হুমায়ূন আহমেদ, হিমু ও আমি এবং একটি কনফেশন । ফাহাদ আসমার

  
    
ফাহাদ আসমার

হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন আমার সবচেয়ে অপছন্দের এমনকি ঘৃণিত লেখক। তাঁর সাথে আমার ঘৃণা আর শত্রুতার শুরু সেই পঞ্চম শ্রেণীর মাঝামাঝি থেকে। সবেমাত্র গ্রাম থেকে আহত ঘুঘুর মত শহরে এসেছি। গ্রামের অবারিত বিল, মাছের সাথে কুস্তি, সদ্য কাটা ধানক্ষেতে কাদামাটিতে মাখামাখি, ফুটবল আর বাতাসের আগে ছুটে চলা গোল্লাছুট, হাডুডু সারাদিন মন কাঁদায়। আমার গ্রামের সেই ছোট্ট স্কুলের অবারিত স্বাধীনতার বদলে শহরের স্কুলের খাঁচায় পোরা জীবন জাহান্নামের আজাব মনে হত। স্কুল শেষে ব্যাগের ভারে ক্লান্ত হয়ে চাঁদপুরের অলিতে গলিতে খুঁজে ফিরতাম গ্রামের হাসিখুশি লুঙ্গি কাছা দেয়া বন্ধুদের, সব পরিচিত মুখের সস্নেহ হাসি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে পাখির বাসা বোনা দেখা, ভর দুপুরে ভূতের বাড়িতে হানা দেয়া অথবা সাপের ডিম খোঁজার দুঃসাহসিক অভিযান।

স্কুলের টিপটপ ছেলেমেয়েদের ভিড়ে নিজেকে ভিনগ্রহের প্রাণী মনে হত। তাদের আলোচনার কিছুই বুঝতাম না, সেখানে ছিল ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট, টিভি সিরিজ, কার্টুন, হারকিউলিস, জ্যাকসন, ম্যাডোনা। আর ছিল টিভিতে হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’। আমার বাসায় তখনো টিভি কেনা হয়নি। টিভি বলতে তখনো আমি বুঝতাম প্রতি শুক্রবার গ্রামের বাজারে ব্যাটারিচালিত ১৪ ইঞ্চির একটা সাদাকালো টিভিতে সিন্দাবাদ আলিফ লায়লা।

স্কুলে সারাদিন সবাই ‘আজ রবিবার’ নিয়ে আলোচনা করতো। আমার ‘আনিছ’ নামটা হঠাৎ একদিন নতুন উপদ্রব হিসেবে দেখা দিল। শুরু হল আজ রবিবারের বোকা চরিত্র ‘আনিছ’ নিয়ে আমাকে ক্ষেপানো। কিছুই বুঝতাম না কিন্তু প্রচণ্ড লজ্জা পেতাম আর খেপতাম। খ্যাপানোর সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল জাহিদ হাসানের একটা ডায়ালগ, “তিতলি ভাইয়া, কঙ্কা ভাইয়া আকাশে না আজ এত্তো, না না এত্তো বড় একটা চাঁদ উঠেছে”। তার উপর কঙ্কণ নামে একটা মেয়ে ছিল ক্লাসে, জীবনটা সেখানেই মোটামুটি ছারখার। সবার অত্যাচারে মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতাম, স্যারদের কাছে বিচার দিতাম, সবাই আরো পেয়ে বসলো। ক্লাসের বেঞ্চে, টয়লেটে কাঁচা হাতে লেখা থাকতো, “আনিছ+কঙ্কণ”। ছেলে মেয়ে সবার কাছেই শুধু খ্যাপানোর জন্য অল্পদিনেই জনপ্রিয় হয়ে গেলাম। জানলাম কোন এক হুমায়ূন আহমেদ নাকি কি এক নাটক বানাইছে, মনে মনে হুমায়ূন আহমেদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতাম। তখনো প্রচুর বই পড়ি কিন্তু বই বলতে বুঝতাম টিনটিন, চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিংকী, ফ্যান্টম, শির্শেন্দু, সুকুমার, তিন গোয়েন্দা আর জাফর ইকবাল। যে কোন কারণেই হোক, হুমায়ূন আহমেদের লেখার সাথে তখনো পরিচয় হয়নি।

হাই স্কুলে উঠলাম। আমার খাপছাড়া পাগলাটে স্বভাবের জন্য একদিন কৃষি শিক্ষার অতিপ্রিয় ফরহাদ স্যারের কাছে আদর করে ডাকা নতুন নাম পেয়ে গেলাম ‘হিমু’, আমি নাকি পুরোই হিমুর মত। এটাকে অপমানজনক হিসেবে নিলাম, ব্যাস শুরু হল আরেক যন্ত্রণা। হিমুর যত উদ্ভট ডায়ালগ আমার বইয়ে খাতায় এখানে ওখানে পোলাপান লিখে রাখতো খ্যাপানোর জন্য, এমনকি রূপা নামে আমার একটা প্রেমিকাও জুটে গেলো। সেই রূপার নাম দিয়ে মাঝে মাঝে ভুল বানানে লেখা নানা রকম রগরগে চিঠি পাওয়া যেত আমার স্কুল ব্যাগে। খোঁজ নিয়ে জানলাম যত নষ্টের গোঁড়া আবার সেই হুমায়ূন আহমেদ।

আমাকে বুঝানোর জন্য একদিন এক বন্ধু হিমুর একটা বই দিয়ে বললো, পড়ে দেখ, তোর হিমু ভালো লাগবে। কিসের কি, কয়েক চ্যাপ্টার পড়ে মনে হল, হিমু নামের কোন একটা বদ্ধ উন্মাদ ছেলেকে পচানোর জন্যই এই বই লেখা। কিছু কিছু মিলে যায় কিন্তু আমিতো এতো পাগল না। ছিহ, এই হিমুর নামে তারা আমাকে ডাকে! সেই থেকে হুমায়ূন আহমেদ আমার দুচোখের বিষ। যতবার হিমু ডাক শুনতাম ততবার প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে হুমায়ূন আহমেদের গুষ্টি উদ্ধার করতাম। সেই থেকে পৃথিবীর তাবৎ বই গোগ্রাসে গিললেও সচেতনভাবেই হুমায়ূন আহমেদ থেকে দূরে থাকতাম। যদিও কিভাবে জানি স্কুলের শেষের দিকে তাঁর লেখা সায়েন্স ফিকশন আর মিসির আলি গল্পগুলো পড়ে ফেলেছি, এখানেতো আর হিমু নেই।

চাঁদপুর ছেড়ে ঢাকায় চলে আসার পর এক বান্ধবী বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের নতুন বই কিনে আমাকে উপহার দিল, নাম ‘হলুদ হিমু কালো র‍্যাব’। প্রিয় বন্ধুর উপহার তাই নাক মুখ বুজে চিরতার রস গেলার মত করে নিয়ে নিলাম। পড়বো না করেও কয়েক পৃষ্ঠা এলোমেলো উল্টাতেই এক জায়গায় চোখ আটকে গেলো, জাতীয় সংগীতের ছন্দে একটা প্যারোডি কবিতা, র‍্যাব সংগীত;
“আমার কালো র‍্যাব, আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার অস্ত্র, তোমার বুলেট, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি”।

বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, এই লোকের এত্তো বড় সাহস! আমার দেশের জাতীয় সংগীত প্যারোডি করে, হুমায়ূন আহমেদের সাথে এইবার পুরোপুরি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো।

অনেক বছর পরের কথা, আমি তখন এই প্রশান্ত নগরের নির্বাসিত জীবনে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ একদিন জানলাম হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার ধরা পড়েছে, কেন জানি খুব মন খারাপ হল, সম্ভবত জীবনভর তাকে ঘৃণা করার কারণেই। সেই আবেগেই হয়তো সব ফেলে গোগ্রাসে একদিন হুমায়ূন পড়া শুরু করলাম, এমনকি সিডনী বই মেলা থেকে জীবনে প্রথমবার হুমায়ূন আহমেদের লেখা কোন বই ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ ১০ ডলারে কিনে ফেললাম। আরে, হিমু তো ভালোই লাগছে, আমার মধ্যে কেমন একটা ঘোরলাগা ভাব, মুখোমুখি হিমু আর আমি। এই প্রবাসে বই পাওয়া কষ্টকর, তাই এর ওর থেকে চেয়ে এনে, দেশ থেকে বহুকষ্টে আনিয়ে এমনকি অনলাইনে এখানে ওখানে খুঁজে সব পিডিএফ নামিয়ে ফেললাম। যেই হিমুকে একদিন মনে প্রাণে ঘৃণা করতাম সেই হিমুকেই বড় আপন মনে হত। অনেকটা অপরাধবোধ থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দেশে ফিরেই প্রথম সুযোগে হিমুর স্রস্টার সাথে দেখা করবো, হিমুর প্রতি কেউ যে বছরের পর বছর ধরে ঘৃণা পুষে রাখতে পারে গল্পের বাইরের সেই গল্পটা তাকে শোনাবো ভেবেছিলাম।

হিমুর মাঝে যখন নিজেকে হারানো শুরু করেছি হঠাৎ সব কিছু অর্থহীন করে চলে গেলেন হিমুর স্রস্টা। এখনো মাঝেমাঝে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবি, আহা, হিমু হতে পারাটা নেহায়েৎ মন্দ ছিলো না।

হে জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ, তুমি যেখানেই থাকো, হাজার হাজার হিমুদের হৃদয়ে তুমি বেঁচে থাকবে আজীবন। বেঁচেথাকবে ভালোবাসায়, রিক্ত দীর্ঘশ্বাসে

তুমি শান্তিতে থেকো গল্পের জাদুকর।

ফাহাদ আসমার: কবি ও কথাসাহিত্যিক, সিডনি। 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments