স্মৃতির নুড়ি পাথর-এস এম জাকির হোসেন

  
    

খুব একাকী কোন এক নির্জন ক্ষণে কিংবা পড়ন্ত বিকেলের কোন এক বিষণ্ণ বেলায় ঘুরে বেড়াই আমার চেতনার রঙে রাঙানো সবুজ প্রান্তরে। খুঁজে ফিরি মনের আঙিনায় সযত্নে জমিয়ে রাখা অতীতের সবুজ হিরণ্ময় মূহুর্তগুলোকে, যেখানে ডুব দিয়ে অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারি দীর্ঘ রজনীর বিনিদ্র প্রহরগুলো।  বইয়ের পাতা উল্টানোর মত করে বার বার ফিরে তাকাই আমার ফেলে আসা স্বপ্নাতুর সময়গুলোতে। আর সেই পাতাঝরা সোনালী দিনগুলি চুপিসারে ঘুম ভাঙ্গানিয়া গান শুনিয়ে যায় আমার কানের কাছে।

বনের মুক্ত হরিণের মত দুরন্ত শৈশবের হারিয়ে যাওয়া সময়ের অনেকটাই পার করেছি অতি প্রিয় আমার গাঁয়ে। আমাদের ঘরের পেছন দিকটায় ছিলো ছায়াঢাকা এক টুকরো সবুজ চত্বর; যার পুরোটা জুড়েই ছিলো নানান রকমের গাছগাছালির সমারোহ। মূলত এটাই ছিল আমার বিচরণভুমি। একটি ছোট পুকুরও ছিল। মহিলাদের দৈনন্দিন ঘরের কাজে ব্যবহারের জন্যে। পুকুরটার চারপাশে ফলফলাদির গাছের অভাব ছিল না। আম, জাম, কাঠাল, জামরুল আরও বেশ কিছু ফলের গাছ। একেবারে বাড়ির শেষ প্রান্তে পুকুরের পাড়ে ছিলো একটি হিজল গাছ। গাছটা পুরোটাই পুকুরটার উপরে হেলে ছিল। আর আমি যখন-তখন সেই হেলানো গাছে উঠে দোল খেতাম। বর্ষাকালে হিজল গাছটা ছোট ছোট লাল ফুলে ভরে যেত, আর সকালবেলা পুকুরটা হিজলের ফুলে লাল হয়ে থাকতো।  ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পুকুরের পাড়ে চলে যেতাম।  ছোট ছোট কোমল লাল ফুলগুলো হাতে নিয়ে দেখতাম। বাবা মাঝে মধ্যেই রেগে উঠে বলতেন, ‘ছেলেটা জঙ্গলের মধ্যে রোজ ওদিকে যায় ক্যান? ঐখানে তো সাপ-কোপের আখড়া।’ আসলেই পুকুরের ঐদিকটা কিছুটা নির্জন, তাই মাঝে-মধ্যে সাপ দেখা যেতো, তবে আমি কোনদিন দেখিনি।

মাকে আমার মনে পড়ে না। অনেক চেষ্টা করেও কোনদিন তাঁর মুখচ্ছবিটা মনে করতে পারিনি। স্বজনদের কাছ থেকে শুনে শুনে তাঁর একটি ছবি মনে মনে কল্পনা করে নিয়েছিলাম কেবল। তবে মায়ের জন্য বুকের ভেতরে হুহু করা কান্নাটা জমানো ছিল, কেউ দেখতে পায়নি কোনদিন। মা না থাকায় মামা-খালাদের আদরের কোন অভাব ছিল না, বরং মাত্রাটা একটু বেশিই ছিল। তাই বাবা যখন দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেন, তখন নানী অনেকটা জোর করেই আমাকে তাদের কাছে নিয়ে এলেন। তাঁর মৃত মেয়ের একমাত্র চিহ্ন, সৎ মায়ের অবহেলায় বড় হবে এটা তিনি মানতে পারলেন না। নানাবাড়িতে সবকিছুই ছিল কিন্তু আমার ভেতরটা কেবলই বাবার জন্য ছটফট করতো। আর মনটা ছুটে যেত ঘরের পাশের সেই সবুজ চত্বরে। হিজল গাছটার কাছে। আমার মন ভোলানোর জন্য নানীর চেষ্টার কোন কমতি ছিল না। প্রতি রাতে আমার গল্প শোনানোর বায়না মেটাতেন, যাতে বাবার কথা ভুলে থাকতে পারি। বাবা অবশ্য প্রতি সপ্তাহেই আসতেন। আর সপ্তাহ শেষে আমার ভেতরটাও তাঁর আগমনের প্রতীক্ষায় ছটফট করতো। বাবার গায়ের গন্ধ, তাঁর উষ্ণ বুকের পরশের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো মনটা।

