স্বজন সহপাঠী সবুজ মাঠ, সব মিথ্যে, স-ব! -প্রতীক ইজাজ

  
    
প্রতীক ইজাজ

সিফুন বুয়েটে পড়তো। ওর তিতুমির হলে বহুবার গিয়েছি। রাতে থেকেছি। মধ্যরাতের ক্যান্টিন। খিচুড়ি, ব্যালকনি, সিঁড়ি, আড্ডা। পলাশীর মোড়। নিরব সড়ক। নতুন বন্ধু। স্মৃতি। সুখময় রাত।
গভীর রাতে জ্বলে ওঠা হল, হলের চৌহদ্দি, ছেলেগুলোর নতুন করে জেগে ওঠা। আলো আঁধারের মায়া। গল্প, তর্ক-বিতর্ক, গান। কারো বা চুপচাপ গিলে যাওয়া রাতের মুগ্ধতা।

সেদিন রাতেও হয়তো জেগেছিল তিতুমির, শেরেবাংলা, পলাশীর মোড়। শহীদ মিনারের বেদিতে গল্পে মজেছিল টি-শার্ট গায়ে সুন্দর হাসিমুখ ছেলেরা। রাতের আলোয় মিশছিল ওদের উচ্ছ্বল উজ্জ্বল দ্যুতি। রিকসার টুংটাং। কেউ হয়তো গাইছিল গান গলা ছেড়ে। বাতাসে কেটে কেটে তার সুর, গল্প, হাসির শব্দ, ছড়িয়ে পড়ছিলো দূরে, বহুদূরে, মগ্নতায়।

অথচ সে রাতেই, খানিকটা দূরে ওই শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে তখন কাঁদছিল ছেলেটা। কাঁদছিল মানে প্রাণ বাঁচাতে করুণ আকুতি। চেনা মুখ। মুখস্থ। সহপাঠী। সাবজেক্ট, ইয়ার এক। চোখ থেকে চোখে ঘুরছে চোখ। মুখ থেকে মুখে। কী করুণ আকুতি। বেঁচে থাকার কী সরল আর্তি। একটু, একটু দয়ার জন্য কী মিনতি!

হলো না। ওদের মন গললো না। ওরা তখন বেপরোয়া, বর্বর, পিশাচ। চোখে-মুখে খুন, ক্ষমতা, শক্তি। ওরা তখন নেতা। ক্ষমতাসীন দলের নেতা। কর্তৃত্ব নেতৃত্ব সবই তো ওদের, স-ব। হল, গোটা বিশ্ববিদ্যালয়, সবুজ মাঠ। ক্যান্টিন শিক্ষক প্রশাসন। স-ব ওদের। দুর্দান্ত ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি। চারদিকে যা কিছু সবই তো ওদের!

ছেলেটার তখন আর কথা বলার শক্তি নেই। হাত পা নড়ে না। চোখে আঁধার। মুখ নেই। ছবি ভাসে না। নিস্তেজ নিথর। ছোপছোপ কালসিটে দাগ। তবুও নৃশংস ওরা। তবুও পাষন্ড। অগত্য ফেলে রাখলো সিঁড়িতে। সময় যায়। আয়ু ফুরায়। একসময় বন্ধ হলো চোখ। আর খুললো না ছেলেটা। পরদিন ওই চোখ জ্বললো হাজার চোখে; মানুষের শোক ক্ষোভ বেদনায়। ছেলেটা জেগে উঠলো ক্ষুব্ধ মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদে।


আমার কেবলই না দেখা সে রাতের কথা মনে পড়ছে। সিঁড়িতে পড়ে আছে নিথর দেহ। শরীর জুড়ে বেধড়ক পোটানোর ছোপ ছোপ দাগ। সাড়ে তিন ঘন্টারও বেশি সময়। নিশ্চয় ওর এতটুকুও নড়ার শক্তি ছিল না। কন্ঠ দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছিলো না। সামান্য একটু এগিয়ে কাউকে ডাকবে, আহা, তা-ও পারেনি। ক্লাস ক্যাম্পাস আড্ডায় মুখর একটা ছেলে, কীভাবে একখন্ড মাংসপিন্ড হয়ে অসাড় পড়ে রইলো সিঁড়িতে, প্রাণহীন লাশ হলো- এই কষ্ট, এই বেদনা আমাদের বহুদিন কাঁদাবে। কষ্ট দেবে। একটা জ্যান্ত মানুষকে পিটেয়ে মেরে ফেলার মতো এত জঘন্য বর্বরতা আর কিছুই হতে পারে না।

বুয়েটের ছেলেমেয়ে, শিক্ষক কর্মচারি, সবাই শপথ নিয়েছেন।  সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা রুখে দিতে গণশপথ। খুনীদের স্থায়ী বহিস্কার না হওয়া অবধি ক্লাসে ফিরবে না ওরা। পরীক্ষায় বসবে না। সহপাঠী-বন্ধুরা কাঁদছে। স্মৃতি বলছে। ক্ষুব্ধ মানুষ। বীতশ্রদ্ধ। ভীত। মিছিলে, সমাবেশে, শোকর‌্যালিতে, কেঁদে কেঁদে বর্ণনা করছে প্রাণহীন ছেলেটার সিড়িতে অসহায় পড়ে থাকার সে দৃশ্য।

এক সহপাঠী বললেন, তখন আড়াইটার মতো বাজে। খেতে বের হয়েছি। দেখি আবরার কাতরাচ্ছে। তখনো ছাত্রলীগ নেতা জিয়ন বলছিল, ‘ও (আবরার) নাটক করতাছে।’
আরেকজন- যখন আবরারের হাত ধরি, তখন হাত পুরো ঠান্ডা, পা ঠান্ডা। শার্ট-প্যান্ট ভেজা। তোশক ভেজা। মুখ থেকে ফেনা বের হয়েছে। তখন ওকে বাঁচানোর জন্য বুকে চাপ দিই। হাতে চাপ দিই। আশপাশের সবাইকে বলি, কেউ একজন ডাক্তারকে ম্যানেজ কর। এরপর ডাক্তার আসল। ডাক্তার দেখে বলেন, ১৫ মিনিট আগেই সে মারা গেছে।

ছবি দেখেছি ছেলেটার। পুলিশ কথা বলেছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দিয়েছে চিকিৎসক। ওর দুই কাঁধের নিচ থেকে হাতের কব্জি পর্যন্ত কালসিটে। কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত জখমের দাগ। পেটানোর ফলে ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা গেছে ছেলেটি।

এ নিয়ে বুয়েটে তিন অসহায় শিক্ষার্থীর প্রাণ গেল। ২০০২ সালের জুনে ছাত্রদলের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে মারা গেলেন দ্বিতীয় বর্ষর ছাত্রী সনি। ২০১৩ সালে হেফাজত-শিবির নৃশংস খুন করে দ্বীপকে। আর এ বছর ৬ অক্টোবর রাতে কক্ষে পিটিয়ে ফাহাদকে মারলো আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। একটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা কতটা বেপরোয়া, নিয়ন্ত্রণহীন ও ক্ষমতাধর হলে, এভাবে অমানুষের মতো ঘন্টার পর ঘন্টা পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে একজন মানুষকে! এমনকি মারার পর দেহ ফেলে রাখে সিঁড়িতে। হাসপাতালে পাঠায়নি। পুলিশকেও ঢুকতে দেয়নি। এমনকি মৃত্যুর আগে ছেলেটা যখন কাতরাচ্ছিল যন্ত্রণায়, পাশে দাঁড়িয়ে এক নেতা বলছিলেন, ‘ও অভিনয় করছে’।

এমন মর্মন্তুদ মৃত্যু আমাদের শোকাচ্ছন্ন করেছে। পেশার কারণে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নানা খবর পাই। লিখতে হয়। যেতে হয় স্পটে। কত মানুষের কান্না দেখি। শোক, অসহায়ত্ব দেখি। মন মানাতে পারি না। তবু কাজ করি। করতে হয়। রোববার রাতে যখন শুনলাম খবরটা, সোমবার যখন আরো জানলাম, সেই থেকে মনটা ভীষন খারাপ হয়ে আছে। ছাত্র রাজনীতি আমরাও করেছি। ক্যাম্পাস থেকে শিবির হটানো, শিবিরের সঙ্গে সম্মুখ সংঘর্ষ, ভোট কারচুপি বন্ধ, মিছিল, মিটিং- কত কি। কিন্তু এভাবে কখনো মারতে হয়নি কাউকে। মারিনি। মেরে ফেলা তো দূরেই থাক। বাসায় বাহিরে কত রাজনীতি দেখেছি, কতজনের। এমন বিভৎসতা কখনো দেখিনি। এভাবে একটি ছেলেকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অরেকদল ছেলে রাতভর পিটিয়ে মেরে ফেলবে, এটা ভাবা যায়!

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অবশ্য ছাড় দেননি। ঘটনায় কারা জড়িত, তাদের দলীয় পরিচয় দেখেননি। এমন নৃশংসতাকে অপরাধ হিসেবেই দেখেছেন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। ১৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। আবরারের মাকে বুকে টেনে নিয়েছেন। বিচারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আদালতে অপরাধের কথা স্বীকার করেছে আসামীরা। কীভাবে সে রাতে ওরা আবরারকে পিটিয়ে মেরেছে, তার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে। বুয়েট কর্তৃপক্ষ নানা দাবি মেনে নিয়েছে। হলে হলে অভিযান চলছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ছাত্ররাজনীতি। দলগুলোকে এখানে শাখা না দিতে ও বিদ্যমান কমিটি বিলুপ্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।

এসবই তো ঘটনার পর নিমিত্ত মাত্র। কিন্তু একবারও কি ভেবেছি আমরা, বুয়েটের মতো এমন নামকরা প্রতিষ্ঠানে, যেখানে সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েরা ভর্তির সুযোগ পান, সেখানে ছাত্রলীগের এই ছেলেগুলো কী করে এতটা নৃশংস হলো? ওরাও তো মেধাবী। ওরাও তো সাধারণ ঘর থেকে আসা স্বপ্নের মানুষ। বাবা মা স্বজনরা কত স্বপ্ন আশা নিয়ে ওদের দিকে চেয়ে আছে। সন্তান একদিন বড় হবে, সুখ আসবে। লোকে বলবে- ওই যে, ওই বাড়ির ছেলেটা বড় ইঞ্জিনিয়ার, ঢাকায় পড়েছে! সেই স্বপ্ন ফেলে, কে কিভাবে কেন এমন মরণখেলায় নামালো ওদের? নেতৃত্বের কোন মন্ত্র ওদের এতটা নৃশংস করে তুললো?

পেশার কারণেই বুয়েটের নানাজনের সঙ্গে কথা বলেছি আমরা। জেনেছি, ছাত্রলীগ বুয়েটে এমন বেপরোয়া, সেটা একদিনে হয়নি। আওয়ামী লীগ যখন প্রথম ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে, তখনই শক্ত ঘাঁটি গাড়ে সংগঠনটি। পরে বিএনপি এলে কিছুদিন চুপ। দাপট বাড়ে ছাত্রদলের। ছাত্রদলের দুপক্ষের গোলাগুলিতে বুয়েটের আরেক মেধাবী শিক্ষার্থী সনি মারা যায়। সেবারও ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। কিছুদিন বন্ধ থাকে ছাত্ররাজনীতি। পরে ২০০৬-২০০৮ সালের মধ্যে আবার শুরু হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে এবার দাপট দেখাতে শুরু করে ছাত্রলীগ। গত ১০ বছরে সে দাপট বর্বরতায় রূপ নেয়। পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনা ঘটায়।

বুয়েটে ছাত্রলীগের ক্ষমতার দাপটে অতিষ্ঠ ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অভিযোগ জানানোর যে ওয়েবপেইজ বন্ধ করে দিয়েছে বিটিআরসি, সেখানে যত অভিযোগ, তার ৯৯ শতাংশই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে র‌্যাগিং এর নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিযাতনের অভিযোগ। কত নোংরা, বর্বব, মর্মন্তুদ হতে পারে সে নির্যাতন, তার চিত্র গত কয়েকদিনের পত্রপত্রিকায়, বক্তৃতা বিবৃতিতে এসেছে। ক্ষমতার দাপটে অদৃশ্য প্রশাসক হয়ে উঠেছিলো সংগঠনটি।

তারমানে, বুয়েট ছাত্রলীগের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না মুল দল ও নেতৃত্বের। ওরা কি করছে, কিভাবে চলছে, সেসবের কোন খোঁজ রাখতেন না শীর্ষ নেতৃত্ব। এমনও হতে পারে, জেনেও চুপচাপ ছিলেন সবাই। একবারও প্রয়োজন মনে করেননি শোধরানোর, নৃশংসতার পথ থেকে ফেরানোর।

তারমানে, এই দল, দলের সবাই ব্যস্ত আখের গোছাতে, চারপাশ, নিজেকে নিয়ে। চোখ বোধ মন ঢেকে গেছে অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, সুখ সম্ভোগে। সে সংস্কৃতিতে ডুবেছে এখানকার ছেলেরাও। বাঁধা না আসায়, প্রতিরোধ না পেয়ে, দিন দিন ওরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বই, পড়ার টেবিল ফেলে ওরা নেতা হয়েছে; ছাত্র নেতা, ক্ষমতার নেতা। নেতৃত্বের নামে ভূল পথে ওরা শাসন করেছে, শোষন করেছে। সহপাঠীর চোখের জল- বর্বর নেতৃত্ব ও বড় পদের অনুষঙ্গ হয়েছে। অন্ধকার-আলোর ভেদ ভুলে গেছে। সৎ উপদেশ নেই। আত্মসমালোচনার সুযোগ নেই। অভিভাবক নেই। সবার সব পথ মিশে গেছে ক্ষমতায়, অন্ধকারে। বছরের পর বছর,  আস্কারা পেয়ে- দেখার ও বোঝার পথ বন্ধ করে গেছে ওদের।

একদিন সব জানলো লোকে। দেখলো। বুঝলো। নৃশংস মৃত্যুর মধ্য দিয়ে খুলে গেল এক অন্ধকার জগত। আলো নেই। ভালবাসা নেই। স্বজন সহপাঠী নেই। শিক্ষক সবুজ ক্যাম্পাস ভোরের আলো- সব মিথ্যা, সব। সত্য কেবল ক্ষমতা। ক্ষমতার মোহ!

প্রতীক ইজাজ
সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
ঢাকা।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments