স্বপ্নের ফেরীওয়ালা

  
    
আমি ছোটবেলা রূপকথা পড়েছি। ওই যে রাজকুমারী ঘুমিয়ে থাকে। তারপর একদিন রাজকুমার জীয়ন কাঠির জায়গা বদলে দেয়। পায়ের কাঠি মাথায় আর মাথার কাঠি পায়ে ছুঁয়ে দিল আর অমনি রাজকন্যা একশ বছর পর ঘুম থেকে জেগে উঠলো। গল্প পড়তে গিয়ে রাজকুমারীর কথা ভেবে আমার মন খারাপ হয়েছে। ছোটবেলা হয়তো কেঁদেছি। কিন্তু কখনো রাজকুমারীকে উদ্ধারের কথা ভাবিনি। আমি তো রাজকুমার নই। রাজকুমারীকে আমি উদ্ধার করবো কি করে? গল্পে সব অসাধ্য সাধন করে ওই রাজা নতুবা রাজপুত্র। সাধারণ মানুষের যেন কিছু করার নেই। আমাদের রূপকথাগুলো এমনই।
কিন্তু সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখতে চায়। মানুষ তো তার স্বপ্নের মতো অসীম। শুধু সেই স্বপ্নগুলো জাগিয়ে রাখতে হয়। আমাদের মত সেই সাধারন, অতি সাধারন তরুণদের স্বপ্ন দেখানোর কাজটি করেছেন ড. জাফর ইকবাল। আমরাও ভাবতে শিখলাম রাজপুত্র সব কিছু করে না। এই আমিও অনেক কিছু করতে পারি। ডঃ জাফর ইকবাল একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। যিনি একটি প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, এবং এখনও নতুন নতুন স্বপ্নের কথা বলছেন। ফেরিওয়ালার মতো নানা রঙের স্বপ্ন ঝুড়িতে নিয়ে গলা হাঁকেন, ‘স্বপ্ন নিবে স্বপ্ন ? আমার কাছে স্বপ্ন আছে, নানান রঙের স্বপ্ন।’
সিডনির নাগরিক সন্ধ্যায় ভক্ত বেষ্টিত ড. জাফর ইকবাল। ছবি: ফাহাদ আসমার

জীবিত আর মৃত মানুষের মধ্যে তফাৎ একটি। একজন স্বপ্ন দেখে আর আরেকজনের চোখে স্বপ্ন নেই। স্বপ্নই তো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ড. জাফর ইকবাল কিছুদিন আগে সস্ত্রীক সিডনি  ঘুরে গেলেন। আমি উনার লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ি তবে উনার ‘ফ্যান’ ক্লাবের সদস্য নই। উনার অনেক কথাই মনে ধরে রাখি। আর সিডনিতে উনার কথা শুনবো না তা কি হয় ?

শুধু কথা বলে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুগ্ধ করা যায়। ড. জাফর ইকবাল এবং ড. ইয়াসমিন হক সেদিন অনেক গল্প বললেন। জীবনের কথা, যুদ্ধের কথা, মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসার কথা, আর নতুন স্বপ্নের কথা। ড. জাফর ইকবালের কয়েকটি কথা আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে। উনি বললেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে তাদের জীন, ক্রোমোজোম বদলে গ্যাছে। তাদের সব কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধ থাকে।’  ড. জাফর ইকবালের সাথে নতুন করে একটি সম্পর্ক টের পেলাম। আমার জন্য একটি চমৎকার উত্তর সাজিয়ে দিলেন। যখন কেউ জিজ্ঞেস করবেন আমি কেন শুধু মুক্তিযুদ্ধের নাটক করি আমিও অবলীলায় এই উত্তরটি দিয়ে দিব।
প্রিয়জনের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। আমরা সব কিছুতেই ড. জাফর ইকবালের কথা শুনতে চাই। কিন্তু সেই প্রিয়জনও আমাদের কাছে কিছু চাইতে পারেন।  ড. জাফর ইকবাল আমাদের কাছে কিছু চাইলেন। পরিষ্কার করে বললেন, ‘যারা প্রবাসে থাকেন তারা আওয়ামী লীগ, বি এন  পি করবেন না।  যে দেশে থাকেন সেই দেশের রাজনীতি করুন। আমাদের লক্ষ্য অনেক উপরে। আপনারা ভাল কাজ করে বিলিয়নিয়ার হন। যেন আমি আপনাদের বলতে পারি দশ  মিলিয়ন দিয়ে আমাকে একটি প্রতিষ্ঠান করে দিন – যা আমাদের ছেলেমেয়েদের কাজে লাগবে। ছোটোখাটো কিছু দিয়ে আমাদের হবে না।’
উনি বললেন প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি  স্কুল-কলেজের তরুণ-তরুণী বদলে দিতে পারে আমাদের বাংলাদেশ। ওদেরকে শুধু শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্বটি নিতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য আর অনিয়ম দেখে আমার মনে আশংকা জাগে। মাদ্রাসা শিক্ষা আর মূল স্রোতের শিক্ষা ব্যবস্থার যে বিশাল ফারাক – তা কমানো না গেলে – আমরা কি রকম বাংলাদেশ আশা করবো?
সিডনির নাগরিক সন্ধ্যায় কথা বলছেন ড. জাফর ইকবাল। ছবি: ফাহাদ আসমার

