সোনার হরিণ । গল্প । ফারহানা সিনথিয়া

  
    

শোনো তোমার কাছে জমানো কিছু আছে?”, সৌরভ  ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল।

মিলি ছোট একটা নিঃশাস ফেলল। এই প্রশ্নের অর্থ মিলি জানে। এর আগে এই করে ওর ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙেছে। নতুন কোনো ব্যবসার আইডিয়া খুঁজে পেয়েছে সৌরভ। হঠাৎ করে বড়লোক হতে হবেঅতএব ব্যবসা করতে হবে। প্রতিবার ওর সরলতার সুযোগ নিয়ে কেউ ওকে ঠকিয়ে যায়। কোনোমতে প্রতিবার ও ইনভেস্টমেন্ট তুলে নিয়ে আসে। অনেক সময় সেটাও ফেরত আসে না।

“ না। এই মুহূর্তে আমার হাতে কিছু নেই। কেন বলবে?

“ বিদেশে যাবার একটা সুযোগ পাওয়া গ্যাছে। একদম জেনুইন”।

মিলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “ আমরা তো ভালই আছি। আমার তো বাড়তি কোনো চাহিদা নেই। ছেলে মেয়ে ভালো স্কুলে পড়ছে”।

“ আরে এই জঘন্য দেশে কেউ থাকে বলো? যারা থাকে তাদের আসলে যাবার কোনো জায়গা নেই”।

এখানে অনেকেই করে খাচ্ছে সৌরভ। আমার কাছে কোনো আলাদা করে রাখা টাকা নেই সৌরভ। তুমি দ্যাখো কারো কাছে জোগাড় করতে পারো কিনা”।

মিলি ডালে ফোঁড়ন দিতে দিতে ভাবে তার কপালে এমন একটা বোকা লোক কেন পরল। অথচ বাবা মা ইঞ্জিনিয়ার দেখে বিয়ে দিলেন। ভাগ্যিস ও জেদ করে পড়াটা শেষ করেছিল। নয়ত সংসার ভেসে যেত একেবারে।

সৌরভ দেখতে সুন্দর। বাস্তব জ্ঞান নেই একেবারেই ওর। বাবা মায়ের শেষ বয়সের পুত্র সন্তান অতিরিক্ত আহ্লাদ পেয়েছে। ধরেই নিয়েছে পৃথিবীর সবাই ওর জন্য মাছের মুড়োটা নিয়ে বসে আছে। কষ্ট করে উপর্জন নয় বরং হুট্ করে উন্নতি করার এই যে ইচ্ছে তা বারবার ওকে ঠকিয়ে যায়। এবার ও এমন কিছুই হবে মিলি ধরেই নিয়েছে। তবে ও এবার সাবধানী। কিছুতেই জমানো টাকায় হাত দেবে না। মেয়ের বয়স ছয় আর ছেলে চার। ওদের ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবতে হবে।

সৌরভ কতদিন মন মরা হয়ে ঘুরে বেড়ালো। মিলি নির্বিকার।

ও ঠিক করে রেখেছে এসব একেবারে প্রশ্রয় দেবে না।

একদিন দুপুরে সৌরভ হন্ত দন্ত হয়ে বাড়ি এলো। চোখে মুখে খুশির ঝলক। এসেই মিলিকে বলল, ” একটা দারুন সংবাদ আছে জানো? আমাদের কানাডা যাবার পাকাপাকি ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

তাই? পুরোটা বলো আমি শুনছি।”

মিলি হাত মুছতে মুছতে বের হয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। আজকে শুক্রবার। ছুটির দিন। মিলির অফিস বন্ধ। একটা ব্যাংকে চাকরি করে মিলি। দিনরাত উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। মিলি ভেবেছিল সৌরভ বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে গ্যাছে। প্রতি শুক্রবারে যেমন যায়।

সৌরভ হাসিমুখে বলল, “ আজকে হোটেল লেকভিউতে একটা প্রেসেন্টেশন দেখতে গিয়েছিলাম। কানাডার প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তো বলেই  দিয়েছেন অনেক স্কিল্ড ওয়ার্কার নেবে ওরা। তারপর কিছুদিন পরেই পি আর কার্ড।”

মিলি হেসে ফেলল। সৌরভ এমন ভাবে বলল যেন কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই মাত্র কথা বলে এলো সৌরভ। বাস্তবতা ওকে শিক্ষা দিয়েছে। সচ্ছল পরিবারের মেয়ে এখন ঠিক থাকে হিসেবি হয়ে গেছে। সেই হিসাব এখন খরচের খাতা পার হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ও সহায়ক হয়।

অনেক আনন্দের খবর। তুমিও এপলাই করে দাও।”

আমি জানি তুমি কি ভাবছো। কেউ ঠকিয়ে নিয়ে যাবে। এই তো? ওরা নিশ্চয়তা দেবে চাকরি কনফার্ম হবার আগে পর্যন্ত এক টাকা ও নেবে না। শুধ পেপার ওয়ার্ক করতে দশ হাজারটাকাএই খরচ আমি দিয়ে দেব। পরে যদি যাবার সময় হয় তখন দুজনে মিলে কিছু একটা করা যাবতাক

আমি তেমন কিছু ভাবিনি। তবে তুমি অবশ্যই দেখে শুনে এগোবে।”

এর পরের কয়েকদিন সৌরভ বেশ দৌড়া দৌড়ি করল। ওর ইউনিভার্সিটির সব সার্টিফিকেট নোটারাইজ করল। পুরোনো চাকরির রেফারেন্স লেটার জোগাড়। প্রতিদিন অফিসের পর সৌরভ ঘন্টা দুয়েক বাইরে থাকে। শুধু কাগজ পত্র নয় কি একটা কোর্স ও করছে। বিগিনার্স ফ্রেঞ্চ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। ও শুনেছে ওখানে সরকারি চাকরি পেতে ফরাসি ভাষা জানা একটা বড় সুবিধা।

মিলি, সৌরভ আর ওদের দুই ছেলে মেয়ের পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ন হয়ে গেছে। সব আর্জেন্ট করে রিনিউ করা হলো। আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করলো সৌরভ।

মিলি ভাবলো বেচারা চেষ্টা করছে। এখানে সব সময় নেতিবাচক মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

কানাডার নামি একটা কোম্পানিতে নাকি চাকরির ব্যবস্থা হবে। সৌরভ প্রতিদিন ল্যাপটপের ওয়ালপেপার বদলায় আর মিলিকে দেখায়। এই যে দ্যাখো ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজ। আমি তোমাকে ভ্যাঙ্কুভার ঘুরতে নিয়ে যাবো। লেক মোরেনের ধরে বসে সূর্যাস্ত দেখব আমরা। মিলির স্বপ্ন দেখতে ভালোই লাগে। আসলেও তো তাই এতদিনে শুধু ওই দশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। দেখে শুনে মনে হচ্ছে সৌরভ হয়তো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত ন্যায়নি।

দিন পনেরো পরে

মিলি অফিস থেকে ফিরে একটু গড়িয়ে নিচ্ছে। ইদানিং ট্র্যাফিক ঠেলে বাড়ি ফিরতে আসলে ও অসহ্য লাগে। এমন জ্যাম। তার সঙ্গে তাল পাকা গরম।

সৌরভ ওকে ডেকে তুললো। চোখে মুখে আনন্দ। টেনে তুলে ওকে কি একটা কাগজ দেখালো, ” এই যে দ্যাখো এপয়েন্টমেন্ট লেটার। তোমাকে আমি বলেছিলাম না?”

মিলি চিঠিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল। চিঠিতে সৌরভের পাসপোর্ট নম্বর অব্দি আছে। কোম্পানি ওয়েবসাইট দেয়া আছে।

সৌরভের মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে।

এটা ফটোকপি মিলি। এখন ওদের টাকা দিতে হবে।তারপরে এই ডকুমেন্ট নিয়ে আমার এম্বাসি ফেস করতে হবে। সরি এম্বাসি নয় কানাডিয়ান হাই কমিশন।”

কত টাকা দিতে হবে এখন?”

ওদের প্রসেসিং ফি আড়াই হাজার কানাডিয়ান ডলার। আমি  লাখ খানেক টাকা জোগাড় করেছি। তবে এখনো বেশ খানিকটা শর্ট। ধরো আরো এক লক্ষ মতন লাগবে।”

মিলি বলল, ” আমার বিয়ের একটা ভারী ঝুমকা আছে। ওটা দিলে অনায়াসে হয়ে যাবে।”

“ আমি কানাডা গেলে তোমাকে একই রকম আরেকটা বানিয়ে  দেব মিলি”।

পরদিন সকালে মিলি আমিন জুয়েলার্স গেল। ওদের দোকান থেকেই কেনা ছিল ভারী ঝুমকো জোড়া। বিক্রি করে টাকার ব্যাগ নিয়ে ডিসিসি মার্কেটের বারান্দায় কিছুক্ষন দাঁড়ালো মিলি। প্রবল তৃষ্ণা পাচ্ছে। দুল জোড়া মায়ের পছন্দে কেনা। এখন মা নেই। এই দুল জোড়া মেয়ের জন্য যত্ন করে রেখেছিল ও।

তার পরদিন সৌরভ টাকা নিয়ে এজেন্সির গুলশানের অফিসে গেলো। টাকা দিতে ওনারা অফার লেটার সহ একটা প্যাকেজ দিলেন। এখন বাকি কাজ সৌরভের। ও এপ্লিকেশন ফর্ম কিভাবে ফিলাপ করবে তার নিয়ম, ভিসা অফিসের সম্ভাব্য প্রশ্ন তালিকা আর সাপোর্টিং ডকুমেন্ট কি লাগবে তার একটা লিস্ট।

মিলির ছোট বেলার বান্ধবী লীনা এসেছে টরন্টো থেকে। ওদেরকে বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছে মিলি। কথা প্রসঙ্গে ও লীনাকে জানালো ওয়ার্ক পারমিটের সুখবর। লীনা বলল একটু দেখে শুনে এগোস তোরা।  সানকোর নামের খনিসম্পদ প্রতিষ্ঠান  বাংলাদেশ থেকে লোক নিচ্ছে শুনে বেশ অবাক হলো লীনা। সৌরভকে বলতেই ও জানালো তোমার বান্ধবীর মনে একটু হিংসা আছে।

মিলির মনের খচ খচানি আর কিছুতেই যায় না। ও একদিন লীনার সঙ্গে দেখা করলো সঙ্গে চিঠি। লীনা চিঠি উল্টে পাল্টে দেখলো। তারপরে বলল ও মিলিকে সাহায্য করতে পারে। লিংকড ইনে ওর এক বান্ধবী আছে যে সান কোরের এইচ আর ম্যানেজার একজনকে চেনে। চিঠি নিয়ে ওকে দেখাবে। যেহেতু অন্য দেশের ভিসার এপ্লিকেশন এজন্য একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা।

সমস্ত রাত সেদিন এপাশ ও পাশ করে কাটল মিলির। সৌরভ ভীষণ বিরক্ত হল মিলির ওপর। ও কেন আগ বাড়িয়ে চিঠি দেখাতে গ্যাছে। পরদিন সকালে লীনা জানালো অফার লেটার নকল।

সৌরভ বেশ কয়েকদিন মন মরা হয়ে রইল। আশে পাশের আত্মীয় স্বজনদের টিকা টিপ্পনী শুরু হয়ে গেছে। মিলি কিছুই বলল না। যা হবার হয়েই গ্যাছে। বিদেশ নামের সোনার হরিণওদের অধরাই রয়ে গেল।

মিলি আরেকদিন সন্ধে বেলায় ঘুমিয়ে আছে। সৌরভ ওকে টেনে তুললো। হাসিমুখে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। মিলি খুলে দ্যাখে ওর মায়ের দেয়া সেই ঝুমকো জোড়া।

সৌরভ বলল, ” আমি কানে ধরছি। আর কারো কথায় বিভ্রান্ত হবো না। চাকরিতে মন দেব। দরকার হলে পার্ট টাইম ফ্রি ল্যান্সিং করব। শর্টকাট খুঁজব না”।

সমাপ্ত

পুনশ্চঃ এই গল্প সম্পূর্ণ সত্য ঘটনার আলোকে লেখা। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে লেখা। আমাকে তিনজন ভিক্টিম বিভিন্ন সময়ে কন্ট্যাক্ট করেছেন। চিঠি পড়ে বড় সড় অসঙ্গতি চোখে পড়েছে তখন তাদের জানিয়েছি কোথায় অভিযোগ করতে হবে। সঙ্গত  কারনে কম্প্যানির নাম বদলে দিলাম।

অলংকরণ : আসমা সুলতানা মিতা 

ফারহানা সিনথিয়া

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments