বেঁচে থাকলে আজ ৬৬ বছরে পা দিতেন কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা, সঙ্গীতশিল্পী ও শব্দ সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা লাকী আখন্দ। ১৯৫৬ সালের এই দিনে অর্থাৎ ৭ জুন ঢাকার পাতলা খান লেন এলাকায় লাকী আখন্দের জন্ম। তাঁর গানে হাতেখড়ি হয় বাবার কাছে। পাকিস্তান আমলে তিনি টেলিভিশন এবং রেডিওতে শিশু শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তিনি এইচএমভি ভারতের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নিজের নাম অন্তর্ভূক্ত করেন।

লাকী আখন্দের সুরারোপিত গানের সংখ্যা দেড় হাজারের মতো। তিনি কাজ করেছেন কম কিন্তু তাঁর সৃষ্টিগুলো ছিল কালজয়ী। প্রতিভাবানদের ক্ষেত্রে মনে হয় এমনই হয়ে থাকে। কারণ ভালো কাজের পরিমাপ সংখ্যায় নয়, হয় গুণে। একটি বিরল ব্যাপার হচ্ছে লাকী আখন্দ তাঁর সৃষ্টি দিয়ে সেই সত্তরের দশক থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজন্মের সংগীতপ্রেমীদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছেন- যা খুব কম শিল্পীই পেরেছেন। আজ একুশ শতকের প্রান্তে এসেও তাঁর গানের জনপ্রিয়তায় একবিন্দু ভাটা পড়েনি।
লাকী আখন্দের প্রথম সলো অ্যালবাম ‘লাকী আখন্দ’ প্রকাশিত হয়১৯৮৪ সালে। দীর্ঘ সংগীত জীবনে লাকী কখনো নিজের কন্ঠে, কখনো সুর দিয়ে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। নিজের গাওয়া গানগুলোর মধ্যে উল্লেখ করা যায় ‘এই নীল মনিহার’, ‘আবার এলো যেসন্ধ্যা’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘মামনিয়া’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘হৃদয় আমার’ ইত্যাদি।
আজকের অনেক বিখ্যাত শিল্পীর ক্যারিয়ারের অন্যতম হিট গানের সুরকার হলেন তিনি। যেমন যেখানে সীমান্ত তোমার’ (কুমার বিশ্বজিৎ), ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’ (সামিনা চৌধুরী), ‘আগে যদি জানিতাম (ফেরদৌস ওয়াহিদ), লিখতে পারি না কোনো গান (জেমস)’।
১৯৮৭ সালে লাকী আখন্দের ছোট ভাই হ্যাপীর আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। হ্যাপীর মৃত্যুর পর তিনি হঠাৎ করে সঙ্গীতচর্চা বন্ধ করে দেন। ওই সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। মৃত্যুর পর হ্যাপীকে শেষ বোরের মতো দেখতে গিয়েছিলাম। লাকী ভাইয়ের শোকবিহ্বল মুখ এখনো আমার স্মৃতিতে ভাসে। প্রায় এক যুগ পরে ১৯৯৮ সালে ‘পরিচয় কবে হবে’ ও ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ অ্যালবামের সঙ্গীতায়োজনের মাধ্যমে আবারও তিনি গানের ভুবনে ফিরে আসেন।
লাকী আখন্দ একজন মিউজিক জিনিয়াস। সত্যি বলতে কি বাংলা আধুনিক গানের পট পরিবর্তন হয় লাকি আখন্দের করা ‘এই নীল মনিহার’ গানটি দিয়ে। সত্তরের দশকে পপ ও ব্যান্ড সংগীতে মেলোডির সূচনা করে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে লাকী আখন্দের ব্যতিক্রমী সুর অনুপ্রেরণার বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছে। সুরকার হিসেবে লাকী আখন্দের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুমুখিতা। সফ্ট মেলোডি, রক, সেমি-ক্যাসিকাল, আধ্যাত্মিক, চলচ্চিত্র যে-কোনো ধারার গান তাঁর সুরের ছোঁয়ায় অতুলনীয় হয়ে উঠত। নিয়াজ মহাম্মদ চৌধুরীর কণ্ঠে ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’ গানটি হলো তাঁর অসাধারণ সৃজনশীলতার একটি আভাস মাত্র।
সোলসের জন্য আমার লেখা ‘মুখরিত জীবন’ এবং কুমার বিশ্বজিতের কণ্ঠে ‘ তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’— এই গান দু’টো সত্তরের দশকের শেষের দিকে প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। ওই সময় লাকী ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ঢাকার এক কনসার্টে। এর দীর্ঘ তিন যুগ পর আমার প্রথম অডিও অ্যালবাম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লাকী ভাইয়ের কাছে আবার ফিরে আসি। আমার অ্যালবামে লাকী ভাইয়ের সুরের ম্যাজিক থাকবে না তা কি হয়?
আমার আ্যালবামের কাজ করার সময় লাকী ভাইয়ের বাসায় ২০১৫ সালের জুনের এক সন্ধ্যায় ঢাকার রাস্তার জ্যাম ঠেলে হাজির হলাম লাকী ভাইয়ের আর্মানিটোলার ফ্ল্যাটে। তিনি বিল্ডিংয়ের তিন তলায় থাকতেন। সযত্নে চা-বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। অতঃপর তাঁর মিউজিক রুমে নিয়ে গেলেন। ঘরের এককোণায় স্তূপীকৃত পুরনো মিউজিক্যাল ইন্সটুমেন্টস। পাশেই টেবিলে রয়েছে কীবোর্ড ও ল্যাপটপ। প্রিয় কীবোর্ড থেকে কাপড় সরিয়ে নিয়ে আমাকে বেশ ক’টা নতুন কম্পোজিশন শোনালেন। আমার অ্যালবামের জন্য দু’টো গান দিলেন- ‘মিথ্যে অভিমানে’ আর অ্যালবামের শিরোনাম সংগীত ‘তোমার জন্য’। মিথ্যে অভিমানে গানটির সুর করার পর গভীর রাতে তিনি আমাকে টেলিফোন করে বললেন, মামুন তোমার গান রেডি। টেলিফোনেই শোনালেন সুর। লাকী আখন্দ হলেন একজন পারফেকশনিষ্ট। সুরকাররা গানের ডামি ভার্সান নিয়ে ততটা সময় ব্যয় করেন না। কিন্তু লাকী আখন্দ হলেন এর ব্যতিক্রম।

সেবার অনেক কথাই হলো লাকী ভাইয়ের সঙ্গে। বেশ হাসিখুশি ছিলেন, ঘন ঘন সিগারেট ফুঁকছিলেন। মন খুলে বললেন অনেক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা। দিলেন অনেক অজানা তথ্য। তিনি বললেন, ভারতের প্রখ্যাত সুরকার বাপ্পী লাহিড়ী তাঁকে মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য ডেকেছিলেন। কিন্তু তাঁর মুম্বাই যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। তখন কি জানতাম যে, এটাই হবে আমাদের শেষ দেখা? একজন অন্ধভক্ত হিসেবে আমি অনুযোগ করে বললাম,‘লাকী ভাই, বিধাতা আপনাকে যে অসামান্য মেধা দিয়েছেন তার প্রতি আপনি সুবিচার করেননি। আপনার কাছে আমাদের চাওয়া অনেক।’ লাকী ভাই মুচকি হেসে প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলেন। বিরল মেধাবীরা মনে হয় এমনি হয়।
লাকী আখন্দের গানগুলো অন্তর্জালে, ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করে আয় করছেন অনেকেই। কিন্তু তার সিকি ভাগও পাচ্ছেন না লাকী আখন্দ। উল্লেখ্য, লাকী আখন্দের সব জনপ্রিয় গানই মূলত নিজের জন্য করা । কিন্তু বিভিন্ন সময়ে শিল্পীরা তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে গানগুলো নিজেদের কণ্ঠে ধারণ করেছেন। পরে গানগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা পেলেও আর্থিক হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রে লাকী আখন্দ বরাবরই রয়ে গেছেন আড়ালে। অর্থের পেছনে তিনি কখনো ছোটেননি। তিনি ছুটতেননান্দনিক ও বৈচিত্র্যময় সুরের পেছনে।
একটি ওয়েবপেজ করে নিজের সুর করা গানগুলো আপলোড করার পরামর্শ দিলে তিনি খুব আগ্রহ দেখালেন। বললেন, ‘এ নিয়ে তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব।’ কিন্তু সেই কথা আর আমাকে বলা হয়নি তাঁর। এর ঠিক তিন মাস পর সেপ্টেম্বরে তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। মাত্র কিছুদিন আগে যে সুস্থ মানুষটাকে দেখে আসলাম, তাঁর ভেতরটা কর্কট ব্যাধির তীব্র কামড়ে এমন করে তছনছ হবে তা বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। ঘরের এক কোনে ছড়িয়ে থাকা পুরোনা বাদ্যযন্ত্র, আমার অ্যালবামের জন্য সুর করা লাকী ভাইয়ের গান দুটো হয়ত একক অ্যালবামের জন্য করা তাঁর সুরারোপিত শেষ গান। আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে, এই অ্যালবামের সুবাদে লাকী আখন্দের নামের সঙ্গে গায়ক হিসেবে আমার নামটাও জুড়ে থাকবে। আমার অ্যালবামের জন্য গীতিকার বাকিউল আলম বেশ কয়েকটা গান লিখে লাকী ভাইকে দেন। অনেকগুলো গানের মধ্যে ‘মিথ্যে অভিমানে’ গানটি তিনিই বেছে নেন যার কথা ছিল, ‘অভিমান ভাঙে যদি কখনো তোমার, পথ আর থাকবে কি ফিরে আসবার।’ কেন জানি আজ মনে হচ্ছে, এই গানের মধ্য দিয়ে আমাদের মাঝে ফিরে না আসবার কথাই তিনি হয়তো বলে গেছেন।
২০১৬ সালে ঢাকায় আমার অ্যালবাম প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অসুস্থতার কারণে ইচ্ছে থাকলেও তিনি আসতে পারেননি। ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর লাকী আখন্দের ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল পরপারে পাড়ি দিয়েছিলেন এ কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী। ‘আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না, ফেরারি পাখিরা কুলায় ফেরে না।’ তিনি যেন আমাদের সংগীত ভুবনে ফেরারি পাখি হয়ে এসেছিলেন ক্ষণিকের তরে। সংগীতের অমিয়ধারায় আমাদের সিক্ত করে আবার পাড়ি জমালেন অজানায়।
শুভ জন্মদিন লাকী আখন্দ।
আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আপনি হয়ত আর ফিরবেন না, কিন্তু আপনার কালজয়ী সুরের মূর্ছনায় আপনাকে খুঁজে পাবে সবাই নীলিমা থেকে অন্তরীক্ষে।
ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন: সিডনী প্রবাসী প্রকৌশলী, সঙ্গীত শিল্পী ও লেখক।