[ শিল্পী রহমান: গল্পকার, কবি, সংস্কৃতিকর্মী, কাউন্সেলর ও গবেষক। স্থায়ী নিবাস ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়ায়। কর্মসূত্রে এখন রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। তাঁর প্রকাশিত ৫টি বইয়ের মধ্যে ‘মনের ওজন, মানসিক অসুস্থতায় কাউন্সেলিঙের প্রয়োজনীয়তা’ বইটি দেশে বিদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে । যুদ্ধোত্তর জীবন সংগ্রাম নিয়ে উপাখ্যান ‘ যুদ্ধ শেষে যুদ্ধের গল্প’। নিবন্ধ সঙ্কলন “সম্ভাবনার প্রতিচ্ছায়ায়’, পরবর্তীতে ‘দিন বদলের ফর্মুলা’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার বই ‘পাহাড় হবো’ এবং ‘পথের অপেক্ষা’ নিখুত ভাবে ছুঁয়ে যায় মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতি। প্রশান্তিকায় সম্প্রতি একটি গল্পসহ দুটি লেখা লিখেছেন। অঞ্জলি লহ.. কলামে শিল্পী রহমান নিয়মিত লিখবেন।]
জয়ী হওয়া খুব আনন্দের একটা বিষয় কিন্তু হেরে যাওয়া সামলে নিতে পারা একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দক্ষতা। এটা ভুলে গেলে আমরা বিপদে পড়বো।
আবারো হেরে যাওয়া সামলাতে না পারার একটা দূর্ঘটনা পৃথিবীকে থমকে দিলো।
২০১৭ সালে ক্যানাডাতে ২১ বছর বয়সের একটি উজ্জল নক্ষত্রের করুন পরিণতি হয়েছিলো। ছেলেটি তার হেরে যাওয়া গ্রহন করতে ব্যর্থ হয়েছিলো বলে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলো। প্রথমে ডিপ্রেশন, তারপর নেশা, গড়াতে গড়াতে স্কিজোফ্রেনিয়া এবং তারপর সে তার এই হতাশাজনক জীবন আর বয়ে বেড়াতে চায়নি বলে খুব দুঃখজনক পরিনতি বেছে নিয়েছিল, আত্মহত্যা।
২রা অগাস্ট, ২০১৯ তে আরও একটি হেরে যাবার ঘটনা থমকে দিলো পুরো মানব জাতিকে। কিন্তু এবার নিজেকে নয় ২৩ বছরের একটি ছেলে তার বাবা, মা, নানী এবং বোনকে সুপরিকল্পিত ভাবে হত্যা করেছে। এই ছেলেটি তার সফল না হতে পারার গ্লানি বাবা মায়ের সামনে লুকোতে চেয়েছিল।
বাবা মায়ের সামনে হেরে যাওয়াটা লুকোতে ইচ্ছে করবে কেন?
বাবা মা সারাজীবন সন্তানের সফলতার আনন্দে আপ্লুত থাকে সেটা খুবই স্বাভাবিক। ছোট বেলা থেকে অনেক যত্নে লালন পালন করা নিজের সন্তানের সাফল্যতো বাবা মায়েরই সাফল্য, এটাই স্বপ্ন, এটাই জীবন । বাবা মায়ের সেই আনন্দমুখরিত মুহূর্ত, সেই হাস্যজ্জ্বল মুখাবয়ব, গর্বের সাথে আরও দশজনকে তাঁর সন্তানের সাফল্য ভাগ করে নেবার গল্প সন্তানকেও অনেক ভালোলাগা দেয়। এই আনন্দধারা যেন কখনো না থেমে যায় তারই চেষ্টা চলতে থাকে একের পর এক। কিন্তু এই চেষ্টার পেছনের মুল লক্ষ্যটা কি থাকে? বাবা মাকে বা অন্যকে খুশী করা? সেটাই যদি সন্তানের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেটা ওদের ওপরে অনেক মানসিক উৎকণ্ঠা বা চাপ সৃষ্টি করবে।
গর্ব আর সফলতার সুখে সন্তানের ওপরে সেই চাপের কথা ভুলে যাওয়াটাও হয়তো অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। আমরা ভাবি এই বয়সে একটু চাপ থাকবেই, বড় হলে ওরাই তো ভালো থাকবে । কিন্তু এর বাইরেও ওদের এই উৎকণ্ঠা বা মানসিক চাপটার কথা মনে রাখতে হবে নাহলে সেটা হবে অস্বাস্থ্যকর কারণ সবাই একরকম নয়, একেকজনের ধারণ ক্ষমতা ভিন্ন।
লক্ষ্য রাখতে হবে, খুব গভীরে ওদের কোন অস্থিরতা আছে কিনা, অগোচরে কোন স্বপ্ন ভঙ্গ হচ্ছে কিনা । একটা মানুষের দুর্বলতা থাকবেই, ভুল থাকবেই, হেরে যাওয়া থাকবেই, সফলতার পাশাপাশি এইসব বিষয়গুলো বাসায় তার পরিবারের সাথে সে ভাগ করে নিতে পারছে কিনা সেইদিকে নজর রাখতে হবে। আর সেই জায়গাটা তৈরি করে দেবার মতো কঠিন কাজটাই করতে হয় তার অভিভাবকের।
যেসব আচরণ বা ইচ্ছা নিজের বাড়িতে স্বীকৃতি পায়না কিন্তু করবার ইচ্ছে থাকে প্রবল, সেইসব আচরণ বা ইচ্ছা লুকিয়ে করবার প্রবণতা দেখা দেয় অনেক মানুষের মধ্যে , আর খুব স্বাভাবিকভাবেই সেটা ঢাকতে মিথ্যের অবলম্বন নিতে হয়। আবার যা করতে একদমই ইচ্ছে হয় না কিন্তু সেটাকেই প্রাধান্য দিতে হয় সবার আগে, তখন কেউ কেউ হয়তো প্রতিবাদ করে বসে আর তা নাহলে গোপনে কষ্ট পেতে থাকে। এই ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করা বা প্রকাশ করাটাই বরং স্বাস্থ্যকর। বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবার একটা সুযোগ থাকে, আর কথা বলতে পারলে তাদের গাইড করা করা যায়। কিন্তু যে কোন প্রতিবাদ করছে না, খুব শান্ত, বাইরে থেকে কিছুই বুঝবার উপায় নেই এবং মাথা নিচু করে সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে । ক্লাসেও হয়তো খুব ভালো ফলাফল করছে, তাদের নিয়ে তো কারো ভাবনাই থাকে না। ভালো মানুষের মুখোশ পড়বার (যা হয়তো বাসায় বেশ সমাদৃত) অভ্যাসও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে (নেতিবাচক অর্থে নয় যদি বাস করে একজন খুব অসুখি বা দুঃখী মানুষ তাকে আমরা কিভাবে সাহায্য করবো?
২৩ বছরের মিনহাজ জামান, দেখতে শুনতে যেমন শান্ত ভদ্র, স্বভাবেও তাই ছিল। পুরো পরিবারটিই ছিল খুব সাধারণ এবং সুখী। অভিযোগ করবার মতো কেউ কিছু পায়নি শুধু মিনহাজ ছাড়া। মিনহাজ মুখে কোনদিন কিছু বলেনি বলে কেউ কিছু জানতেও পারেনি। সত্য গোপন করবার একটা অসাধারণ দক্ষতা ছিল ওর ভেতরে। বাবা মায়ের পঁচিশতম বিবাহ বার্ষিকীতে ২০ মিনিট ধরে তাদের সম্মধ্যে ভালো কথা বলেছে ছেলেটি অথচ ওর ভেতরে তখন চলছিল খুন করবার পরিকল্পনা। মনে মনে কোন অভিযোগ তো নিশ্চয়ই ছিল ওর মনের গহীনে, যার কারণে এক এক করে খুন করেছে ৪ জন কাছের মানুষকে। কিন্তু ওকে দেখে কেউ তা বুঝতে পারেনি, সবাই ওকে বেশ ভালো ছেলে বলেই জানতো।
ও সবার সামনে ভালোই থাকতে চেয়েছে। একটা সফল এবং ভালোর মুখোশ পড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে ৩ বছর । একটা পরিবার মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় ছায়া। সেই পরিবারেই এই ছেলেটি কোন ছায়া খুঁজে পায়নি, নিজেকে আড়াল করে রেখেছে এবং সত্য গোপন করেছে ৩ বছর ধরে। বাবা মা কি আর ছায়া দেয়নি? অবশ্যই দিয়েছে কিন্তু ওর জন্য তা ছায়া ছিলোনা, ছিল শ্বাসরুদ্ধকর মিথ্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা জীবন।
ও পাশ করেনি এবং ড্রপ আউট করেছে , সে কথা শুনলে হয়তো ওর পরিবার কিছুই বলতো না , অথবা বলতো আমরা জানি না। উনাদের প্রতিক্রিয়া কি হতো তা আমরা আর কোনদিন জানতে পারবো না কিন্তু মিনহাজের মনে যে একটা আশঙ্কা ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। সেটা কি ভয়, নাকি লজ্জা , নাকি নিরাশ করবার আশংকা সেটা হয়তো জানা যাবে কোন এক সময়। কিন্তু সেই অনুভূতি যেটাই হোক না কেন তার বিশালতা ছিল অনেক। এতো বেশী যে, ৪ জন সবচেয়ে কাছের মানুষকে কিভাবে তার ব্যর্থতার সত্য কথা বলবে বা মুখোশ খুলে তাদের সামনে দাঁড়াবে সেই সাহস তার ৩ বছরেও হয়নি। তার কাছে ৪ জন কাছের মানুষ খুন করা সহজ হয়েছে তবুও সেই সত্য মোকাবেলা করবার সাহস হয়নি। এই চশমা পড়া সুবোধ বালকটি দিনের পর দিন এদের খুন করবার পরিকল্পনা করেছে তবুও সত্য বলবার সাহস সঞ্চয় করতে পারেনি। এর গভীরতা কি বোঝা যাচ্ছে?
খুব সাধারণ এবং আদর্শ পরিবারের একটি সহজ সুন্দর ছবি। বাবা কাজ করে সংসার চালান। মা সংসারের দেখাভাল করেন, বাড়িতে নানী আছেন, ছোট বোন পড়াশুনা পাশে একটা পার্ট টাইম কাজও করে, কোথাও কোন খুত দেখা যায় না , একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট ছিমছাম একটি পরিবার। তারপরেও কি গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল ওদের ভবিষ্যৎ যা কেউ ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি।
আর দশটা পরিবারের মতো জামান সাহেবও তার সন্তানদের পড়াশুনা করাচ্ছিলেন যেন তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। ছেলেটা ছাত্র ভালো ছিল বলেই ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছিলো। কি কারণে ফলাফল খারাপ হয়েছিলো সেটা জানতে পারলে আরেকটু খোলাসা হতো। ওর কি ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়বার ইচ্ছা ছিল না? হয়তো অন্য কোন পছন্দ ছিল। জীবনের প্রথম হেরে গিয়েছে বা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, সেই খবরটা তার পরিবারের কাছে গোপন করবার জন্য কি বিপুল আয়োজন । কিন্তু কেন ?
এই প্রশ্নের উত্তর পেলে আরও কিছু হয়তো শিখতে পারবো আমরা যা আমাদের পথ চলাতে সাহায্য করবে। আর যেন কারো পরিবারের এমন পরিণতি না হয় সে চেষ্টা করা যেতে পারে।
মিনহাজ বলেছে ” আমি হতাশায় নিমজ্জিত, নাস্তিক হয়েছি। তাই হত্যার পরিকল্পনা করেছি। আমি চাইনি আমার মতো সন্তানের জন্য বাবা-মা লজ্জিত হোক। ” ( রানবাংলা ২৪) । এই কথাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে বলবো, এই যে এই কথাগুলো বাবা মা কে বলবার জায়গাটা থাকা খুব জরুরী ছিল। শুরুতেই বলেছি বাবা মা কে কোন সন্তান নিরাশ করতে চায় না, সন্তানেরা চায় আজীবন বাবা মা তাদের সব কর্মকাণ্ডে খুশী হোক, গর্বিত থাকুক। কিন্তু সেটা যদি নিজের কারনেই না করতে পারে তাহলে মুখ দেখাবার জায়গা থাকে না আর। মিনহাজের ছিন না।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে ২২ বছরের ছেলে হাসিব বিন রাব্বি খুন করেছিল তার বাবা মা কে , কারণ তার অস্বাভাবিক সেক্সচুয়াল ওরিয়েনটেশন উনাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এই ছেলেটিও বেশ ঠাণ্ডা স্বভাবের ছিল এবং কারো সাথে খুব একটা মিশতো না। এই হত্যাকাণ্ডের সময় মেঝেতে এবং দেয়ালে বেশ কিছু কথা লিখা ছিল, সেখানে একটি চিরকুটও পাওয়া যায়। এতে লেখা ছিল ‘দুঃখিত, আমার প্রথম খুনটি ছিল বিরক্তিকর।’ এ ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তারা ওই বাড়ির দেয়ালে লেখা আরেকটি বার্তা দেখতে পান। বার্তাটি এমন, ‘তোমার মতো আমি মিথ্যাবাদী হতে পারব না। আমি ওদের (মা-বাবা) অজ্ঞাতে অথবা সম্মতি ব্যতীত কাউকে ভালোবাসতে পারব না।‘ ( প্রথম আলো ২০১৬) । এই ধরণের কথাগুলোকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রত্যেকটা কথার পেছনে যে কষ্ট বা রহস্য লুকিয়ে আছে তা জানা জরুরী। উড়িয়ে দিলেই সত্য পালিয়ে যায়না। সত্য মানুষের মনের ভেতরেই বাস করে যা তাদেরকে প্রতি মুহূর্তে তাড়িত করে বেড়ায়, অবজ্ঞা করবার কোন উপায় নেই।
উন্নত দেশ গুলোতে বাস করে অন্তত পক্ষে মানসিক দিকগুলোর দিকে তো নজর দেয়াই যায়। সবকিছু হাতের কাছেই পাওয়া যায়, শুধু মনের খবরের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে আরেকটু।
আমাদের সন্তানদের হেরে যাবার কৌশল শেখানো খুব জরুরী। একটা মানুষ সারাজীবন সবকিছুতেই শুধু জয়ী হতে পারে না। সম্ভব না । তাই পরিবারের তরফ থেকেই প্রথমে সন্তানের হেরে যাওয়া বা ব্যর্থতা মেনে নেবার মন তৈরি করতে হবে । মানুষ হিসেবে নিজের সন্তানই অকস্মাৎ অনেক কিছুই আমাদের সামনে এনে হাজির করতে পারে, বাবা হিসেবে আমাদের সেসব মোকাবেলা করতে হতে পারে। সেটার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, এটাই জীবন এবং এটাই সভ্যতা। আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখার চাইতে, বাস্তবতার ছোঁয়া থাকা স্বাস্থ্যকর সবার জন্য।