সুসন্তান গড়ার অঙ্গীকার, লক্ষ্য হোক সবার । পিয়ারা বেগম

  
    
পিয়ারা বেগম

আমরা জানি, পরিবার একটি মৌলিক সংগঠন। মূলত স্বামী-স্ত্রী দিয়ে শুরু হয় পরিবার এবং এটি ক্রমবর্ধমান। আর বংশবিস্তারের সূত্রপাত হয় দম্পতির সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে। তাই তো বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর আরাধ্য চাওয়া থাকে একটা ফুটফুটে সন্তান। মূলত একটা সুস্থ পরিবার মানেই আলোকিত সন্তান।
তবে, আমরা সৌভাগ্যবান বটে। কারণ, আবহমান বাঙালীর চিরায়ত ঐতিহ্য আমাদের পরিবার প্রথা এখনো টিকে আছে বিশ্বজনীন মায়া-মমতায়। তাই তো পরিবারই আমাদের ভরসাস্থল এবং অনুপ্রেরণার উৎস। মূলত মমতা আর ভালোবাসাই পারিবারিক শান্তির মূল। তাছাড়া আমাদের প্রচলিত সভ্যতায় মা-বাবার ভরণ-পোষণ ও লালন-পালনের দায়-দায়িত্ব সন্তানদের উপরই বর্তায়। এ কারণেই, সেটা মাথায় রাখেন এদেশের দায়িত্বশীল মা-বাবারা। আর নিজ নিজ সন্তানদেরকেও মানুষ করে গড়ে তোলেন সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে। ফলে পারিবারিক সুখ-শান্তির আবহে সহজে ব্যত্যয় ঘটে না।

আমরা তাও জানি, অধিকাংশ বিপথগামী সন্তানের জন্ম হয় একটা অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশ থেকে। এর জন্য আমাদের সুস্থ পরিবার ব্যবস্থাপনার উপর বিশেষ জোর দিতে হবে। সুতরাং আমাদের সবারই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, সন্তানকে সত্যিকার অর্থে মানুষ করে গড়ে তোলা। আসলে, শিশু-কিশোররা যদি নৈতিক ও ধর্মজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ পরিবার থেকে পায় তাহলে কমে যাবে তাদের পথভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। তাই তো পরিবার কেন্দ্রিক নৈতিক জীবনমুখী ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে শৈশব থেকেই গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক।
বর্তমানে পেরেন্টিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে, মা-বাবা যা বলেন সন্তানরা তা করে না। বরং মা-বাবাকে সন্তানরা যা করতে দেখে, তা-ই তারা করেন। সুতরাং মা-বাবাকে যদি নৈতিক ও মানবিক কায়দায় অভ্যস্ত হতে দেখেন তবে সন্তানরাও সে আদলেই গড়ে ওঠবে। মা-বাবাকে যদি বয়োজ্যেষ্ঠদেরকে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করতে দেখেন তবে সন্তানরাও বৃদ্ধ বয়সে তাদের পিতা-মাতাকে যথার্থ মর্যাদা দেবেন। কারণ, কৃতজ্ঞ সন্তান চাইলে পিতা-মাতাকেই কৃতজ্ঞ হবার শিক্ষা দিতে হবে। কাউকে ত্যাগ শেখাতে গেলে যে, আগে নিজেকে ত্যাগ করতে হবে। আসলে, মানবিকতার ঔদার্য, ধন্যবাদের ঔদার্য, কৃতজ্ঞতাবোধের ঔদার্য হলো শিক্ষা সাপেক্ষ। কৃতজ্ঞতা মূলত একটা সামাজিক আবেগ, শিষ্টাচার। এটি গোলাপের মতো, তাই তাকে যত্ন করতে হয়, রক্ষা করতে হয়। তাই আমাদের  বুঝতে হবে, সন্তান সম্পত্তি নয়, সন্তান আমাদের অমূল্য সম্পদ। তাই সন্তানকে গড়ে তুলতে হবে সম্পদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। তবে সন্তানও বৃদ্ধ বয়সে আপনাকে পরিবারের অংশ হিসেবেই দেখবে।

সুপ্রিয় পাঠক, তাই শৈশব থেকেই সন্তানকে সঠিক জীবনদৃষ্টি ও সুনির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য দিন। একটা সুন্দর স্বপ্ন দিন। আর তা তাদের প্রাণে গেঁথে দিন। সন্তান আসলে কী চায় এই চাওয়াটাকেও সংজ্ঞায়িত করুন, জানুন। এই শুদ্ধ চাওয়াটাই তার ভেতর থেকে তাড়না সৃষ্টি করবে। নিজ থেকেই সে লক্ষ্য পূরণে উদ্বুদ্ধ হবে। পড়াশোনায় নিরলস নিবেদিত হবে।
তবে এমন লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে হলে সন্তানকে পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু করে গড়ে তুলতে হবে। সূরা বালাদ এর আয়াত ৪ এ আল্লাহপাক বলেন, “আমি মানুষকে কষ্ট ও পরিশ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করেছি”। অর্থাৎ কষ্ট সহ্য করার শক্তি ও প্রয়োজনীয় গুণ এবং যোগ্যতা দিয়েই আল্লাহ মানুষকে তৈরি করেছেন। তাই সন্তানকে আরাম আয়েশে ননীর পুতুলের মতো না রেখে বয়স অনুসারে তাকে কাজ দিন এবং তাকে পরিবারের অংশ করে গড়ে তুলুন। এ বিষয়ে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ এম আর খান স্যার বলেছেন, “একটি বা দু’টি সন্তানকে ননীর পুতুলের মতো সারাক্ষণ আগলে রেখে ফার্মের মুরগি বানাচ্ছেন আজকালকার মা-বাবারা। এটা না করে সন্তানকে স্বনির্ভর ও শারীরিক শ্রমে অভ্যস্ত করে তুলুন।”
উপরন্তু, সন্তানকে পরিমিতিবোধের শিক্ষা দিতে হবে। পরিমিতি মানে জীবনে সব কিছুরই প্রয়োজন আছে কিন্তু নিজের সীমাটা বুঝতে হবে। অর্থাৎ আমাদের মৌলিক প্রয়োজনটুকু যা তা পেয়ে তৃপ্ত হওয়ার অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। এই যে আমরা এর অতিরিক্ত যা করছি, সেগুলো সব মূলত সভ্যতার নামে অনুকরণ করছি। এটা আসলেই নিজেদের মধ্যে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আর লেখাপড়ার ব্যাপারেও আমরা এমনই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নিজেরা প্রাণান্তকর দৌড়ঝাঁপ করছি। কারণ, সন্তানদের কেবল ভালো রেজাল্ট করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। সন্তানরাও তাই করছে। এতে করে সন্তানরা কখনো প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠছে না। সুতরাং আমাদের মনে রাখা উচিত, ভালো রেজাল্ট করাটা যেমন জরুরী ভালো মানুষ হওয়াটা আরো বেশি জরুরী।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে,এখন অনেকক্ষেত্রে সন্তানদেরকে উৎসাহিত করা হচ্ছে ভোক্তা হতে, মানুষ হতে নয়। পরিবার, সমাজ থেকে পায় না তেমন মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও। অধিকাংশ অভিভাবকের একটাই চাওয়া, ভালো রেজাল্ট করো। আর তাদের অবচেতন আকাঙ্ক্ষাও থাকে তাদের সন্তানরা পড়াশুনা শেষ করে দু’হাতে কাড়িকাড়ি টাকা রোজগার করুক। খুব কম মা-বাবাই এখন চিন্তা করেন যে, তাদের সন্তানেরা মানুষের মতো মানুষ হোক, আলোকিত মানুষ। তাই তো আমাদের দেশে দিন দিন মানুষ বেড়েছে কিন্তু সৎ মানুষ বাড়ে নি। শিক্ষিতের হার বেড়েছে কিন্তু সুশিক্ষিতের সংখ্যা বাড়েনি।

সত্যিকার অর্থে আমাদের সবারই ইতিবাচক  প্রত্যাশা হওয়া উচিত। সন্তানরা বেড়ে উঠুক প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে, অপার কৌতূহল নিয়ে। তা ছাড়া ধর্মের নৈতিক শিক্ষাগুলো সে আয়ত্ত করতে শিখুক। যেমন, যা মানুষকে ভালোবাসতে বলে, নিজের সদগুণগুলোকে বিকশিত করতে বলে। অন্যের কল্যাণ করতে বলে, অন্যায় থেকে বিরত থাকতে বলে। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তারা আয়ত্ত করুক, আত্মস্থ করুক। তাছাড়া মানুষ, প্রকৃতি, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদিকে ভালোবেসে তারা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক। আর সন্তানরা পড়াশুনাটা করুক ভালোবেসে, নিজের আগ্রহে। তবেই তারা জ্ঞান চর্চার মধ্যে যে এক পরম রস, আত্মপ্রসাদ আছে, তা অনুধাবন করতে পারবে। আর জ্ঞানচর্চা যে একটা সেরা বিনোদন, এটাও তারা উপলব্ধি করতে পারবে।

এখন সারা বিশ্বজুড়ে  ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি ও পণ্যদাসত্বের জয়জয়কার। ফলে বিনোদনের অর্থই আজ বদলে গেছে। এখন বিনোদন মানে প্রযুক্তিপণ্যের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার । যা আসলে কোন সুস্থ চর্চা নয়। আমাদের শিশু,কিশোর এবং তরুণরা লাগামহীন অসুস্থ বিনোদনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে তারা মনোদৈহিকভাবে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতা ও হিংস্রতা। মূলত কিছু সহজলভ্য বিনোদন যেমন মোবাইল, ফেসবুক, ইন্টারনেট, ভিডিও গেইমস আসক্তিতে রূপ নিয়েছে যা মাদকাসক্তির চেয়েও ভয়ংকর। তাই শিশু-কিশোরদের দুরন্ত, প্রাণ-প্রাচুর্যময় মধুর শৈশবকে আনন্দমুখর করে তুলতে হবে। শিশুদের অতিরিক্ত প্রযুক্তি নির্ভরতা কমাতে হবে। তাই পারিবারিকভাবে অন্তত বছরে একবার ঐতিহাসিক কোন দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যাওয়া উচিত। কিংবা প্রাকৃতিক পরিবেশে বনভোজনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। পারিবারিক পর্যায়ে ছোটোখাটো খেলাধুলা যেমন- দাবা, লুডু বাচ্চাদের নিয়ে নিজেরাও খেলতে পারেন। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে, প্রতিযোগিতায় অধিক হারে অংশগ্রহণের জন্য  উৎসাহিত করা যেতে পারে। যেমন, খেলাধূলা, নাচগান, আবৃত্তি, কৌতুক, বক্তৃতা এবং বিতর্ক। এতে তারা সংস্কৃতিমনস্ক হয়ে গড়ে ওঠবে। ফলে তারা সৃজনশীল ভাবনায় ব্যস্ত থাকবে। এতে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি পণ্যের প্রতি আসক্তি কমে আসবে।

আরো কিছু কথা, সম্প্রতি চারদিকে মাদকের ছড়াছড়ি। নীরব ঘাতক মাদক এখন আপনার সন্তানের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। যে কোনো সময় আপনার আদুরে সন্তানটি মরণ নেশা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই সন্তান কখন, কোথায় যায়, কার সাথে মেশে খেয়াল রাখুন। রাতে কখন বাসায় ফেরে বা ঘুমের ট্যাবলেট কিংবা আসক্তি সৃষ্টিকারী কোনো কিছু গ্রহণ করে কিনা খোঁজখবর রাখুন।
তাই বলছি, পরিবার তথা পরিবেশ হচ্ছে শিশুর প্রথম শিক্ষক। একজন শিশুর বেড়ে ওঠার উপর নির্ভর করে সে সুসন্তান হবে না কুসন্তান হবে। তাই প্রকৃত ভালোবাসা দিয়ে সন্তানদেরকে আগলে রাখুন। সন্তানের বন্ধু হোন। সন্তানের মাথার ওপর আপনার মমতার হাত রাখুন। এতে কোন অপশক্তিই আপনার সন্তানকে বিপথগামী করতে পারবে না। কারণ, ভালোবাসার ঘাটতি হলে শিশুরা বহিঃর্মুখী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেক কর্মজীবী মায়েরা বলেন — অফিস, সংসার সামলাতে হিমসিম খাচ্ছি। গৃহিণী মায়েরা বলেন – রান্নাবান্না, সন্তানের স্কুল, কোচিং, ক্লাস পরীক্ষা, বিদ্যুৎ,গ্যাস বিল বড্ড ঝামেলা, পেরে উঠছি না। তাদেরকে বিনয়ের সাথে বলছি- “যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে”। তাই বলছি, সন্তানদের জন্যই তো এত কিছু করছেন। সন্তান যদি সুসন্তান হয় তবে এর চেয়ে উত্তম বিনিয়োগ আর নেই। এ সন্তানই আপনার জন্যে এনে দিতে পারে সুনাম, যশ-খ্যাতি, সুখ-সমৃদ্ধি, শান্তি-প্রশান্তি সবকিছু। উল্লেখ্য যে, সুসন্তান গড়ার লক্ষ্যে মা-বাবা দু’জনেই সন্তানকে সমভাবে ভালোবাসায় সিক্ত করতে হবে।

পরিশেষে বলব, আমাদের দেশে চমকপ্রদ, লোভনীয়, আকর্ষণীয় ও চটকদার বিজ্ঞাপনের বদৌলতে গুঁড়োদুধ বিক্রির যে প্রচার-প্রচারণা চলছে। তারপরেও কিন্তু বলা হয়, “মাতৃদুগ্ধ তুলনাহীন”। সুতরাং সুসন্তান হিসাবে গড়ে তুলতে হলে প্রকৃত অর্থে সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলুন। তাই মাতৃদুগ্ধের মতো বলবো শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কেবলই শিক্ষা, শিক্ষা আর শিক্ষা। শিক্ষা তুলনাহীন। শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানী করে তোলে, বিনয়ী হতে শেখায়।  মূলত জ্ঞানী, বিনয়ী মানুষ মানেই মাটিছোঁয়া মানুষ। আসলে, আমাদের সমাজে এখন আকাশছোঁয়া লোকের সংখ্যাই বেশি হয়ে গেছে, মাটিছোঁয়া লোকের সংখ্যা কম। সত্যি বলতে কী,এ পৃথিবীতে লোকসংখ্যা অ-নে-ক কিন্তু ‘মানুষ’ এর সংখ্যা কম।
আসুন, এখন থেকে সুসন্তান গড়ার লক্ষ্যে আমরা অঙ্গিকারবদ্ধ হই। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে মাটিছোঁয়া মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিই। তাহলে আর লোকসংখ্যা বৃদ্ধি নয়, আসুন, সমাজে ‘মানুষ’ এর সংখ্যা বাড়াই।

পিয়ারা বেগম
কবি, কথাসাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক
নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, বাংলাদেশ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments