বাঙলা নাটকের সর্বনাশ ও সর্বস্ব
বদরুজ্জামান আলমগীর
১৯৬১ সনে সুধীর চক্রবর্তী তাঁর গানের লীলা সেই কিনারে বইয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের জায়গাটি নির্ধারণ করতে গিয়ে বাঙলা গান সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্তমূলক ভীতিকর সুন্দর কথা তোলেন; তিনি বলেন: রবীন্দ্রনাথ বাঙলা গানের সর্বনাশ ও সর্বস্ব।
সেলিম আল দীনের ৭১তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে নানাদিক থেকে আলো, ঔৎসুক্যে তাঁর সৃষ্টিযজ্ঞ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে- এ খুবই আনন্দ ও শ্লাঘার কথা। কিন্তু জানি না কেন আজ আবার জলের মতো ঘুরে ঘুরে সুধীর চক্রবর্তীর ওই কথাটি মনে পড়লো।
বাইরে বাইরে আনেবানে ঘুরতে থাকা বাঙলা নাটককে সেলিম আল দীন চলমদারের দীক্ষায় পথ দেখিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন- তাতে কোন সন্দেহ নাই; আধুনিক বাঙলা নাটকে সেলিম আল দীনই প্রথম ঘরামী যিনি আমাদের মন ও মননের উপর থিয়েটারের একটি মৌলিক ছাউনির অবকাঠামো গড়ে তোলেন।
আমরা হাত মকশো কাল বলে একটা কথা বলি- যার অর্থ দাঁড়ায় এই, যে-কোন একটা কাজ করতে করতে হাতের নিশানা ঠিক করে একটা দক্ষতা অর্জন করার তৎপরতায় নামা।
সেলিম আল দীন নাটকের বর্ণনাকে উপন্যাসের, বা গল্পের, বা নিবন্ধের বর্ণনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জায়গায় নিয়ে অভিনয়ানুগ বর্ণনায় ঘনবদ্ধ করবার সুযোগ পাননি। এই ঘাটতির মধ্যেই নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন দুনিয়ার যে-কোন মহৎ লেখকের সমকক্ষে এসে দাঁড়ান।
বড় লেখক তিনিই- যিনি তাঁর উত্তরসূরীদের পথ কুসুমাস্তীর্ণ করেন না- না করেন অনড় দেওয়াল; তিনি বরং তাদের এক সুউচ্চ শৃঙ্গের নিশানা দেখিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তোলেন। এ-যাবৎ বাঙলা নাটকের দৌড় ছিল মেলোড্রামা আর মোটাদাগে কিছু স্টক ক্যারেক্টারের হাঙ্গামা- সেলিম আল দীনের একচ্ছত্র অবদান- তিনি নাটককে মঞ্চে ও পাঠাভিজ্ঞানে কবিতার মিহিদানায় যোগ করেন।
সেলিম আল দীন যে-কোন একটি উত্তীর্ণ ভাষার সামিল- যা কখনোই শতভাগ গঠিত নয়, শেষ কথা নয়; বরং সবসময় আরো বিকশিত হবার মেধা ও ধৈর্য গর্ভে ধারণ করে।
তাঁর পরে যাঁরা লিখবেন তাঁরা অধিকতর বিনির্মাণের খোঁয়াড়ির ভিতরে কঠিনেরে ভালোবাসিবেন- কঠিন কখনও করে না বঞ্চনা, তিনি থিয়েটারের পথে প্রস্তুতির, লিপ্ততার, মৌলিক ধ্যানের মোরতুবা যোগ করে দিয়েছেন।
সেলিম আল দীন নমস্য পাথেয়, কেননা তিনি কঠিন ও পরিচিত, মৌলিক ও অচেনা পথে গ্যাছেন!
বদরুজ্জামান আলমগীর
কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক
ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।