হোক কলরব : গানে গানে বন্ধন যাক টুটে । অজয় দাশগুপ্ত

  
    

[ পথ প্রডাকশন্স আয়োজিত হোক কলরব অনুষ্ঠানটি ছিলো সিডনির স্মরণকালের মধ্যে অন্যতম সফল অনুষ্ঠান। গত ৪ মার্চ ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস’র স্যার জন ক্লেন্সি অডিটোরিয়ামে কানায় কানায় পুর্ণ প্রায় এক হাজার দর্শক উপভোগ করেন অনুষ্ঠানটি। দর্শকেরা জনপ্রিয় শিল্পী অর্ণব ও তাঁর ফ্রেন্ডস’র পরিবেশনার আগে সিডনির স্থানীয় দুটি ব্যান্ডের গানও খুব পছন্দ করেন। ব্যান্ড দুটি ছিলো Rockajon ( সদস্যরা হলেন- জিউ, নওরোজ ) এবং The Crew ( সদস্য- মিতুল, লরা, আদিল এবং আহসানুর )। দুটি ব্যান্ডের পরিবেশনার সময় দর্শকেরা মুহূর্মুহ করতালি দিয়ে তাদের উৎসাহ দেন। বিরতির একটু আগে মঞ্চে আসেন শায়ান চৌধুরী অর্ণব, সহধর্মিনী সুনিধি নায়েক, জুয়েল পান্থ কানাই, ফায়জান রশিদ আহমদ, সাদুল ইসলাম, শায়ন্তন মানসাংগ, ইমরান আহেমদ খান খাদিম। দর্শকেরা পুরো সময়টা শিল্পীদের সাথে সাথে কন্ঠ মিলিয়ে, হাত তালি দিয়ে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন। অনুষ্ঠানটির ইভেন্ট ও টিকেটিং পার্টনার দেশী ইভেন্টস, টাইটেল স্পন্সর HSD Finance. মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিলো প্রশান্তিকা, মুক্তমঞ্চ, প্রভাতফেরী ও গানবাকশো। 

অনুষ্ঠান দেখে নিচের লেখাটি লিখেছেন কলামিস্ট ও ছড়াকার অজয় দাশগুপ্ত।] 


এখন আর একা কোথাও যাইনা । গাড়ি চালানোর ক্লান্তি আর সঙ্গীহীন যাত্রা ভালো লাগেনা । সব জায়গায় স্ত্রী যাবে এমন ভাবাও অন্যায়। বাড়ির কাজ, ঘরের দায়িত্ব, বয়স সব মিলে একসাথে যাওয়াটা ক্রমেই হয়ে উঠছে দুর্লভ। তবে সময় থেমে থাকে না। সময় ঠিক করে দেয় সঙ্গী ।

এখন আমার ভ্রমণ সঙ্গী গামা আবদুল কাদির। গামা ভাই সফল সংগঠক। প্রবীণ মানুষ। তাঁর সাথে যাতায়াতের শর্ত গাড়ির চালকের আসন তাঁর আর ভ্রমণের সময়কালে আড্ডা ও সিঙ্গারার দায়িত্ব আমার । সেভাবেই আমরা গিয়েছিলাম পথ প্রডাকশন্সের সর্বশেষ আয়োজন ‘হোক কলবব” অনুষ্ঠানে ।

কানায় কানায় হলভর্তি এক সহস্র দর্শক।

আমরা যখন পৌঁছাই তখন সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে । বুঝতে পারছিলাম খানিকটা বিলম্ব হয়ে গেছে আমাদের। জন ক্লেনসি’র বিশাল মিলায়তন যে কানায় কানায় পূর্ণ থাকবে সেটা আগেই টের পাচ্ছিলাম । অর্ণব, সুনিধি এবং পান্থ কানাই । এরা এখন পপুলার সাংঘাতিক এফেক্টিভ গাইয়ে । তাদের গান বয়স নির্বিশেষে বাংলাদেশীদের প্রাণের আরাম। ঢোকার রাস্তা থেকে দুয়ার পর্যন্ত সারি সারি মাথা । নতুন যেটা চোখে পড়লো সুবেশী তরুণ তরুণীদের ধুমায়িত উল্লাস । ধোঁয়ার কুন্ডলি আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছিল আপন আনন্দে।

অর্ণব

ভেতরে ঢুকে দেখি স্থানীয়দের গান গাওয়া সারা। উপস্থাপক শুভজিৎ তার স্বভাবসুলভ কথার তোড়ে একে একে মঞে ডাকছিল অতিথিদের। বলাবাহুল্য একেকটি নাম যেন এক একটা ডিনামাইট বিস্ফোরণ। প্রত্যেকটি নামের সাথে সাথে দর্শকের উল্লাস শেষতক আগ্নেয়গিরির মত ফেটে পড়েছিল অর্ণবের নাম ঘোষণার সাথে সাথে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না এরা কেমন গায়। বিশেষ করে কোক স্টুডিও চালু হবার পর থেকে এদের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি।

সুনিধি

শুরুতেই আমি অভিনব আনন্দঘন বাদ্যযন্ত্রীদের অভিনন্দন জানাই । একজন তরুণ এত ভালো বিউগল বা সেক্সোফোন বাজাতে জানেন এটা দেখা ও শোনা আমার জন্য নতুন কিছু। ড্রামের মতো বিশাল আওয়াজের যন্ত্রও যে পরিমিত হতে পারে সেটা বুঝলাম সেদিন। সুনিধি নায়েকের গান আমি সামনাসামনি এই প্রথম শুনলাম। শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। জানলাম, কলকাতায় সুনিধির জন্মদিনে অর্ণব বই উপহার দেন। বন্ধুত্বের আনুষ্ঠানিকতা মূলত এখানেই। যদিও তখনো প্রণয় উপস্থিত হয়নি, তবে খুনসুটি চলত। সুনিধি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সেই ছোট ছোট মুহূর্ত শেয়ার করেছেন। অর্ণব নাকি সুনিধিকে হাতের আঙুল দিয়ে বন্দুকের মতো তাক করে ঠিসিয়া করে দেন। সুনিধি বলেন, ‘আমিও ওর দিকে ঠিসিয়া করে দিই। মূলত প্রণয়ে এভাবেই হেমন্ত শেষে শীতের কুয়াশার মতো জড়িয়ে পড়ে অর্ণব-সুনিধির জীবনে। একত্রে বেঁধে ফেলে কুয়াশার জালে। আর প্রণয় থেকে পরিণয় ঘটে, এক হেমন্তের দুপুরে।’ সুনিধি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে নন, আসামের মেয়ে। শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেই রবীন্দ্র প্রেম, আর রবীন্দ্রপ্রেম থেকেই অর্ণব, এখন যার তিনি ঘরণী। এ তার পরিচয় । গান ? ও যে মানে না মানা রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানটি দিয়েই শুরু করেছিল সুনিধি । বহুল শ্রুত আর প্রিয় গান কানে পৌঁছানো সহজ কিছু না। তবু বলব, ভালো গায় সুনিধি । তার উচ্চারণ ও সুরের প্রতি মনযোগ আমার ভালো লেগেছে । কিন্তু ঐ যে হাহা ফাগুণ করিছে হাহা ফুলের বনে, মানেই তো হাহাকার । সে হাহাকারটি পাইনি । তবে এটা নিশ্চিত সময় ও পরিনতি তাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারবে।

অজয় দাশগুপ্ত ও পান্থ কানাই।
অর্ণব তো তার নামেই সমুজ্জ্বল। তার গান শুনবো কি ? প্রতিটি গানের সাথে সাথে সিডনির তারুন্যের উল্লাস আর কন্ঠ মেলানোয় ফেটে পড়া মিলনায়তনে গানের কথা ভেসে গেছিল । কানে আসার আগেই হারিয়ে যাচ্ছিল।  তার যে রবীন্দ্রসঙ্গীতটি নতুন প্রজন্মে অসম্ভব জনপ্রিয় সে গানটিতে তাকে খুঁজছিলাম । মাঝে মাঝেই আসলে অর্ণবকে পাওয়া যায় সে গানে । চিরদিন হয়তো পাওয়া যায়ও না । কিন্তু মানতেই হবে সুর বাণী আর মাধুর্য তার আয়ত্বে । সে রাতে রাত একটু বেশী হলেও শো চুরি করে নিয়েছিল কানাই। আমাদের চট্টগ্রামের জুয়েল কানাই। এখন সে পান্থ কানাই ।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় শুভজিৎ ভৌমিক
কানাইয়ের গান শোনার পর আমি নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছি এই যে তার গানে অনুষ্ঠান মাতলো মিলনায়তন পাগল হয়ে উঠেছিল এ কি জনপ্রিয় গানের পুরষ্কার ? না কি তার গায়কি ? ওরে নীল দরিয়ার বেলায় যদি তা মেনেও নেই চুমকি চলেছে একা পথের বেলায় তা মনে হয় নি। বরং মনে হয়েছে তার কন্ঠের জাদুতেই মজে গেছিলাম আমরা। উঁচুতেও এত সাবলীল আর মাধুর্য খুব কম রক গায়কের কন্ঠে পাই। কানাই যে আগামী দিনের আজম খান এটাই মনে হয়েছে আমার।
The Crew
পথ প্রডাকশন্স আসলে কে ? কি তাদের পরিচয়? শাওন অরিজিৎ, ইফতেখার সাকিবেরা সেটা বুঝিয়ে দেয় বারবার । এবার তাদের অন্যতম কর্ণধার ফয়সাল হোসেন যখন মঞ্চে কথা বলছিল তখন যেন আরো খোলাসা হলো বিষয়টা । কারো কাছে তারা আয়োজক, কারো বেলায় পরিকল্পক আর আমাদের মত বয়সী প্রবাসী এবং সিডনির বাংলাদেশীদের জন্য পথ প্রডাকশন্স মূলত: এক আনন্দময় গর্বের উত্তরাধিকার । যারা আমদের সংস্কৃতিক দুর্ভাবনা প্রবাসে বাংলাদেশের গান বাজনা টিকবে কি না এই ধারণা একেবারে বদলে দিয়ে বারবার প্রমাণ করছে তাদের অস্তিত্ব। সপ্রাণ আয়োজনে পথ যে পথিককে পথ দেখাবে এটা এখন নিশ্চিত ।
Rockajon

“হোক কলরব” নামটি চাইলেই হতে পারতো অন্যকিছু। তাতে পরিণত আর সংহত হতো আয়োজন। হয়তো পেতো নতুন মাত্রা । ভবিষ্যতে খাবার পরিবেশন, দর্শক নিয়ন্ত্রণ আর গুঞ্জন চিৎকার সীমাবদ্ধ ও সংহত করার তাগিদ আছে । নয়তো এতো ভালো আয়োজনও প্রশ্নের মুখে পড়ে । তাদের জন্য অপার শুভ কামনা ।

ছবি কৃতজ্ঞতা- পথ প্রডাকশন্স। 

বিজ্ঞাপন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments