গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে সামিল করার ইচ্ছা না থাকলেও মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই নিজেকে সমর্পণ করি। “এটাই নিয়ম”-এ প্রথার অনুগত হতে প্রাণপন চেষ্টার সততঃ ও অবিরাম যাত্রায় পরমাত্মাটি যেন আর কখনোই তার সতঃস্ফূর্ত রূপটিতে প্রকাশিত হল না। পরমাত্মাটি মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে জানান দিয়ে যায় যে, সে এই বন্দিদশা থেকে খোলা হাওয়া ও আলোর সান্নিধ্য চায়। আত্মার বহমান রূপটির আধিপত্যের রাজত্বে পরমাত্মাটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকাশে পরাজিত হয়। স্বাধীন কর্মকান্ড সর্বদাই আত্মার পরম অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। বহিঃপ্রকাশে বাধাগ্রস্ত বা প্রভাবিত হওয়া নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার পরিপন্থী। নিরঙ্কুশ স্বাধীনতাহীনতায় পরমাত্মা স্বাভাবিকভাবেই বিক্ষুব্ধপ্রবণ। মানব কর্মকান্ডের সামগ্রিক বিশৃংখলাসমূহ তাই এই অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুব্ধ পরমাত্মাটির বিদ্রোহেরই ফলাফল। বিদ্রোহ দমনে বিদ্রোহ প্রশমিত হয় না। প্রশমন ক্রিয়াতে সন্তুষ্টি সংক্রান্ত উপযুক্ত উপাদান সংবলিত না হলে পরমাত্মা অশান্তই রয়ে যায়। বিবেচনাধীন বিষয়কে যেমন সর্বাঙ্গীন ও নিখুঁত পর্যালোচন ব্যতীত তার উপযুক্ততা প্রদান অসম্পূর্ণ, তমনি আত্মার সাথে সংশ্লিষ্ট সর্বপ্রকার চাহিদার অসম্পূর্ণ বিবেচনায় আত্মার পরম রূপের প্রস্ফুটন অসম্ভব। মানবের আচরনবিধি ও কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রনে বিধিনিষেধ প্রয়োগের পূর্বে মানব পরমাত্মার সুবিশাল ও বিস্তৃত ক্ষেত্রটি কতটা যথার্থ ভাবে বিশ্লেষন করা হয়, তার গুরুত্ব সর্বাগ্রে।
প্রবাহের অনুকূলে ভেসে চলা অনেক সহজ; যেমনটি, সাধারন চিন্তা করাও কষ্টসাধ্য নয়। দশটি মানুষ যে ধারনা পোষন করে, তারা যে জীবন ধারায় অভ্যস্ত, তাতে নির্ভাবনায় সামিল হওয়া যায়। তাতে যদি ক্ষতি বা লোকসানের কোন উপাদান না থাকে, তাহলে অন্যরকম বা নিজের মত চিন্তার বাস্তবায়ন অযৌক্তিক হবে যুক্তিযুক্ত ভাবেই। তাহলে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পূর্বে ক্ষতি সনাক্ত করার দক্ষতা বা উপযুক্ততা অর্জন অপরিহার্য। অন্ধ অনুকরনে তাহলে কি ক্ষতি? একটি উদাহরণ দেয়া যাক,
একদল মানুষকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে সেই সীমার মধ্যেই কতগুলি আইন প্রণয়ন করা হলো এবং সে আইন অনুসারে তাদেরকে চলতে বাধ্য করা হলো। মানুষগুলি জন্ম থেকেই সে সীমানার রীতি-নীতি, বিশ্বাস ও আচরনে অভ্যস্ত ও অনুগত। আইন ভঙ্গে কঠিন শাস্তি- এ ভয়ে তারা ব্যতিক্রম চিন্তা ও কাজে সর্বদাই নারাজ। অনুগত ও অনুকূলে থাকলে সুবিধা, আর ব্যতিক্রম হয়ে প্রতিকূল অবস্থানে থাকলে সুবিধাবঞ্চিত। এ সীমিত সুবিধাটিই যখন তাদের নিকট সুবিধা বা লাভের একশত ভাগ, তখন তাদের কাছে সীমানা বর্হিভূত বাড়তি সুবিধার প্রস্তাবনা অবিশ্বাস্য ও হাস্যকর ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং, সীমিত সুবিধার একভাগের স্খলন তাদের কাছে ক্ষতি বলে চিহ্নিত যা কিনা প্রকৃতপক্ষে সম্ভাব্য অসীম সুবিধা বা লাভেরই ভিত্তিপ্রস্থর এবং যা তাদের আমৃত্যু অজানাই রয়ে যায়। আত্মাটি সীমিত বলেই পরমাত্মার প্রশান্তির উপকরণগুলির খোঁজ আত্মাটি কখনোই পায় না। এ আলোচনায় এটি মনে করার কোন করান নেই যে, এখানে সামাজিক শৃংখলা ভঙ্গে উৎসাহিত করা হচ্ছে; বরং, সামাজিক শৃংখলায় থেকে স্বীয় স্বাধীনতার নিষ্কলঙ্ক পরম রূপটিতে কি উপায়ে অবগাহন সম্ভব, এটি তারই প্রস্তাবনা। নিষ্কলঙ্ক স্বাধীনতার মানে স্বাধীনতা চর্চায় বিন্দুসম অন্যায়ের অনুপস্থিতি; অর্থাৎ, যে চর্চায় অপরের মনক্ষুন্ন হয়, সে চর্চা বর্হিভূত স্বাধীনতা। এখানে সে স্বাধীনতার কথাই বলা হচ্ছে, যে স্বাধীনতা পরমাত্মার জন্য অপরিহার্য কিন্তু তা বিধি-নিষেধ, রীতি-নীতি, ধর্মীয় অনুশাসন ও অন্যান্য বৈরী অবস্থার কারনে প্রকাশে ও ভোগে বাধাগ্রস্ত। স্বাধীনতা অনুশীলনে শিথিলতা বা পারিপার্শিক সহযোগিতা না থাকার কারনে অতৃপ্ত ও বিক্ষুব্ধ আত্মাটি সর্বদাই আরোপিত সীমা অতিক্রম করে সেটি অর্জনে সচেষ্ট থাকে; ফলে, সংঘাত অনিবার্য রূপ ধারন করে। সম্ভাব্য সংঘাত দূর করার জন্য ব্যক্তিগত স্বচ্ছতা, উদারতা ও ন্যায়সংগত স্বাধীনতাবোধ একান্তই দরকার। নিজের জন্য যা যা প্রয়োজন, সম্পর্কিত অন্য সকলের জন্যও সে সমস্ত উপাদান বা পরিবেশের প্রাপ্তি নিশ্চিত করাটি প্রাথমিক কর্তব্য। কারন, দানের বিনিময়েই প্রতিদানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। একতরফা আশা করা বা ভোগের জন্য পদক্ষেপ নিস্ফল বিধায়, এটি বোকামি। অধিকার বঞ্চনার অভিযোগ উত্থাপন পূর্বক সমতুল্য অধিকার প্রদান করা হয়েছে কি না, সেটি বিবেচনাধীন থাকতেই হবে। সংঘাত মুক্ত থাকতে এ অনুশীলনের বিকল্প নেই। সংঘাত বা দ্বন্দ্ব মূলত দ্বিপাক্ষিক; প্রথম পক্ষ হলো স্বাধীনতা চেতনায়, আরোপিত সীমা অতিক্রমকারী, আর দ্বিতীয় পক্ষ পারিপার্শিক বন্ধন সম্পর্কিত উপাদান। বাধাদানকারী উপাদান গুলি সিংহভাগ ক্ষেত্রেই নিজ স্বার্থ ক্ষুন্নের আশঙ্কায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপায়ে সম্পর্কিত ব্যক্তিটিকে সীমাবদ্ধ করার প্রয়াশে সচেষ্ট থাকে এ ভেবে যে, ব্যক্তিটির সর্বসত্তার দখলদারিত্ব উল্লেখিত বাধাদানকারীর; যেরূপ, মানব ইতিহাসের বর্বরতম সময়ে একে অপরের বা একটি শ্রেনী অন্য একটি শ্রেনীর একশত ভাগ দখলদারিত্ব নিয়ে গোলামে পরিনত করতো। স্বাধীনতা হরনের এ দখলদারিত্বের আয়োজন সর্বক্ষেত্রে। পারস্পরিক সম্পর্কের অঙ্গীকার, পারিবারিক দায়বদ্ধতা ও কর্মক্ষেত্রে সর্বাধিক আদায়ের সংস্কৃতি যেন ব্যক্তি সত্তা দখলের আয়োজনে মত্ত; ফলে, বাধ্যগত হয়ে অনুকূলে থাকাই শ্রেয়তর বিধায়, এ পন্থাটিই উপযুক্ত হয়।
