
গত কয়েকদিনে অনেকেই জিজ্ঞেস করেছে, ‘হাওয়া কি আসলেও ভাল সিনেমা? নাকি এটাও হুজুগের হাওয়া?’
এবার একটু ঝেড়ে কাশি। হাওয়া কেন দেখবেন সেটা নিয়ে কয়েকটি মন্তব্য করি।
তাহলে শুরু থেকে বলছি।
ছোটবেলা রূপকথা শুনেছেন? পড়েছেন?
ওই যে বেহুলার বাসর ঘরে সুই এর চেয়ে সরু ছিদ্র দিয়ে সাপ ঢুকে বেহুলার বরকে ছোবল দিল। তারপর শুরু হোল বেহুলা-লক্ষিন্দরের গল্প। কিংবা ঐ যে এক ভূত বউ সেজে চুলার মধ্যে পা ঢুকিয়ে রান্না করে আর হাত রাবারের মত লম্বা করে গাছ থেকে লেবু পেড়ে জামাইয়ের মাথা খাওয়ার জন্য তৈরি হয়। এই সব রূপকথার গল্পগুলো সত্যি না। কিন্তু আমাদের মনের অলিগলিতে নাড়া দেয়। আমরা কল্পনার জগতে ভাসতে থাকি। আমাদের বেড়ে উঠার গল্পে এমন কত লোককাহিনী লেপটে আছে- আমরা টের পাইনা।
এমন গল্পগুলো শুনে বা পড়ে আমরা প্রশ্ন করিনা। কারণ জানি এগুলো সত্যি ঘটনা নয়। আমাদের কল্পনার জগতে নিয়ে যাবার উপকরন। শুধু কি ঠাকুরমার ঝুলির গল্পই কি অবিশ্বাস্য? ভেবে দেখুন কত সাইন্স ফিকশন আছে, আষাঢ়ে গল্প আছে, নানা ধর্মে নানা ঘটনা আছে – যেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ আমরা করি না। কেউ বিশ্বাস করে, আবার কেউ করে না।
মুল কথা হচ্ছে – হাওয়া এমন একটি কল্পকাহিনী। অতএব এই গল্প সত্যি নাকি মিথ্যা এই বিচারের দায়িত্ব নিয়ে সিনেমা দেখতে গেলে ঠকে যাবেন। কারণ যে সিনেমাটি বানিয়েছে সে নিজেও এই ঘটনার সত্যতা দাবী করেনি। তাহলে আপনি কেন করবেন?
তাহলে কি দেখবেন?
আপনি আরাম করে বড় পর্দায় দেখবেন এই গল্পটি কেমন করে বলা হোল?
হ্যা……। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি – এই ছবিটি দেখে আপনার মনে হবে, ‘একটা সিনেমা দেখলাম।’

বিশাল ক্যানভাস, চমৎকার ফ্রেমিং, কালারটোন, এডিটিং সহ একটি ভাল সিনেমায় যা যা দরকার – প্রায় সব কিছু আছে। অনলাইনে একটু খোঁজ করুন- হাওয়ার অনেক রিভিউ পাবেন। সেখানে এই সব টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে অনেকে লিখেছে। আমি সব কথার সাথে একমত নই। যেমন, ছবির প্রথম এক ঘন্টা নাকি ‘স্লো’, ছবিতে নাকি প্রচুর গালাগালি ছিল। আচ্ছা বলুন তো, আপনি যদি জেলেদের একটি গল্প সমুদ্রের পাড়ে বসে দেখতে চান – তাহলে পায়ে তো একটু বালু, পানি, ময়লা লাগবেই। স্যুট-বুট পড়ে গল্প শুনতে চান – আপত্তি নেই। কিন্তু আপনাকে গল্প শুনানোর জন্য গল্পের চরিত্রগুলো লুঙ্গি পালটিয়ে স্যুট পড়বে নাকি? জেলেরা যে ভাষায় কথা বলে আমাদের তো শুনতে হবে। ওগুলো গালি নয়। ওগুলো ওদের ভাষা।
এই কল্প কাহিনীর আড়ালে যে আমাদের জেলেদের জীবনযাপন লুকিয়ে আছে সেটা নির্দেশক চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবে না। ওগুলো আপনাকে খুঁজে নিতে হবে। তবেই না সিনেমা দেখার আনন্দ।
তাহলে মুল কথাটা কি?
মুল কথা হোল এই যে – ছবি দেখার পর – আপনার মনে হবে – বাহ্ একটা সিনেমা দেখলাম। তারপর একটি বিস্ময় নিয়ে – নিজের মনকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘এটা আমাদের ছেলেমেয়েরা বানিয়েছে?”
‘কি ভাবে বানালো?’
সমুদ্রের শুটিংগুলো কি হলিউডের কোন স্টুডিও র মধ্যে গ্রীন এফেক্ট দিয়ে করেছে? ওই যে ‘লাইফ অফ পাই’ এর বিহাইন্ড দ্যা সিন এর কত ভিডিও ইউ টিউব এ আছে। একবার ভাবুন – আমাদের ছেলেমেয়েগুলো এই গভীর সমুদ্রে হাঙ্গর এর ভয় বুকে নিয়ে শুটিং করেছে। ওখানে কি সেফটি এরেঞ্জমেন্ট ছিল জানি না। তবে অনুমান করি – হলিউডের মত নয়। কিছু ছবিতে দেখলাম বাসের চাকার টিউব দিয়ে সাঁতার কাটছে, দুই ড্রামের মধ্যে ক্যামেরা বসিয়েছে। কিন্তু কাজের কোয়ালিটি দেখুন। আর ভাবুন…।
পুরো গল্পটি ঐ ট্রলার ঘিরে। এমন ছোট একটি ট্রলারের গল্প দুই ঘণ্টা ধরে বলল – এবং সেই গল্প আমরা আগ্রহ নিয়ে দেখেছি। কাজটি কি সহজ ছিল? কিন্তু নির্দেশক কাজটি করে দেখালো। গল্পের সুতগুলো ছিল – পরিমিত। কাউকে কম বা বেশি নয়- বরং যাকে যতখানি জায়গা দেয়া দরকার- পরিচালক ঠিক তাই করেছে। সবার অভিনয়ের কথা নানা রিভিউতে পাবেন। চঞ্চল চৌধুরী, সুমন আনোয়ার, শরিফুল রাজ, রিজভি, নাসির, মাহমুদ – এই নৌকার পালে হাওয়া লাগিয়েছে চমৎকার অভিনয় দিয়ে। নাজিফা তুশি কেবল নৌকায় উঠল – কিন্তু নৌকার পালে হাওয়া লাগাতে পারল না। আহা কি যে মায়া লাগলো। ঠিক এই কাস্টের জন্য আমি পরিচালককে কিছু কম নম্বর দিব। মেয়েটি এই ছবিতে যে সুযোগ পেয়েছিল – আর কবে এমন চমৎকার ক্যানভাস পাবে – জানি না।
সাদা কালা গান নিয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে। একটি গানের শুরুতে এবং মাঝে মিউজিক থাকে। খেয়াল করুন- এই সাদা কালা গানেও এমন মিউজিক আছে। গানের শুরুতে, গানের মাঝে সেই মিউজিক বাজে। কিন্তু সেই মিউজিক হয়েছে মানুষের গলা, আর কথা বার্তা দিয়ে। দুই মিউজিসিয়ান ইমন চৌধুরী এবং রাশেদ শরীফ শোয়েব জাদু দেখিয়েছে। সাদা কালা গানটির কথাগুলো শুনুন। আহামরি কিছু নয়। কিন্তু জাদুর ছোঁয়ায় গানটি নিয়ে এমন মাতম উঠেছে।
আচ্ছা – সমুদ্রের মাঝে জেলেরা কি ঝড়ে পড়েছে কখন? আহা আমি যে এই সিনেমায় ঝড় দেখলাম না। ওটা হলে – আমার কল্পনার জগত একটু নড়ে চড়ে বসতো।
আর একটি কারণে এই সিনেমাটি দেখা উচিত।
আমি হাওয়া দেখে পরিস্কার বুঝেছি ‘হকার’ আর ‘ডিরেক্টর’ এক নয়।
খেয়াল করবেন অনেকে সিনেমা বানানোর আগেই এমন ভাবে ঢাক -ঢোল পিটানো শুরু করে যে – আমরা ভাবি, না জানি কি সিনেমা উনি বানাবেন? আমাদের প্রত্যাশার বেলুন ফুলতে ফুলতে এমন হয় যে সিনেমা হলের গেট দিয়েও ঢুকতে পারি না। কিন্তু তাদের সিনেমা দেখার পর মনে হয়- এইটা কি দেখলাম?
‘হাওয়া’র পরিচালক পরিস্কার বলেছে যে ও হাওয়া সিনেমা দেখার জন্য কাউকে জোড় করবে না। কাউকে বলবে না যে ওর সিনেমা খুব ভাল হয়েছে। বরং বলেছে, ‘আপনার ভাল লাগলে – অন্যদের বলুন’।
মেজবাউর রহমান সুমন ‘হকার’ না। ও ‘ডিরেক্টর’। ডিরেক্টর এর কাজ ছবি তৈরি করা। ছবি নিয়ে ‘হাইপ’ তৈরিতে ব্যস্ত থাকলে – ভাল ছবি তৈরি হবে কি ভাবে?
এবার বলি – হাওয়া নকল কিনা?
যারা নকল নকল বলে গলা ফাটিয়েছেন – তাদের কিচ্ছু বলার নেই। বলব – বাজার থেকে একটি আয়না কিনুন – তারপর নিজের চেহারা দেখুন। আর ভাবুন – জগতে এতো কিছু থাকতে – ভাল একটি কাজ নিয়ে হিংসা করছেন কেন? যারা এই কাজটি করেছেন তারা পাপ করেছেন। আর এই পাপ মোচনের এক মাত্র উপায়- নিজের পয়সায় টিকেট কিনে দশজনকে নিয়ে সিনেমাটি দেখে আসুন। আর ছবি দেখার অভ্যাস শুরু করুন। কারণ আরো ছবি আসছে। আপনি না দেখলে – অন্ধকারেই বসে থাকবেন।
হাওয়ার পুরো টিম – যারা সামনে এবং পিছনে ছিলেন সবার জন্য ভালবাসা।

জন মার্টিন
নাট্যজন, নির্দেশক, অভিনেতা
প্রিন্সিপাল সাইকোলজিস্ট
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।