নানাবাড়ির অদূরেই ছিলো একটি নদী- কীর্তনখোলা। খুব অল্পদিনের মধ্যেই ওর সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই একছুটে চলে যেতাম নদীর পাড়ে। তখনও সূর্য্য ওঠেনি। নদীর ওপর দিয়ে বয়ে চলা ঠাণ্ডা হাওয়া স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে যেতো গায়ে। পূব দিগন্তে লাল টকটকে সূর্য্যটা যখন উঁকি দিত, মনে হতো এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর হয় না। প্রায় দিনই সূর্য্য ওঠা অবধি থাকতাম নদীর পাড়ে। প্রতিদিন বিকাল কিংবা সন্ধ্যায় আমাদের খেলার জায়গা ছিল সেই কীর্তনখোলার পাড়ে। জ্যোৎস্না রাতে নদীটা যেন নতুন করে সাজতো। তখন আকাশে থাকতো পূর্ণ চাঁদ আর নদীটাকে যেন জোছনার চাঁদর দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হতো। সে এক অসাধারণ দৃশ্য! আমি আজও ভুলতে পারিনি।

সময়ের ঘড়ি একটু একটু করে এগোয়। ধীরে ধীরে প্রাইমারি স্কুলের শেষের দিকে চলে এলাম। মামা সিদ্ধান্ত নিলো মামীকে ঢাকা নিয়ে আসবে। যথারীতি নানী এবং আমাকেও তাদের সঙ্গী হতে হলো। আবার বিচ্ছেদ! এবার কীর্তনখোলাকে বিদায় জানাতে হবে! কত জায়গায় কত স্মৃতি! সেই বিমূর্ত প্রহরগুলো সময়ে-অসময়ে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে। মেঠোপথের বাঁকে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের ছায়ারা মনে করিয়ে দেয়- ঠাকুরমার ঝুলি, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, কাজলা দিদি, ঝিঁঝিঁপোকা, ঘাস ফড়িং আর জোনাক পোকার আলোর বিচ্ছুরণ। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ গায়ে মেখে সেই শ্যামল প্রান্তরের বুনোফুল, দূর্বাঘাস আর শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি মাড়িয়ে, ধবল কাশের বন ছাড়িয়ে অপু-দুর্গার মত ছুটতে ছুটতে সময়ের ভেলায় চড়ে একদিন নোঙর করি এই শহরে।

সেই কোন ছোট্ট বেলায়, প্রাইমারী স্কুল জীবন শেষ করে গাঁয়ের মায়া কাটিয়ে প্রিয় বন্ধুদের ছেড়ে মামার সাথে পাড়ি জমিয়েছিলাম ঢাকায়। নিজের চেনাজানা পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে এই প্রথম বাইরে পা রাখা। সেই ছোট্ট কচি মনটা শুধুই হাহাকার করত- নিজের গাঁ, গাঁয়ের আপন-মানুষগুলোর জন্যে। মনে পড়ে- কতদিন একা একা কেঁদেছি!

তারপরের গল্পটা একেবারেই অন্যরকম। ধীরে ধীরে ঢাকা আমার প্রিয় শহরে পরিণত হলো, ওর সাথে আমার গাঁটবাধা সম্পর্ক হয়ে গেলো। এই শহরের অলি-গলি-রাজপথ, অচেনা-অজানা মানুষজন কখন যে খুব আপন হয়ে যায় বুঝতেও পারিনি! বন্ধুবান্ধবের ভিড়ে একসময় মন থেকে বিস্মৃত যায় আমার গ্রাম, আপন করে নিই এখানকার সবকিছু।

তারপর বুড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়ালো, এই শহরের বুকেই কাটিয়ে দিলাম প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা আমার প্রিয় শৈশব-কৈশোরের বাকিটা সময়। কত ভাললাগা, আনন্দ-বেদনার স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওর সাথে! দিন তারিখ ঠিক মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে শীতের এক স্নিগ্ধ সকালে মিষ্টি উষ্ণ রোদের আলো গায়ে মেখে মামার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করি আমার শহুরে নতুন স্কুল জীবনে। যেখানে কাটিয়েছি আমার স্কুল ও কলেজের সোনালী সময়গুলো। স্কুলের চমৎকার দিনগুলির কথা মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ে, আনন্দ-বেদনার দীর্ঘ সাতটা বছর বন্ধুদের সাথে একই প্রতিষ্ঠানে কাটিয়েছি। ধীরে ধীরে স্কুল-কলেজ শেষ করে এখান থেকে বেরিয়ে একেকজন একেক দিকে!

কলেজ জীবন শেষ করেছি সেই কবে! তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। দীর্ঘদিন পর, গতবছর হঠাৎ একটা কাজে কলেজ চত্বরে গিয়ে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ে কলেজের ছোট বড় অনেকগুলো মাঠ, ঘাট বাঁধানো পুকুর, যেখানে হেলায়-খেলায় পার করেছি কত সময়! পুকুরটা আজ আর নেই। শীতের সন্ধ্যায় ব্যাডমিন্টন খেলায় জমজমাট থাকতো সামনের এসেম্বলির মাঠটি, যেখানে এখন সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে কলেজ ভবনটি। আর আমাদের সময়কার ক্লাসরুমের সামনের খোলা বারান্দাগুলো এখন গ্রীলের খাঁচা। আমাদের সময়টা চিন্তা করে মনে হল- কত চমৎকার কেটেছে আমাদের শৈশব! বাস্কেট বল খেলার মাঠে প্রতিদিন সকালে জমে উঠত আমাদের ফ্রিজবি খেলা। যখন হোস্টেলে থাকতাম মাঝরাতে গানের আসর বসত ছাদে, আড্ডায়-গানে পার করেছি কত নস্টালজিক সময়!

ঢাকা শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে কত স্মৃতি! চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকের পাড়ে গানের আড্ডা বসতো! সংসদ ভবন মাঠে কত সময় কাটিয়েছি! কি জমজমাট আড্ডা জমতো ওখানে তখন! প্রতিদিন বিকেলটা ছিল কোলাহলমুখর। এখন তো সংসদ ভবনের ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। বন্ধুরা মিলে বুড়িগঙ্গার পাড়ে, আশুলিয়ায়, রমনার বটমূলে, নিউমার্কেট বই চত্বরে, টি এস সি- কত জায়গায় কত স্মৃতি! মনে আছে অনেকদিন অফিস শেষ করেও নিউমার্কেটে চলে যেতাম।

মামুনদের বাসার ছাদ ছিল আমাদের প্রতি সন্ধ্যার বিনোদন কেন্দ্র। প্রতিদিন আমরা সবাই আসতাম আড্ডায়। কথায়, গল্পে কখন যে সময় পার হয়ে যেত আমরা টেরই পেতাম না। হাসেমিয়া হোটেলের পুরী আর ওর ভাবীর হাতে মাখানো মুড়ির স্বাদ কতকাল পাই না! বর্ষণমুখর কোন বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন দেখি সামনের রাস্তায় কিশোর-তরুণদের ছোটাছুটি কিংবা ফুটবল খেলার দৃশ্য, নিমিষেই মনটা চলে যায় সুদূর অতীতে। ওদের সেই আনন্দ আয়োজনের সাথে নিজেকে মিশিয়ে দেই। পিয়াসী মনটা পেতে চায় সেই কিশোর বেলার স্বাদ।

এখনো আমি খুঁজে বেড়াই আমার কিশোর বেলার হারিয়ে যাওয়া এক টুকরা নীল আকাশ, ব্যস্ত ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে মিশে থাকা আমার দুরন্ত বালক বেলার ছায়া। কোন উদাস ক্ষণে সুযোগ পেলেই স্মৃতির মধ্যে ডুব দেই। নিমেষেই চলে যাই ছেলেবেলায়, গাঁয়ের মেঠোপথে। কি নেই সেখানে! কচি ধানের শীষে কিংবা ঝিঙে মাচায় ফড়িঙের ওড়াওড়ি, মনের সুখে ছোট্ট পাখি টুনটুনি’র এ গাছ থেকে ও গাছে লাফালাফি। ভোরের সবুজ ঘাসের বুকে স্বচ্ছ শিশির বিন্দুর উপর নরম রোদ পড়ে চিকচিক করে ওঠা আর প্রিয় জায়গাগুলোতে বন্ধুদের আড্ডা।

এখন সেই বন্ধুরা সবাই যে যার মত ব্যস্ত। চাকরি-ব্যবসা, সংসার-ছেলে-মেয়ে। আজ আমাদের সময়ের বড় অভাব। তাই স্মৃতি হাতড়ে আতিপাতি করে খুঁজে বেড়াই সেই মুহুর্তগুলোকে। ভাবতে ভাল লাগে, হঠাৎ কখনো কারো ডাকে ছেদ পড়ে সে ভাবনায়। ঘোর কেটে যায়, আমি ফিরে আসি বাস্তবে।

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments