। হাসি গল্পে মেতে ছোট এই কোলাহল যাত্রা।
আমাদের বাসার পাশেই থাকে এক মা-মেয়ে। মেয়েটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, রোকেয়া হলে থাকে, নাসরীন আপা, আমার খুব প্রিয়। একটু সিনিয়র হয়েও সে আমার বন্ধু যেন, আমার অনেক না বলা কথা সেই পড়তে পারে। ছুটিতে এলে প্রায় বিকেলেই আমরা এক সাথে হাঁটতাম। ছাঁদে উঠে সন্ধ্যে দেখতাম।
আপা ভাইয়াকে নিয়ে সেদিনের সান্ধ্য আড্ডাটা হয় খুব জমজমাট। নাসরীন আপা গলা ছেঁড়ে গান ধরে ‘’আবার এলো যে সন্ধ্যা’’ আপার সাথে বেসুরো গলায় সামিল হয় লাইলী আপা ও অন্যরাও।
আপা দুলাভাই একজন আরেকজনের হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকে। কী ভালো লাগে আমার।
বাদশা ওর বন্ধুদের কজনকে পেয়ে হয় দলছুট।
আর সবার মাঝে থেকেও আমি একা, কেন যেন হঠাৎ কান্না পেতে থাকে আমার।
সেবা প্রকাশনীর একটা ক্লাসিকে নায়ক পাইন বন কুয়াশা এমন কিছু পেরিয়ে এসে প্রথম নায়িকার হাত ধরে, সেই দৃশ্যটা এসে বুকে ঘাই মেরে যায় কেন যেন।
কারণ বড় আপা বা অন্য কেউ জানেনা, স্কুলের পরীক্ষা দিয়ে ছুটিতে ঢাকায় ফুপুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার ফুপাত বোনেদের সাথে অন্য রকম কিছু সময় কাটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ফুপাতো ভাই, যে আমার সাথে কথা বলতো মেপে মেপে, আমাকে দুই একটা পড়ালেখা বিষয় ছাড়া আর কিছু জিজ্ঞেসই করতোনা।
সেই ভাইয়ের সাথে তখন রাত জেগে ওয়ার্ল্ডকাপ দেখি, সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, অনুবাদ, হুমায়ুন, নাসরীন জাহান সহ অনেকের প্রচুর লেখা পড়েছি আমি, শুনে দুই একটা আলাপ আগায়। আমাকে আরো কিছু বই পড়তে বলেন। কিছু সংগ্রহ করে দেন পড়বার জন্যে।
সেইবার ফেরার পর থেকেই বুঝি আমার মাঝে আমি নেই অন্য কে এক কথা কয়। এই অনুভুতি আমার চেনা না। ভাইয়াকে মনে পড়লেই কী ভীষণ এক চাপা কষ্ট, অস্থিরতা, অন্যরকম এক বুঁদ বুঁদ হৃদয়ে। কিন্তু আমি জানিনা সে আমায় আদৌ পছন্দ করে কিনা।
বড় আপার বিয়েতেই ফুপু পরিবার যখন এলো, আমার কী তুমুল অপেক্ষা, দেখা হবে অনেকদিনের পরে। কিন্তু সবাই আসার পর, ফুপাতো বোনের কাছে শুনি ভাইয়া নাকি কারো প্রেমে পড়েছে তারই বান্ধবী, ভীষণ ভালো এবং আরো অনেক বর্ণনা, আমি আর কিছু শুনতে পাইনা।
কিন্তু প্রথম এই ভালো লাগা এবং সেই স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্টে আমি হয়েছি বিবর্ণ, আমার নাম সুবর্ণা হলেও জীবন হয়ে গেল বর্ণহীন। হঠাৎই।
আমার জীবনে আর সবমিলে ভালোলাগা আসেনি, ভালোবাসা বা প্রেম সংক্রান্ত বিষয়টা পুরো চেপে গেলাম। দেখতে ভালো নই বলেই পরিবারের অন্য মেয়েদের জীবন যেমন হয়, আমার সেটা হয়নি, হয়েছে, শাপে বর। আমি কতোটা ভালো করলাম পড়ালেখায় বা আর কী কী করলাম, বাবা ছাড়া আর কেউ ওভাবে ঘাটাতোই না। বরঞ্চ নিজের চলা ফেরায় নিষেধাজ্ঞা বেশ কমই পেলাম স্কুল কলেজ পার হতে।
মা এই সংসারের এক নীরব সদস্য। দাদী, বাবা চাচা যা বলেন তাতেই সায় দেয়া বা না দেয়া কোন কিছুতেই নেই ‘রা’। ভাই একদম নিজের মত, আপাদমস্তক এক নিজের সুখে নিমজ্জিত থাকা মানুষ। আমাকে তাঁর দুই একটা কাজকর্ম করার দরকার ছাড়া মাঝে মাঝে শুধুই , কী রে পড়ালেখা ঠিক ঠাক হচ্ছে তো এই প্রশ্ন ছাড়া আর তেমন কোন ভুমিকা আমার জীবনে নাই বললেই চলে।
সেই আমিও শুধু পড়ালেখা নিয়েই মেতে থেকেছি, দেশের সেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সুযোগটা পেয়েছি এবং প্রথম ভালো লাগা, প্রেমটা ভেঙ্গে যাওয়ার শোককে নিজের অজান্তেই শক্তিতেই পরিণত করেছি।
বিশেষ কেউ আমাকে ভালোবাসবে, আমি শুধু তার হবো এমন ভাবনা কোন না কোনভাবে অল্প সময়ের জন্যে ভুল করে মাথায় এলে বলেছি… না। এই ভাবনাটাকে দাও নির্বাসন। ডূবে গেছি আবার পড়ার জগতে।
এক ছুটিতে বাড়ী গেছি, আমার সেই প্রতাপশালী দাদী অনেকটাই নির্জীব হয়ে গেছেন, আগের সেই বাজখাঁই গলা নেই, মা এবং চাচী দুজনই তাঁর আজ সবচেয়ে বড় সঙ্গী, কাজের মানুষ থাকলেও তাঁরাই রেখেছেন আগলে এবং দাদী বিশেষ করে ঘুম ছাড়া পুরো সময়টাই চান মা থাকবেন তাঁর পাশে।
আমি আগের মত গুটিয়ে থাকলেও ভেতর থেকে অনেকটাই এখন ধীর স্থির এবং হলের রুমমেট আপু এবং দুই একজন বন্ধু বলে, আমি নাকি স্নিগ্ধ, শান্ত গভীর এক নদীর মত।
আমি আর দাদীকে ওভাবে ভয় পাইনা। তাঁর ভেতর লালন করা সংস্কার, কুসংস্কার সেই নিয়ে আমার এখন নিজস্ব ব্যাখ্যা হয়েছে তাই ওগুলো নিয়েও মাথা ঘামাইনা। তবে ভালো যে বাসি দূরে গিয়েই বুঝতে পারি। আমার গায়ের রঙ বা দেখতে ভালো নই বলে যে চাপ আমায় সে দিয়েছে সেটাও আজ নেই। আমার ভেতরের একটু পড়ালেখা করা যে সুবর্ণা, সেই সুবর্ণাকে দাদী নিজের অজান্তেই সমঝে চলেন, বুঝার চেষ্টা করেন।
দাদীর বিছানার পাশে বসি। ভীষণ পরিচ্ছন্ন চারদিক। বরাবরই টিপটপ থাকা আমার দাদী আজ প্রায় জীবন সায়াহ্নে।
হঠাৎই জিজ্ঞেস করি আচ্ছা দাদী তুমি তো আমার গায়ের রঙ নিয়ে সারা জীবন খুব অসুখী ছিলে, তাইনা?
তুমি যে খুব ছোটবেলায়, তোমার কাছে ঘুমাতে এলে গল্পের মাঝে বলতে, রাজকুমার রাজকুমারীকে কইলো, আমি তুমারে ভালা ফাই, তুমি কি আমারে ভালা ফাও? আচ্ছা তোমার কী মনে হয়, কোন রাজপুত্তুর আমারে কোনদিন এসে বলবে এমন!
মজা করি।
দাদি হাসেন কেমন যেন অপরাধীর হাসি, কিন্তু চোখে পানি, কী কী যেন বিড়বিড় করেন। শুধু শুনতে পাই, তুই অনেক অনেক দূরে যাবি রে বর্ণা, আমার সব নাতী নাতনী তো সুখের সংসারই করলো, লায়লাটা দেখ কী সুন্দর কিন্তু আল্লাহর কী লীলা খেলা প্রথম সংসারটা ভেঙ্গে গেল… যদিও পরের বিয়েটা যে এত ভালো হবে বুঝি নাই। আমি কী এমুন ভাবছি কুনুদিন। কিন্তু কী ভালো জামাই ফাইলো, ওরে মাথায় করে রাখে রে! নিজের প্রথম বউটা অকালে মারা গেল কিন্তু সেই বউরেও নাকি খুব ভালা বাসতো।
আমি বলি হ দাদি, ভদ্র লোক যারা, তাঁরা এমনই হয়।
তুই এত এত পাশ দিলি, কোন দিন কোন খারাপ কিছু করিস নাই, এই সংসারের এমন কিছু নাই যেখানে তোর যত্নের ছাপ পড়েনাই। তোর বাপ তোরে কী ভালা বাসে রে বর্ণা। তুই অনেক বড় হবি, দাদী আমার চুলে হাত বুলান, ইস কী যে সুন্দর তোর চুল… কী মায়া একটা মুখ রে বর্ণা তোর। তুই আমার সবচে সুন্দর নাতনী রে।
আমি এবার প্রাণ খুলে হাসি, বুকের মাঝে কী এক তোলপাড় বোঝা না বোঝা। এই কী আমার অর্জন?
জানিনা।
আমার চুলে দাদীর যত্নের ছোঁয়া লম্বা সময় ধরে পেয়েছি। তাঁর যত্নেই হোক বা প্রকৃতির দান, আমার চুল নিয়ে দাদীর উচ্ছ্বাসটা উপভোগই করি।
তারপরও বলি, দাদী এত্ত সুন্দর সুন্দর কইরো না তো, (আমার চুলের সৌন্দর্য একটু বেশীই সে আমি জানি, তবে এটা মাথায় রাখিনা)
দাদীকে বরং খেপিয়ে দেই মজা করে, এই চুল দিয়ে কিছুই হয়না গো দাদী, সইল্লের রঙডাই সব জীবনে, যৌবনে।
দাদী কপট রাগ দেখিয়ে হাসেন, আমাকে মারবেন বলে হুমকীও দেন!
অনার্সে যথারীতি ভালো করলাম, সবাই জানতো এটাই আমার কাছে কাম্য। সেরাদের সেরা আমি।
মাস্টার্স পরীক্ষায় পেলাম রেকর্ড নাম্বার।
রেজাল্ট নিয়ে ময়মনসিংহ যাচ্ছি ট্রেনে। এই প্রথম এত ভালোলাগা, বুকের মাঝে শিহরণ কারণ বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখা আরো একটা স্বপ্ন পূরণের খুব কাছে আমি।
বড় আপা সংসার অন্ত এক মানুষ, ঢাকাতেই বাস। সে তার স্বামী সন্তান নিয়ে যার পর নাই ব্যস্ত এবং সুখী। তার কাছে রেজাল্ট নিয়ে গিয়েছি দেখা করতে আমাকে ভালো মন্দ খেতে দিয়েছে , নিজের যেন যত্ন নেই, আরো বেশী দুধ ডিম খাই টাকা দিয়েছে কিন্তু পড়া নিয়ে স্বপ্নটা তাকে বলা হয়নি বা যায়নি, বলেছি দুলাভাইকে।
এবং যে উৎসাহটুকু আর তেমন করে কেউ দেয়নি সেই ভাইয়াই আমাকে দিয়েছে। বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে পাশ করেছো এত ভালো রেজাল্ট নিয়ে, চাকরী পেতে সমস্যা হবেনা তোমার আশা করি। তারপরও আমি আছি স্বপ্ন বালিকা, এনি হেল্প শুধু জানাবে।
সেই থেকেই দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছেটা বুকের মাঝে সুখের এক রিনিক ঝিনিক ক্লাসিক্যাল কনসার্ট হয়ে উদ্দাম করছে।
রেজাল্ট নিয়ে ময়মনসিংহ ফিরে দাদীকে আর পাইনি, কী অদৃশ্য টানে আমি যে সকালে ঢাকা থেকে ট্রেনে এদিকে আসছি, দাদী তখন রওনা দিয়ে দিয়েছে অনন্ত পথ যাত্রায়…
এমন শোকের বাড়িতে আর আমার মাস্টার্সের রেজাল্ট সেলেব্রেট করা গেলোনা।
দুই সপ্তাহ পর ফিরে গেলাম ঢাকা। হল ছেড়ে এবার নীলক্ষেতে এক বাসায় হলের এক বড় আপার সাথে উঠে এলাম সাবলেটে। কাজ পেয়েছি নামকরা একটা প্রতিষ্ঠানে এবং এই কাজটা করার মাঝেই দুলাভাইয়ের হেল্প নিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পড়তে যাবার জন্যে এপ্লাই করি।
IELTS এবং অনার্স, মাস্টার্স রেজাল্ট সবমিলে আমি আশায় বাঁধি বুক।
নাহ এই স্বপ্নটা আর প্রথম প্রেমের মত ভেস্তে যায়না…
মহাখালি অফিস শেষে বাসে ফার্মগেটে নামি। রিকশায় বাসায় ফিরতে ফিরতেই হঠাৎ ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস, বৃষ্টি আসি আসি।
রিকশাচালক মাঝবয়েসি মামা বলেন,
আফা টিপ মাইরা বহাইন, দিনের ডাহাডাহি দেখছুইন, ভিইজ্যা যাইবাইন, পর্দা দেয়াম?
বুঝতে পারি ময়মনসিংহ…
আমি হাসি, না গো মামা এই বিষ্টি টিস্টি কুনু বিষয় না আইজ আমার সেইরম মন ভালা, ভিজবাম, গান গাইবাম… মামা পেছন ফেরে হাসে, আইচ্ছা তাইলে তো ভালাই!!
অফিসে ইমেইল চেক করেই পেয়েছি কাঙ্ক্ষিত সেই নিউজ। অফার লেটার তো আগেই এসেছে, প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র জমা দিয়েছি, প্রী-ভিসা এবং কনফার্মেশন অব এনরলমেন্টটাও আজ চলে এসেছে। ওটা পাসপোর্টসহ গুলশান VFS অফিসে জমা দিয়ে ভিসা নিতে হবে। আজ এপ্রিলের ২৭, পৌঁছাতে হবে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মাঝে।
এই ক’মাস পর আমি বুঝি অন্য রকম এক পৃথিবী পাবো! আমার মন কেমন করে।
খুব ভালো লাগছে, আবার লাগছেনা… এত এত আনন্দময় ঘটনা, সাফল্য কিন্তু হঠাৎ কেন সেই স্বপ্ন ভঙ্গ ফিরে ফিরে আসে। এই আজ কেন যেন খুব করে কারো হাত ধরে রিকশায় করে ঘুরে ঘুরে শুনাতে এবং শুনতে ইচ্ছে করছে জীবনের এই যে রঙ্গিন দিন, এই মুহূর্তটুকু।
নীলক্ষেতে নেমে একটা ফোনের দোকানে ঢুঁকে বাসায় ফোন দেই। বাবাই ধরেন। আমি হ্যালো বলে আর কিছু বলতে পারিনা… কেন যেন গলা ধরে আসে। কান্না আসে, সুখের, পাওয়ার আবার হারানোর সব মিলেই… আব্বা হ্যালো মা, মা হ্যালো বলতে থাকেন, আমি নিজেকে সামলে কোনভাবে বলি, কেমন আছেন আপনি, আম্মা, চাচা, চাচী ভালো আছেন?
আব্বা মা মা ই শুধু বলেন, আমি কেন যেন বলতে যেয়েও বলতে পারিনা যা বলতে চেয়েছিলাম। কোনভাবে শুধু বলি, আগামী বৃহস্পতিবার আসছি আব্বা।
বলতে পারিনা তোমাদের সবাইকে ছেড়ে প্রশান্ত মহাসাগর পার হয়ে অস্ট্রেলিয়া উড়াল দেবো, সাময়িক উড়াল, আমি যে স্বপ্ন হারিয়ে ভেতরে এক এলোমেলো হয়েছিলাম সেই আমিই ফিরব সেই স্বপ্নভঙ্গকে চিরদিনের মত সাগর মহাসাগরে ভাসিয়ে নিশ্চয়ই ফিরবো নুতন পৃথিবী নিয়ে। ততদিন পর্যন্ত তোমরা সবাই ভালো থেকো বাবা, তোমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসি আমি, খুব। আজ কেন যেন খুব করে সেটা অনুভব করছি।
বৃষ্টি একটু একটু করে নেমেই আসে এবং বাড়তে থাকে। বাসার পথে হাঁটছি আমি চোখ ভিজছে কিন্তু কেউ দেখতে পারছেনা, মজার এই খেলাটা উপভোগ করে করে ফিরছি আমি।
নাদেরা সুলতানা নদী
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।