জীবনমানের গুনগত দিকটি সময়ের সাথে সাথে অধিকতর বিবেচিত এ কারনে যে, মানব সম্প্রদায় তাদের চিন্তার বিশ্লেষনী সচেতনতায় অনেক বেশী বাস্তবসম্মতভাবেই অগ্রসর। বাস্তবসম্মত হলো- যা একক ব্যক্তির নিষ্কলঙ্ক স্বাধীনতা চাহিদার উপযোগিতায় অনুকূল ক্ষেত্র রচনায় সহযোগী। প্রচলিত কিন্তু অনুপযোগী বিষয়গুলি অপসারণ করতে হলে ব্যতিক্রম চিন্তা ও কাজে উৎসাহিত করার কারন এটিই। শ্রেনী ধারনা বা শ্রেনী সংস্কৃতি বহন করা মানুষের স্বাভাবসিদ্ধ ও সীমাবদ্ধ অনুশীলন। সুতরাং, প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠায় সীমালংঘন শ্রেনীধারনায় আঘাত হানলেও সামগ্রিক কল্যাণে তা সহযোগী ভূমিকা পালন করে। সীমালংঘনে শ্রেনী সমালোচনা অবশ্যম্ভাবী। বড় প্রতিষ্ঠান বা বড় পরিসর যেহেতু সব শ্রেনীরই প্রতিনিধিত্ব করে, সেহেতু সমালোচনার বিষবাষ্প সীমানার বাইরে প্রভাবহীনই থাকে। এছাড়া, শ্রেনী সমালোচনা প্রতিহত করার ক্ষমতাটি উপযুক্ত যুক্তি ও দর্শন দ্বারা লাভ করাও সম্ভব। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্র একটি বিশেষ শ্রেনী, উদাহরণ স্বরূপ ধর্মীয় শ্রেনী বা গোষ্ঠি, বেপরোয়া হয়ে উঠলে কিংবা নিরপেক্ষ ও সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা লঘুতর হলে, সেই বিশেষ শ্রেনীর রীতি-নীতি-আদর্শ সাধারন আদর্শে পরিনত হয়। কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজ স্বাধীনতাবোধ ও পরমাত্মার দিকনির্দেশনায় বিজয় কেতন তুলে ধরাটিই সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ। রীতি-নীতি ও আদর্শ এক কথায় বললেও এর ব্যাপ্তি সুদূরপ্রসারী। এ সমস্ত বিস্তারিত ক্ষেত্রসমূহ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি ধাপে প্রভাব বিস্তার করে। পালন বা অনুসরণ অতঃপর অনুকরণ বাধ্যতামূলেক কেন?-এ অনুসন্ধানের ফলাফল কতটুকু স্বাধীনতা হরণের পক্ষে তা বিচারপূর্বক পরিতেজ্য। একটি প্রেক্ষাপট আলোচনা এ ক্ষেত্রে জরুরী। দ্বায়িত্ব পালনরত একজন সাধারন স্ত্রী সংসারে পদার্পণের প্রথম দিন থেকে এটিই বুঝতে শিখেছে যে, তাকে সংসারের যাবতীয় কর্মযজ্ঞ নিজ হাতেই সামাল দিতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, এটিই তার নতুন জগৎ, এ সবই তার সাধনা এবং এর মধ্যেই তার আনন্দ। নতুন জগতের কর্মযজ্ঞে সাধনায় নিমগ্ন থেকে যে নারীটি আনন্দে দিনাতিপাত করতে পারে, সে-ই সফল। ঘরের বাইরে বিশাল পৃথিবীর সুবিস্তৃত চারণক্ষেত্রে স্বাধীনতার পাখায় চড়ে বিচরণ তার জন্য অসম্ভব। বরং, একেঁ দেয়া আল্পনার সীমা থেকে বিন্দুসম বিচ্যুতিতে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। অবশ্য, এ ঝড়ের তান্ডব শ্রেনীমধ্য সীমার মধ্যেই কার্যকর। আবার একটি পুরুষের ক্ষেত্রে আরোপিত আচরনবিধি বা দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য সমূহ তাকে কতটুকু স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করার সুযোগ দিচ্ছে, তা বিবেচনাধীন থাকা একান্তই জরুরী। পুরুষ শাসিত সমাজ যেমন শুধু পুরুষের স্বার্থ ও স্বাধীনতার প্রাধান্য দেয়, তেমনি নারী শাসিত সমাজও নারীর স্বাধীনতা ও স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়; কিন্তু, যে সমাজ মানুষকে সীমাবদ্ধ করে মানুষের পরমাত্মার স্বার্থ ও স্বাধীনতাকে হরন করেই চলেছে, সে সমাজের শোষন থেকে মুক্তির জন্য নিজেকেই মুক্ত ও স্বাধীন করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় নেই। শ্রেনীর উর্ধ্বে, সমাজের উর্ধ্বে উঠে এসে স্বীয় পরম চেতনাকে সমুজ্জ্বল করার মধ্য দিয়ে এভাবেইতো পরমাত্মার গুনগত মানকে পুনরুদ্ধার সম্ভব।
প্রতিটি মানুষই এক একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটিও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত অনেকগুলি বিভাগে বিভক্ত। সবগুলি বিভাগের কর্মপরিধি বিচারপূর্বক এর ক্রিয়াকলাপ সমূহ সমান তালে এগিয়ে না নিতে পারলে, বিভাগগুলি একে একে অকার্যকর হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির মালিক হয়েও কি কি বিভাগ আছে, তা তার কাছে অনুদঘাটিত থাকে। উদঘাটিত থাকলেও সহস্র বিভাগের গুটি কয়েক বিভাগ ব্যতীত, অন্য সকলগুলিতে অক্ষমতা ও অভ্যাসগত কারনে বা সীমালঙ্ঘনে সমালোচিত হওয়ার দ্বিধায়, পদচারনা অনুপস্থিত থাকে; কর্মপরিচালনাতো দূরের কথা। স্বাধীন আত্মার সুবিশাল ক্ষেত্রটি এভাবেই সংকুচিত হতে থাকে। নিজ প্রতিষ্ঠানটিকে স্বতন্ত্র ধারায় স্বীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট অনুসারে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে, তার ব্যার্থতা নিশ্চয়ই অন্য কারো নয়। নিজ প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের পাশাপাশি অন্য মানবিক প্রতিষ্ঠানগুলি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কিনা, তা বিবেচনাধীন রাখাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নিষ্কলঙ্ক স্বাধীনতার কথা একারনেই বলা হচ্ছে। নিষ্কলঙ্ক স্বাধীনতা মানে, যে স্বাধীনতা চর্চায় অন্যের ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। স্বীয় নিষ্কলঙ্ক স্বাধীনতাটি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সম্পর্কযুক্ত মানুষগুলিরও স্বাধীনতার নিষ্কলঙ্ক রূপটির বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা কর্তব্য। এ ক্ষনে যা হারিয়ে যায়, পরক্ষনে তা উদ্ধার সম্ভব নয়। স্বীয় পরমাত্মার আকুতি যদি অবহেলিত হয়, তাহলে এ শুধু নিজেরই বঞ্চনা নয়; বরং, এ বঞ্চনা বাহিত হয় প্রজন্মান্তরে। ফাইন-টিউনিং বলতে ইংরেজীতে একটি শব্দ আছে, যার সঠিক ও উপযুক্ত শব্দ বাংলায় নেই; তবে, এর মানে হলো গুনগত মানের সর্বোৎকৃষ্ট অবস্থা লাভের জন্য সুক্ষতম সংশোধনী মূলক সর্বশেষ ছোঁয়া। এ ছোঁয়ার স্পর্শ যত স্বল্প সময়ে লাভ হয়, ততই দ্রুত পরিপূর্ণতার শিখরে পৌঁছানো যায়। মানবসংশ্লিষ্ট উপাদানগুলির পরিপূর্ণতা দানের মধ্যেই যে আমাদের পরমাত্মার প্রশান্তি নিহিত।
দীন মোহাম্মদ মনির
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।