ড. জাফর ইকবাল আবার মনে করিয়ে দিলেন, দেশ মানে শুধু মানচিত্রের এক খন্ড  জমি নয়। দেশ হচ্ছে আবেগ, ভালোবাসা – যা এই হাজার মাইল দূরে বসেও টের পাওয়া যায়।  শুধু কি দেশে গিয়েই দেশের কল্যাণ করা যায়? বিদেশে বসেও দেশের জন্য কাজ করা যায়। উনি এমন অনেক কথা বললেন।  আমরা শুনলাম। উনার কথাগুলো কেউ মেনে নিবেন। কেউ মনে নিবেন। কেউ হয়ত এর দুটোই করবেন। কেউ হয়ত উনার একটি কথারও গুরুত্ব দিবেন না। কিন্তু আমার মনে হোল যে আমাদের ভাল গুণগুলো দিয়ে এই অস্ট্রেলিয়াকে আরো সুন্দর করে বাঙ্গালি সাজে সাজাতে পারি। তাতে আমার দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এই প্রবাসে। অস্ট্রেলিয়াকে বাংলাদেশ বানানোর দরকার নেই।

এবার অনুষ্ঠান নিয়ে কয়েকটি কথা।
সময় মতো অনুষ্ঠান শুরু না  করা আমাদের অনেকদিনের বদনাম।  কিন্তু ইচ্ছা করলেই আমরা সময় মতো অনুষ্ঠান শুরু করতে পারি। কেন যে আয়োজকগণ এই বিষয়টি গুরুত্ব দেন না – জানি না।  এমন অভিযোগ প্রচুর শুনেছি যে প্রবাসে বেড়ে উঠা ছেলেমেয়েরা বাঙ্গালি অনুষ্ঠানে আসতে চায় না। অনেকগুলো কারণের মধ্যে সময়মত অনুষ্ঠান শুরু না করা একটি প্রধান বিষয়। যেহেতু অনুষ্ঠান সময় মত শুরু হয় না – তাই শেষও হয় দেরীতে। একটি বিষয় বোধহয় খেয়াল করি না যে মানুষের মনোযোগের একটি সীমাবদ্ধতা আছে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলে তা বিরক্তির সৃষ্টি করবে । অনুষ্ঠানে ভাল কিছু থাকলেও মন তখন ছুটে যেতে চায় অন্যখানে। আমারও তেমন হোল। দ্বিতীয় অংশের গান না শুনে চলে আসতে হয়েছে।
নান্দনিক উপস্থাপনায় আমার আগ্রহ সবচেয়ে বেশী। মঞ্চে এতো লাইট ছিল অথচ ওগুলো ব্যবহার করা হোল না । অনুষ্ঠানের প্রথম অংশে তো ব্যাক লাইট একটিও জ্বালানো হয়নি। আর ঐ যে মঞ্চের ভিতরে ওয়ার্কিং লাইট – ওটা অনুষ্ঠান চলাকালে নিভিয়ে দিলে মঞ্চটি আরো সুন্দর দেখাতো।
অনুষ্ঠান শুরু হোল একটি গান দিয়ে। কিন্তু আমরা যারা হলের ডান দিকে বসেছিলাম তারা সেই গায়কের চেহারা দেখতে পেলাম না। চোখের সামনে দাড়িয়ে ছিল ঐ বক্তৃতা দেয়ার পডিয়াম। ওটার দিকে কেউ বোধহয় নজর দেয়নি। স্পন্সররা খুশি হবে যদি তাদের বিজ্ঞাপন গুলো সুন্দর করে দেখান হয়। পুরো হল অন্ধকার করে বিজ্ঞাপন দেখালে ভাল হতো। যান্ত্রিক গোলযোগ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ওগুলো এড়ানোর জন্য যদি তিনটা থেকে মঞ্চে কেউ সবকিছু চেক করত তাহলে শেষ মুহূর্তের তড়িঘড়ি আর বিলম্ব এড়ানো যেত।
আনন্দের কথা হচ্ছে এই তরুণ আয়োজকগণ ভাল কিছু করতে চায়। নাহলে আমাকে ফোন করে কেন মন্তব্য জানতে চাইবে? আমার বিশ্বাস, একটু যত্ন করে পরিকল্পনা করলে, আর সময় দিলে সিডনিতে ফ্ল লেস অনুষ্ঠান করা যায়।
আমি সবসময় বলি দর্শক হচ্ছে আমাদের দেবতা। অতএব সেই দেবতার জন্য আমাদের প্রসাদ হোক অতি উত্তম।
জন মার্টিন 
অভিনেতা, নাট্যকার, 
নির্দেশক, মনোবিজ্ঞানী 
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments