( শেষ পর্ব )
শিল্পে সেপ্টেম্বর ইলেভেনের প্রভাব:
শিল্প, ইতিহাস ও রাজনীতি এই তিনটি বিষয়েই মূলত আমার প্রবল আগ্রহ। বলা বাহুল্য এই তিনটি বিষয় একে অন্যের অনেকটাই পরিপূরক, একটি দেশ বা সমাজের সবচেয়ে নিরেট প্রতিচ্ছবিটা পাওয়া যাবে মূলত এই তিনটি নিয়ামকের চর্চার ওপর। সেপ্টেম্বর ইলেভেনের ঘটনায় পৃথিবীর অনেক অনেক বিষয়ের মতোই শিল্পচর্চাতে পড়েছে এর প্রচ্ছন্ন প্রভাব, যেমনটা গ্রেট ওয়ার বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সৃষ্টি হয়েছিল এভান্ট গার্ড অনেকটা সেরকম। একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে তাই, এই প্রভাবটা আমি নিজে যেমন প্রত্যক্ষ করেছি তেমনি প্রভাবিতও হয়েছি। ৯/১১ পরে এই ঘটনাটি কেমন করে একটা বিরাট অংশের শিল্পীর শিল্প চিন্তায় কি প্রভাব ফেললো ও কেন প্রভাব ফেললো তাই আমি প্রবন্ধের এই অংশে আলোচনা করার চেষ্টা করবো এবং পাঠককে একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো।
প্রথমেই আসি এই ৯/১১ চলচ্চিত্র বা মুভিং ইমেজে কি প্রভাব ফেলেছিলো বা কতটা প্রভাবিত হয়েছিল। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদে ও সামরিকায়নে চলচ্চিত্র ও মিডিয়া সবসময়ই একটি বড় ভূমিকা রেখে এসেছে। মাল্টি বিলিয়ন ডলারের হলিউড মুভি ইন্ডাস্ট্রি এ জন্যই গড়ে উঠেছে, যা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের এক চমৎকার মিশ্রণ। ৯/১১ পরে তাই স্বাভাবিক কারণেই আমরা জিহাদি, আমেরিকায় সন্ত্রাসী আক্রমণ, আমেরিকার নিরাপত্তা এই বিষয়গুলোকে মূল উপজীব্য করে সিনেমা, নাটক ও সিরিয়াল বানাতে দেখি। এই নির্মাণগুলোর মূল উদ্দেশই ছিল আফগান বা ইরাক আক্রমণের ঘটনাকে ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতিষ্ঠা দেয়া। এই সিনেমা বা নাটকগুলোর আরো একটু জনপ্রিয় বিষয় ছিল মুসলিম নারী। যেখানে মূলত একটাই বার্তা দেয়া হয় তা হতো, মুসলিম নারীর জীবন আসলে অভিশাপমণ্ডিত এবং একজন সাদা লোক (ককেশিয়ান) দেবদূতের মতো এসে অভিসম্পাদময় জীবন থেকে ওই বাদামি (নন হোয়াইট) রঙের মুসলিম নারীকে বাঁচিয়েছেন। অধ্যাপিকা লায়লা আহমেদ তার Treacherous Sympathy with Muslim Women প্রকাশনায় উল্লেখ করেছেন এভাবে, পশ্চিমা নাটক চলচ্চিত্র ও পলিটিক্স সবকিছুতেই ইসলামী নারীর পোষাক ও জীবন হঠাৎ করেই প্রধান আলোচনা ও বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো ৯/১১ পরে, আগে যা মূলত আমাদের মুসলিম নারীবাদীদের সংগ্রামের বিষয় ছিল! হলিউডের জনপ্রিয় কিছু সিরিজ যেমন এনসিআইএস বা হোমল্যান্ড এই প্রোপাগান্ডাগুলো অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ছড়িয়েছে।
৯/১১ এর পর শিল্প জগৎ সিজোফ্রেনিক নিরাপত্তাহীনতায় প্রবেশ করেছে। সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখের ঘটনা সিনেমায় নতুন যুগের সূচনা করেছে। চলচ্চিত্রগুলি সন্ত্রাসী হামলার প্রতি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, অজানা সন্ত্রাসীদের ভয় এবং ভবিষ্যতের হামলা সম্পর্কে বিভ্রান্তি। এই তীব্র সম্মিলিত আবেগ দ্বারা অনেক ঘরানার চলচ্চিত্রগুলি অতিরঞ্জিত হয়ে ওঠে। 9/11-এর পরের বিষয়বস্তু, শৈলী এবং মেজাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিল রয়েছে এবং এটাকে মূলত ৯/১১ উত্তর সিনেমার ধারা বলা চলে। উদাহরণস্বরূপ, সায়েন্স ফিকশন তার নাটকীয় আবেদনের জন্য অস্বাভাবিকতা এবং তীব্র ভয়ের উপর নির্ভর করে সৃষ্টি করা। ভয়াবহ ফিল্মগুলি প্রতিপক্ষ, নির্যাতন এবং নির্লজ্জ বা ঘৃণ্য সেটিংসের মাধ্যমে বিদ্রোহ এবং ঘৃণার উপর নির্ভর করে। মেলোড্রামাস অযৌক্তিক দুর্ভাগ্য এবং সন্ত্রাসী কার্য নির্ভর করে। যুদ্ধের ন্যায্যতা দেখানোর জন্য একটি দেশ, সংস্থা বা অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষোভ প্রকাশ করে।
ভিজ্যুয়াল আর্ট বা চিত্রশিল্পেও ৯/১১ এক বিশাল প্রভাব ফেলেছে। আমি এই অংশে কিছু নির্দিষ্ট শিল্পীর শিল্প চিন্তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। অস্ট্রেলিয়া চিত্রশিল্পী আব্দুল আব্দুল্লাহ এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আব্দুল আব্দুল্লাহ ৫/৬ প্রজন্মের অস্ট্রেলিয়ান, যার পরিবারের সবাই শিল্প চর্চার সঙ্গে জড়িত। আব্দুল আব্দুল্লাহর বাবা হোয়াইট অস্ট্রেলিয়ান যিনি মূলত ছাত্রাবস্থায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং মা মালয়েশিয়ান মুসলিম। আব্দুল আব্দুল্লাহ তার এক বক্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন, যে সে একজন উদার সাংস্কৃতিকভাবে মুসলিম হওয়ার পরেও তাকে শুধুমাত্র তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাকে বিভিন্ন সময়ে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে।
২০১১ সালে ৪ জন তরুণ অস্ট্রেলিয়ান আর্টিস্ট ‘ইউ সি মনস্টার’ (You see Monoester) শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন স্ক্রীনিং ভিক্টোরিয়ার অনুদানে, যাদের সকলের বেড়ে ওঠা ৯/১১ পরবর্তী সময়ে। এই প্রামাণ্যচিত্রটি একটি নতুন প্রজন্মের মুসলিম শিল্পীর শিল্পচর্চাকে অনুসন্ধান করে, যারা তাদের নিজস্ব এজেন্সি দাবি করছে, ব্যঙ্গ কল্পনা এবং অপ্রস্তুততার সাথে ইসলাম বিরোধী গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সিডনির একটি সাবার্বে তারা এফবিআই (FBI) নামে একটি রেডিও স্টেশন স্থাপন করেন, যেখান থেকে তারা নিয়মিত ব্যাঙ্গাত্মকভাবে ইসলামোফোবিয়া নিয়ে সম্প্রচার করতে থাকে। ২০১৪ সালে আব্দুল আব্দুল্লার একটি পারফমেন্স করেন যার শিরোনাম সিজ (siege)। এখানে মূলত দেখানো হয় আমাদের পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা আমাদের মনোজগতকে কতটা সীমাদ্ধ করে রেখেছে তারই প্রকাশ আমরা আসলে আমাদের চারপাশের জগতের সঙ্গে করি। পশ্চিমা সমাজ একজন মুসলিমকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে তা’ই আব্দুল আব্দুল্লাহ এই কাজে তুলে ধরেছেন। পশ্চিমা মিডিয়া ও পলিটিক্স নিজ রাজনীতির ও স্বার্থের কারণেই মুসলিমকে উপস্থাপন করছে হুমকি হিসেবে। পশ্চিমা রাষ্ট্র যে জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির ধোঁয়া তুলেছে তা মূলত ইসলামোফোবিয়া, আর জনগণের যে অংশের নিরাপত্তা নিয়ে তারা শংকিত সেখানে মূলত এই তরুণ মুসলিমরা নেই। যার নাম আব্দুল আব্দুল্লাহ বলেছে “আউট-সাইডার আমঙ্গেস্ট আউট-সাইডার’ বা বহিরাগতদের মধ্যে বহিরাগত।

এই সিজ (Siege) ছবিগুলি আবদুল্লাহর প্রজন্মের তরুণদের মাঝে যে উদ্বেগ এবং হতাশার অনুভূতি তার প্রতিফলন করতে চায়। ২০১১ সালের লন্ডন দাঙ্গার ডকুমেন্টেশন এবং ২০১০ সালের আরব বসন্তের খবরের ফুটেজ থেকে ভিজ্যুয়াল ইঙ্গিত আঁকা, অবরোধ হচ্ছে অগ্নি প্রজন্মের গল্প; ক্ষতি এবং মানসিক অস্থিরতার একটি নাট্য চিত্র। পুরো সিরিজ জুড়ে যে মুখোশটি দেখানো হয়েছে তা ‘অন্যের’ একটি ঘৃণ্য প্রতিনিধিত্ব হিসাবে দ্বৈত ভূমিকা পালন করে, সেইসাথে সমসাময়িক প্রান্তিক (নন হোয়াইট/ এংলো সেক্সন) যুবকদের চিত্রণ এবং ফিল্ম ফ্র্যাঞ্চাইজি প্ল্যানেট অফ দ্য এপসের চিত্রের মধ্যে তুলনা করে। যদিও মুখোশটি টিম বার্টনের ২০০১ সালের সিরিজের পুনর্নির্মাণের, আবদুল্লাহ মূল সিরিজের রাজনৈতিক বিবরণ, বিশেষ করে মূল প্ল্যানেট অফ দ্য এপস (১৯৬৮) এবং কনকুয়েস্ট অফ প্ল্যানেট অফ দ্য এপস (১৯৭২) এর সাথে তুলনা করতে পছন্দ করেন।
আমি আমার শিল্পযাত্রা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করি ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মাধ্যমে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা হয়তো ৯/১১ প্রভাবটা শিল্পে সেই মাত্রায় অনুভব করিনি এর কারণ অনেকটা কালচারাল সিঙ্গুলারিটি বা একক সংস্কৃতির কারণে। ভৌগোলিক অবস্থান ও সামাজিক প্রেক্ষাপট শিল্পের চরম এক প্রভাবক, তা নিজেই অনুধাবন করেছি আমার নিজের দ্বারা। যদিও আমার নিজের বেড়ে ওঠাও অনেকটা ৯/১১ উত্তর সময়ে, তথাপি অস্ট্রেলিয়া অভিবাসনের পূর্ব পর্যন্ত আমার শিল্পচর্চায় বৈশ্বিক রাজনীতি বা দ্বন্দ্ব প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু যখন পশ্চিমা মিডিয়া ও রাজনীতির কল্যাণে সাধারণের মনোজগতে এটি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে মুসলিম নারী মাত্রই তার জীবন অভিশপ্ত বা মুসলিম নারী মাত্রই সকলে হিজাব বা বোরকার নিচে, তখন তা আমার চিন্তার মনোজগতেও প্রভাব ফেলেছে এবং ফেলছে, তখন স্বাভাবিক কারণেই আমার শিল্পের বিষয়বস্তুতে স্থান পায় মিশ্র সংস্কৃতি, শিল্প সংকরতা, পজিশনালিটি (অবস্থানগততা) ও বৈশ্বিক রাজনীতি।
খাদিম আলী একজন আফগান হাজারা চিত্র শিল্পী, যিনি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে স্থায়ী। খাদিম আলী মূলত তালিবান ও পরে ৯/১১ কারণে ভিটা ছাড়া হয় পরিবারসহ পাকিস্তানে। হাজারা সম্প্রদায় আফগানিস্তানে একটি নির্যাতিত সম্প্রদায় যারা ৮০’র দশক থেকে নির্যাতনের স্বীকার। খাদিম আলীর শিল্পচর্চা মূলত, তালিবান ও ৯/১১ যুদ্ধে সৃষ্ট ক্ষতের বহিঃপ্রকাশ। তার ছেলেবেলা কেটেছিল রেফিউজি ক্যাম্পে, সে সময়ের স্মৃতি যুদ্ধ, প্রিয়জন হারানো , স্বদেশ ত্যাগ ও তার বেদনা এসব উঠে আসে খাদিম আলীর শিল্পে। তার শিল্প মূলত তার সেসব স্মৃতিরই বর্ণনা যার অন্যতম নিয়ামক ৯/১১।

পরিশেষ : ৯/১১ শুধু বৈশ্বিক রাজনীতিতে বা অর্থনীতি পরিবর্তন আনেনি , এই একটি ঘটনা মূলত আমূল পরিবর্তন এনেছে আমাদের শিল্পে, চেতনায় ও ভাবনায়। ৯/১১ দুই দশক পরে আমরা এমন এক সময়ে এই লিখা লিখছি যখন আফগানিস্তানের পরিস্থিতি দৃশ্যত সেই কুড়ি বছর আগের মতোই। নারীরা আবারো বন্দি হচ্ছে অন্দরমহলে, তাদের অধিকার বলতে কিছুই থাকছে না। মত প্রকাশ ও এর স্বাধীনতা যে কোথায় পৌঁছেছে তা গত কিছুদিনের সংবাদপত্রে চোখ বুলালেই অনুমান করা যায়। দারিদ্রতা, অশিক্ষা, দুর্নীতি ও ধর্মান্ধতায় জর্জরিত একটি দেশের জনগণের ভাগ্যে কি আছে তা আগামীই বলে দিবে। অপরদিকে ইউএস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, অন্যের সমস্যা সমাধানে মার্কিন সৈন্যরা আর প্রাণ দিবে না। আদতে এই কথা কতটুকু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে তা’ও আগামী বলে দিবে। তালিবান সরকারকে প্রচ্ছন্ন মদদ দিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া, চীন ও ইরান তাদের ভূরাজনৈতিক কারণেই। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও আছে চীন আমেরিকার দ্বন্দ্ব যার অন্যতম অংশ অস্ট্রেলিয়া। আগামীর দিনগুলোতে তাই এই বৈশ্বিক ভূরাজনীতি কোনদিকে যাবে আর কে হবে সেই কূটচালের নতুন বলি তা’ও সময়ই আমাদের বলে দিবে। মানব জাতি হিসেবে আমরা বলতে পারি আমরা আর কোনোদিন’ই আমাদের সেই আগের পৃথিবী ফিরে পাবো না। ৯/১১ বিশ্বব্যাপী যে ক্ষত ও ক্ষতির সৃষ্টি করেছে আমাদের তা বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন।
সমাপ্ত।
মিতা চৌধুরী
চিত্রশিল্পী, লেখক, সংগঠক
মেলবোর্ন প্রধান, প্রশান্তিকা।