মেঘনা তনয়া কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক পিয়ারা বেগম রচিত গল্প সমগ্র “হঠাৎ একদিন” পড়ে শেষ করলাম। ১৩ টি গল্পের সমন্বয়ে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ এবং উপস্থাপনার মধ্যে মুনসীয়ানার ছাপ দৃশ্যমান।
প্রথম গল্প “হঠাৎ একদিন ” শিরোনামে বইটি পড়ে আমি উপভোগ করেছি । অদিতি ও চৈতি দুই বান্ধবী প্রথম জীবনের প্রেমের ব্যর্থতা এবং বিবাহিত জীবনে তাদের স্বামী ও প্রেমিকের ক্রস সম্পর্কের কারণে মুখোমুখি হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া দুই বান্ধবীর বিব্রতকর অবস্থানের এক চমৎকার উপস্থাপনা এ গল্পটি। আসলে সত্যিকারের ভালোবাসার কোন মৃত্যু নেই। তবে সমাজ সংস্কারের কাছে মানুষ জিম্মি হলেও মনকে কখনো আটকাতে পারে না এ গল্পে এটাই প্রস্ফুটিত হয়েছে।

“নীরব যাতনা” গল্পের মূল চরিত্র নীলু বিশ্বাস করে এবং ভালোবাসে তার স্বামী অভিক মাহমুদকে। কিন্তু স্বামী বিশ্বাস ভঙ্গ করে লিপ্ত হয় পরকীয়ায়। অন্যদিকে রুহিনীও অবিবাহিত হিসেবে ভালোবাসে অভিক মাহমুদকে। আমাদের এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অভিক মাহমুদের মতো অনেক পুরুষই গোপনে এ জাতীয় অনৈতিক সম্পর্কে জড়িত থাকতে দেখা যায়। মেয়েদের এ ” নীরব যাতনা ” গল্পে বতর্মান সমাজেরই একটি অব্যক্ত গল্প।
“মেয়েটি এখন কী করবে” গল্পটির অবতারণা হয়েছে নব্যবিবাহিত এক সুন্দরী মেয়ের স্বামীর পুরুষত্বহীনতার গোপন তথ্যটি বাসের সহযাত্রীর নিকট প্রকাশের মাধ্যমে। মূলত: আমাদের সমাজে দাম্পত্য জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি এখনো অতি গোপনীয় এবং একান্ত ব্যক্তিগত হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। প্রকাশ করলে নির্লজ্জ ও বেহায়া বলে গালি দেয়া হয়। তাই অনেক মেয়েই মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু সময় শারীরিক চাহিদার চাপে পরে অনৈতিক পথ বেছে নেয়। শুরু হয় দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়ন। গল্পকারকে ধন্যবাদ এ জাতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কম আলোচিত বিষয়টি অবতারণা করার জন্য।
“চান রাইতের ঝড়” গল্পের নায়িকা কর্মজীবী নারী মৌসুমীকে গল্পকার প্রচলিত পরিবার তথা সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী চরিত্রে উপস্থাপন করেছেন। এ গল্পে আধুনিক একক পরিবারে প্রবীণ নাগরিকদের একাকিত্ব, আবাহমান বাংলার বউ-শাশুড়ির টক- ঝাল সম্পর্ক, পারিবারিক বন্ধন এবং সব কিছু ছাপিয়ে শিশুদের প্রতি ভালোবাসা তথা আমাদের গ্রামীন সমাজ ও পারিবারিক সংস্কৃতির এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি “চান রাইতের ঝড়”।
“প্রণয়ের স্মারক” গল্পে আরেফা এবং ডাক্তার মাহমুদের কৈশোরের প্রেম এবং পরবর্তী জীবনে ক্যান্সার রোগী হিসেবে কৈশোরে ভালোবাসার স্মারক হিসেবে উপহার দেয়া নাকফুলসহ আরেফার সাথে পরিচয়ের এক করুণ উপখ্যান। গল্পটি বিচ্ছেদের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে। এর বিষয়বস্তুর গভীরতা প্রশংসনীয় এবং “নাকফুলটি” মাহমুদ-আরেফার কৈশোর জীবনের প্রণয়ের যথার্থ স্মারক।

ভালোবাসা, রোমান্স, বিচ্ছেদ, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা, সময়ের ব্যবধানে নতুনকে আকড়ে ধরা, ভালোবাসার জন্য দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয়গুলো মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখির মধ্যেও যে সমভাবে বিদ্যমান “অদ্ভুত ভালোবাসার গল্পে ” পায়রা-পায়রির মাধ্যমে গল্পকার চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন।
“শেষে অবশেষে ” শুধু হনুফা, মজিরুন, মাহিনুরদের গল্প নয়। এ হনুফারা স্বামী ও শাশুড়ি কর্তৃক অত্যাচারিত হয়েছে অনাদিকাল থেকে এবং আজও হচ্ছে। তবে গল্পকার বরকত ও তার মাকে শাস্তি দিয়ে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। অন্যদিকে প্রান্তিক জনপদের গরীব, বিধবা এবং ছুটা বোয়া মায়ের সন্তান হয়েও উকিলে পরিণত হওয়া এবং বিচারপতি স্বামীর স্ত্রী হয়ে অদম্য সফলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মাহিনুর। ইহা সমাজের মেধাবী এবং অদম্য নারীদের জন্য অনুকরনীয় হতে পারে। “শেষে অবশেষে” গল্পের মাধ্যমে।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। ৩০ লাখ শহীদ এ ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ । আর মুক্তিযুদ্ধেরই এক অজানা গল্প “বিজয় আমার স্মৃতির স্মারক”। পাক সেনাদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে অনেক বীরাঙ্গনা জন্ম দিয়েছেন যুদ্ধ শিশু। এ গল্পের জুলেখা এবং বিজয় তাঁদেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা মঞ্জিলের মতো অনেক মহান ব্যক্তিত্বও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরে, যারা যুদ্ধ শিশুদের দায়িত্ব নিয়ে তাঁদেরকে নিজের সন্তান হিসেবে বড় করেছেন। সুতরাং এদেশের লাখো জুলেখা এবং হাজারো যুদ্ধ শিশু বিজয়ের গল্প। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় ও স্বাধীনতার গল্প। পিয়ারাকে ধন্যবাদ এতো সুন্দর একটি গল্প উপস্থাপনের জন্য ।
মেঘনার পল্লীগ্রামে আগে কিছু মানুষ ছিলেন যাঁরা মজা করে সন্ধ্যা রাতে মজার মজার গল্প বা কিচ্ছা বলতেন। এমনি এক উপখ্যান “এক আরব্য বৃদ্ধের গল্প”। পিতা, পুত্র এবং দাদা-দাদিকে নিয়ে তিন প্রজন্মের অতিশয় প্রবীণ ব্যক্তিদের পারিবারিক বন্ধন, গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা , সম্মান ও সমীহ প্রকাশ পেয়েছে এ গল্পে । পাশাপাশি বড়দের হাতে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ / কমান্ড আমাদের বতর্মান আধুনিক পরিবারের জন্য শিক্ষনীয় হতে পারে ।
গ্রামের এক জোলার মস্তকবিহীন লাশ নিয়ে গ্রামের মাতাব্বর এবং জোলার পরিবারের সদস্যবৃন্দ লাশ সনাক্ত করতে গিয়ে যে সব অদ্ভুত এবং গবেটমার্কা কথাবার্তা বলে, তারই এক হাস্যকর, মজার বর্ননা “গবেট নম্বর ওয়ান”। তবে আমাদের বর্তমান আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজেও সত্যের মুখোমুখি হতে গিয়ে এ জাতীয় অসুস্থ “গবেট নম্বর ওয়ান” এখনো বিদ্যমান।
“বগার বাপের কিচ্ছা ” আবহমান বাংলার চিরায়ত গল্পের অন্যতম । গ্রাম্য এক ধনী কৃপন গৃহস্থ, যিনি জামা গায়ে না দিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখতেন। স্ত্রীকে রান্নার জন্য খুব হিসাব করে তেল এবং মসলা দিতেন। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। ভালোবাসার রাগ-অনুরাগের রোমাঞ্চকর মূহুর্তে কাব্যিক বয়ানে তারা কথাবার্তা বলতেন। যা পড়ে পাঠক তৃপ্তির হরেকরকম স্বাদ পাবেন। আবার মৃত্যুর পূর্বে এ কৃপণ ধনী গৃহস্থ তাঁর বগার বাগের তিন ভাগের এক ভাগ দান করে গিয়েছেন মানব কল্যাণে।
“কুসুমী আর লালচান” দুটি মোরগ- মুরগীর ভালোবাসা, রোমান্স, পরিবার এবং বেদনার গল্প। একটি গ্রামীন পরিবেশে মোরগ ও মুরগী পালনের বাস্তব এক উপখ্যান এ গল্পটি। কুসুমী নামক এক মুরগীকে নিয়ে দুরের আত্মীয়ের বাড়িতে যাত্রা, পথিমধ্যে আর এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাত্রি যাপন। সেখানেই কুসুমী আর লালচানের পরিচয় থেকে মুধুর ভালোবাসায় রূপ নেয়। হঠাৎ কুসুমীর পরিবর্তে প্রেমিক মোরগ লালচানকে জবাই করার জন্য নিয়ে যাওয়া। এভাবেই” কুসুমী আর লালচানের” ভালোবাসার বিচ্ছেদের করুণ চিত্র গল্পটিতে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন গল্পকার।
“অচ্ছুত” বানু, অছিম এবং পুত্র মনুকে নিয়ে দরিদ্র সংসার বানুর জীবন সংগ্রামের এক করুণ চিত্র। ছোট্ট মনুটা খালি গরুর গোশত দিয়ে ভাত খেতে চায়। এদিকে স্বামী অছিম একটা বাদাইম্যা। একদিন কাজ করেতো দুই দিন বসে থাকে। এরই মধ্যে করোনার আক্রমণ। আক্রান্ত হয়ে মারা যায় মনু ও বানু। একা করোনামুক্ত হয়ে অসহায়ের মতো বেঁচে থাকে অছিম। এভাবেই “অচ্ছুত” গল্পটির সমাপ্তি। এ শুধু বানুর জীবনের গল্প নয়। করোনার কারণে এ জাতীয় অসংখ্য বানুর সংসার ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং সময়ের দাবিতে “অচ্ছুত” একটি চমৎকার গল্প।
সর্বোপরি ১৩টি গল্প সমন্বয়ে “হঠাৎ একদিন” একটি সার্থক গল্প সমগ্র। পাঠক “হঠাৎ একদিন” গল্পগ্রন্থটি পড়ে আবহমান কাল থেকে সাম্প্রতিক কালের গল্পগুলোতে সুখদুঃখ, বিরহ-দহন তথা রম্যরসবোধের এক অসামান্য পঞ্চব্যঞ্জনার স্বাদ আস্বাদনে তৃপ্তি পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।
হঠাৎ একদিন : পিয়ারা বেগম, প্রকাশক: রাত্রি প্রকাশনী, অস্ট্রেলিয়ায় প্রাপ্তিস্থান: প্রশান্তিকা বইঘর
বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মোসলেহ্ উদ্দিন, পি এস সি, বি এন (অবসর প্রাপ্ত )। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নৌবাহিনী কলেজ ঢাকা এবং সাবেক অধ্যক্ষ কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ ও নৌবাহিনী কলেজ চট্রগ্রাম এবং সাবেক পরিচালক নৌশিক্ষা পরিদপ্তর, নৌবাহিনী সদর দপ্তর, বনানী, ঢাকা।
