আতিকুর রহমান শুভ: অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায় নিজেকে অঙ্গনা আকাশ নামে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। তিনি কলকাতার মেয়ে। সকলে তাঁকে চেনেন রবীন্দ্রনাথের গানের শিল্পী হিসেবে। কিন্তু লোকগান, লালন, হাসন রাজা, রাধা রমনের, শাহ আব্দুল করিম বা ভাটির গানও তাঁর কন্ঠে সোনা ঝরায়। কন্ঠমাধুর্যের এমন জাদুকরী শিল্পীর দেখা খুব একটা মেলেনা। শ্রোতারা তাই তাঁকে ভালোবেসে আখ্যা দিয়েছেন ‘গানের পাখি’। করোনাকালীন গৃহবন্দী জীবনে দেশে ও বিদেশের লাইভ অনুষ্ঠানে সেই গানের পাখি যে সুর মুর্ছনা ছড়াচ্ছেন, তার ঢেউ এই দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়েও আছড়ে পড়েছে। আর সেই কারণেই তাঁকে আমরা ‘প্রশান্তিকা’র মায়াজালে বেঁধে ফেলেছি। ডিজিট্যালি কলকাতায় বসেই অঙ্গনা প্রশান্তিকাকে এই সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন।

প্রশান্তিকা: অঙ্গনা, আপনার নিজের কন্ঠের ওপর আত্মবিশ্বাস কতটুকু ? প্রশ্নটা এই কারণে করা- যার কন্ঠের মাদকতা এতো বেশি, সে কি নিজে জানে তাঁর কন্ঠ কেমন?
অঙ্গনা: আমার কন্ঠের ওপর আমার আত্মবিশ্বাস নেই কারণ তা ঈশ্বরের দান। কিন্তু গানের মধ্যে ডুবে যাওয়ার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে কারণ তাতে আমি কখনো কোনদিন কোন মুহূর্তেও ফাঁকি দিইনি- এমন বলতে পারি। এই সততার প্রতি আমার যাবতীয় আত্মবিশ্বাস রয়েছে।
প্রশান্তিকা: অঙ্গনা যখন কোন গান কন্ঠে ধারন করেন তখন কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দেন- বাণী না সুর এবং কেন?
অঙ্গনা: গানের বাণীর তুলনায় সুর আমায় বেশী টানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে বাণী আর সুর এমনভাবে জড়িত তাকে অবশ্য আলাদা করা শক্ত। তবে সুরে আমি বেশী ভেসে যাই এ কথা ঠিক। সুরে যেন আমি ভেসে বেড়াই।
প্রশান্তিকা: আপনাকে আমি রবীন্দ্রনাথের গানের শিল্পী জানতাম, কিন্তু এখন দেখছি পঞ্চকবির গান সহ লোকগানও করছেন, এই বহুমুখীতা কি শিল্পের জীবনে আপনার মূল আইডেন্টিটির ক্ষতি করছে না?
অঙ্গনা: আসলে গান তো গানই। গানের মধ্যে ভাগাভাগি থাকলে কি আর লালন এবং পাশ্চাত্যের প্রভাব পেতাম রবীন্দ্রসংগীতে? আগেই বলেছি সুর আমায় টানে। যে সুর টেনেছে সে গানই গেয়েছি। পঞ্চকবি হোক, লোকগান হোক আর রবীন্দ্রসংগীতই হোক। গান তো মনে, তাই মনের কথা শুনি। আমি যেমন, আমার আইডেন্টিটি সেরকমই হবে। তা নিয়ে আমার ভাবনা নেই বিশেষ। গানের প্রতি দায় আছে, আইডেন্টিটির প্রতি নয়।

প্রশান্তিকা: যদিও শ্রোতারা দেখছেন- আপনি যখন যে গান করছেন, মনে হচ্ছে আপনি ওটারই শিল্পী। এর পেঁছনে রহস্য কি? আপনি কি ক্লাসিকাল শিখেছিলেন? যে কারণে গলাটা সাধা এবং যে কারণে যে কোন গানই কন্ঠে তোলার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে?
অঙ্গনা: ক্লাসিকাল কোনকালেই শিখিনি। ভয় করত। তবে এখন অল্প ভালোবাসা জাগছে তাই শেখার পরিকল্পনা আছে।
যখন যে গান গাই সেই গানটার মধ্যেই বাস করি তাই হয়ত শ্রোতারা ভালোবেসে গ্রহণ করেন। আর সেই রহস্যের নাম ভালোবাসা।
প্রশান্তিকা: আপনার গানের হাতেখড়ি কিভাবে? আপনার গুরুদের কথা শুনতে চাইছি।
অঙ্গনা: ছোট্টবেলায় দাদা যখন গান শিখত মা আমাকে সেই ক্লাসে নিয়ে যেতেন কোলে কোলে। গান শুনতে শুনতে আমি সোফা থেকে নেমে যেতাম আর আপন মনে তাল দিতাম। সেই দেখে কিংবদন্তী শিল্পী পূরবী মুখোপাধ্যায় আমার মাকে বলেছিলেন আমাকে যেন গান নাচ কিছু একটা শেখানো হয়।
আমার আগ্রহ দেখে আমায় পূরবী দি’র কাছেই গানে ভর্তি করা হয় আমার ৯ বছর বয়সে। তারপর দীর্ঘ ১৭ বছর গান শিখি তাঁর কাছে।
অনেক ফাঁকি দিয়েছি। এখন বড়ো আফশোস হয়। মাঝে কিছুদিন বিরতি নিয়েছিলাম ব্যক্তিগত কারণে তখন আমার বন্ধু এখন যে স্বামী সে জোর করে যাওয়ার জন্য। আবার যেতে শুরু করি। নয়ত আফশোস আরও বাড়ত।
গুরুমাকে হারানোর পর কিছুদিন গান শিখেছিলাম অপালা বসু সেন ও স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তের কাছে। আর খুব সদ্য লোকগান শেখার সুযোগ হয়েছে শুভেন্দু মাইতির কাছে।

প্রশান্তিকা: করোনারালীন গৃহবন্দী জীবনে দেখেছি বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং প্রবাসের অসংখ্য প্লাটফর্মে আপনি আমন্ত্রিত হচ্ছেন এবং গান গাইছেন। পৃথিবী যখন সুস্থ ছিলো তখন কি আপনি বড় কোন প্লাটফর্মে গেয়েছেন?
অঙ্গনা: টেলিভিশনে এবং রেডিওতে নিয়মিত গেয়েছি। কলকাতায় রবীন্দ্রসদনে প্রত্যেক বছর কবিপক্ষে আমি গেয়ে থাকি।
এছাড়া ছোটবেলায় আমার বড় একটি স্মৃতির কথা বলছি। আমার বয়স ছিলো তখন মাত্র এগারো বছর। সেসময় নেহেরু ট্যালেন্ট সার্চ প্রতিযোগিতায় গান গেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করি। সেসময় দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে আমি পশ্চিমবঙ্গকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ লাভ করি।
প্রশান্তিকা: বাড়িতে গান চর্চা বা রেওয়াজের রীতিটি কেমন?
অঙ্গনা: আমার বাবা, দাদা দুজনেই খুব ভালো গাইতেন কিন্তু সেভাবে চর্চা কেউ করেননি। তবে আমার বিভিন্ন রকম গান শোনার অভ্যেস তৈরী হয়েছে দাদার সুবাদেই। আর বাবার থেকে পেয়েছি গানের বোধ। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় আমার মা আমায় নিয়ে যেতেন ছোট থেকে। কিন্তু প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরী হতে দেননি। এছাড়া আমার ঠাকুমা ছিলেন আমার পরম অনুপ্রেরণা।
প্রশান্তিকা: আপনার প্রোফাইল ঘেটে দেখলাম- পড়ালেখায় মস্ত পণ্ডিত আপনি। একদিকে সুরের মুকুট- গানচর্চা, অন্যদিকে জ্ঞানচর্চা- ক্যারিয়ার। ভবিষ্যত যাবে কোন দিকে?
অঙ্গনা: একটুও বিনয় না করেই বলছি পড়াশুনায় আমি খুব একটা আগ্রহী বা পারদর্শী নই। দর্শন আমার ভালোলাগার বিষয়। এটুকুই। ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাবে জানিনা তবে গানকে যে আরও আঁকড়ে ধরব তাতে কোন সন্দেহ নেই।
প্রশান্তিকা: আমরা সবাই আপনার গান ভালোবাসি। আপনি নিজে কার কার গান ভালোবাসেন, বাংলাদেশে প্রিয় শিল্পী কেউ থাকলেও বলবেন প্লিজ।
অঙ্গনা: বাংলাদেশের আনুশেহ আনাদিল, কৃঞ্চকলি ইসলাম আমার খুব প্রিয় শিল্পী। এছাড়া এপার বাংলার বহু শিল্পীর গানই আমার প্রিয়। তবে সেসব শিল্পীর মধ্যে যাদের বিনয় বেশি দেখি তাদের গান আরও ভালো লাগে। মনের সারল্য তো গানেই ধরা পড়ে!
প্রশান্তিকা: গান গাওয়া ছাড়া গান নিয়ে আর কি করছেন? কাউকে শেখাচ্ছেন?
অঙ্গনা: কোমলনিষাদ বলে আমার গানের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এর মাধ্যমে আমি বাংলাদেশ, ভারত ও প্রবাসে বসবাসকারী বাঙালিদের গান শেখাই। ভবিষ্যতে কোমলনিষাদকে নিয়ে আমার আরও বড় পরিকল্পনা আছে।
প্রশান্তিকা: রবীন্দ্রনাথের গানের কপিরাইট চলে যাবার পরে অনেকে নিজের মত গাইছেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
অঙ্গনা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একজন ‘Intellectual Giant’ যদি মনে করতেন যে গানগুলো আর একটু অন্যরকম করা দরকার উনি নিজেই করতেন। তিনি যখন করেননি তার মানে গানগুলোর দাবি তা নয়। যারা খোদার ওপর খোদকারি করছেন তারা তাদের প্রতিভা দিয়ে যদি নিজেরা নিজেদের গান তৈরি করেন আমরা আরো মৌলিক সৃষ্টি শুনতে পারবো। শুধু শুধু রবীন্দ্রনাথের ঐশ্বরিক সৃষ্টির ওপর তাদের এই আক্রমণ না হলেই সুখ পাই।
প্রশান্তিকা: এতো ব্যস্ততার মাঝে প্রশান্তিকাকে সময় দেবার জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ।
অঙ্গনা: আপনাকে এবং প্রশান্তিকার সকলকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। নমস্কার।