একদিন আগে পেরিয়ে এলাম একটি বছর। ২০২০। দিন যায় মাস যায়- আসে নতুন বছর। প্রতিটা বছর প্রতিটা মানুষকে আন্দোলিত করে। ‘২০ ও করেছিলো। মানব ইতিহাসে বিরল এক ভাইরাসে তছনছ করে দিলো একটি বছর। যেনো খুব দ্রুত গেলো বছরটি। মানুষের নতুন কিছু করার ছিলো না। শুধু একটি অতিমারি’র ছোবল থেকে বাঁচতে বাঁচতে আমরা নতুন ‘২১ কে বরণ করে নিলাম। কিন্তু মুক্তি কি মিলেছে? বছর চলে গেছে, আমরা কি হাফ ছেড়ে বাঁচতে পারি?
মনে পড়ে ২০২০ এর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মেয়েকে স্কুলে ড্রপ করছিলাম। মেয়ের মুখেই প্রথম শুনলাম করোনা নামক ব্যাধিটির নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন ‘কোভিড-১৯’। কারণ এটি তার আগের বছর ২০১৯ এর শেষে চীনের উহান প্রদেশে আবিস্কৃত হয়েছে। তখনও অস্ট্রেলিয়ায় কিংবা বাংলাদেশে আমরা ভাইরাসের নামগন্ধ পাইনি। তখনও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এটিকে সবাই রাজনৈতিক অস্ত্র ভেবেছি। অবশেষে সকলেই বাধ্য হয়েছেন এর ভয়াবহতা মেনে নিতে। প্রেসিডেন্ট নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন।
একদিন আগে প্রশান্তিকায় নিয়মিত কলাম লেখক শ্রদ্ধেয় রণেশ মৈত্র লিখেছেন, “ সেই মানুষকে, মানুষের জীবনকে, মানুষের পৃথিবীকে, তার জীবনকে চুরমার করে দিয়েছে ২০২০।” অবশ্যই সত্যি কথা। মানব ইতিহাসে একশ’ বছরের মধ্যে এমন মহামারী দেখা যায়নি। আজ বছরের প্রথম দিনে দাঁড়িয়ে যদি হিসেব করি আমরা হারালাম-
সারা পৃথিবীতে করোনা মহামারীতে প্রাণ হারিয়েছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার। মোট ৮ কোটি ৫ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো। যার মধ্যে ৪ কোটি ৫৪ লাখ মানুষ ইতোমধ্যে সেরে উঠেছেন। আমরা যে মহাদেশে বাস করি সেই অস্ট্রেলিয়ায় সর্বমোট ২৯ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো। যার মধ্যে ২০ হাজারই ভিক্টোরিয়া প্রদেশে। এখন পর্যন্ত ৯০৯ জন মারা গেছেন যার মধ্যে ৮২০ জনই মেলবোর্ন তথা ভিক্টোরিয়ায়। দেখা যাক বাংলাদেশের অবস্থা। ২০২০ সালের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে আক্রান্ত হয়েছে ৫ লাখ , মারা গেছেন ৭ হাজার ৫০০ , সেরে উঠেছেন ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। পুরো বিশ সাল গেলো করোনার মহামারী আর হাহাকারের পেঁছনে। যে ভ্যাকসিন আবিস্কার করতে বিজ্ঞানীদের বছর দশেক লেগে যায়, সেটা প্রায় এক বছরেই পাচ্ছি আমরা। আমাদের প্রত্যাশা একুশ সাল হবে এই মহামারী থেকে নিরাময়ের বছর।
পুরো একটি বছরে আমরা হারিয়েছি অসংখ্য গুণী মানুষ। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জামিলুর রেজা চৌধুরী, সংস্কৃতিজন আলী যাকের, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, চিত্রশিল্পী মর্তুজা বশির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, শিল্পপতি লতিফুর রহমান, সংস্কৃতিজন কামাল লোহানী, সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন আহমদ, সাবেক সচিব সা’দত হুসাইন, শিক্ষাবিদ বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সহ প্রমুখ কীর্তিমান বাঙালী।
দেশে থাকিনা বহু বছর হলো। পত্র পত্রিকা বা মিডিয়ার খবরে যা দেখি তা থেকে বলতে পারি দেশে যেমন বিশাল পদ্মা সেতু জোড়া লেগেছে। তেমনি দেশব্যাপি মৌলবাদীদের উত্থানও ঘটেছে- বঙ্গবন্ধুর দেশে বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষে তাঁর ভাস্কর্যে হাতুড়ির আঘাত এসেছে। জারি-সারি, থিয়েটার- যাত্রা, লোকগানের আসর যেমন আমার প্রিয় তেমনি ধর্মীয় জলছা বা হুজুরদের সুরেলা কন্ঠের বয়ানও আমার খুব প্রিয়। কিন্তু তাদের অধিকাংশ সকলে এমন উম্মাদ হয়ে গেছেন আজকাল যেনো। তারা কোরান আর সুন্না ছেড়ে হঠাৎ রাজনীতির মাঠ গরম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কি? উত্তেজনায় তারা মাইক ভেঙে ফেলছেন অনেকেই। না, এই সোনার বাংলাদেশকে দয়া করে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানাতে চেষ্টা করবেন না।
দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেও খবর পাই দেশে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। শেষ খবর পর্যন্ত এটি সর্বোচ্চ ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই জিনিসটা বুঝতে আমার অনেকদিন লেগেছে। বিদেশে আছি প্রায় ২১ বছর। অসংখ্যবার টাকা পয়সা পাঠিয়েছি। কখনও সরকারকে পাঠাইনি- তাহলে রিজার্ভে টাকা জমা হয় কেমনে? এখন বুঝি। আর বুঝি বলেই খটকা লাগে। প্রবাসীদের এই অবদানকি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কর্মীরা জানেন না? তারা আমাদের নিয়ে অনেক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন অযথা। এয়ারপোর্টের শিক্ষিত পুলিশ সদস্য কিংবা কাস্টমস অফিসার হাসিমুখে কোনদিন বলেন না- স্বাগত বাংলাদেশে। অথচ আমরা এয়ারপোর্টের ফটক পার হয়েই দেশের মাটি মাথায় মাখি। বিদেশে এই রীতির একটুও ব্যত্যয় হয়না। যতোবার দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি, পাসপোর্ট হাতে নিয়েই সুন্দর করে হেসে অফিসাররা বলেন- ওয়েলকাম হোম। যখন বাংলাদেশ পাসপোর্ট ছিলো, বলতেন- ওয়েলকাম টু অস্ট্রেলিয়া।
২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছি। খুব আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি নতুন বছরের ক্যালেন্ডারের সঙ্গে মিলে গেছে ১৯৭১ সালের ক্যালেন্ডার। ২১ ফেব্রুয়ারী, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৭ এপ্রিল, ১৪ ডিসেম্বর কিংবা ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের দিন আমরা একুশ সালের দিনগুলোতে হাত বুলিয়ে স্পর্শ করতে পারবো। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়গাঁথা, শহীদদের রক্তঋণ, লাখ লাখ মা বোনদের আব্রু ঢেকে দেব পরম ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়। মৌলবাদ এবং দেশ বিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠুক প্রিয় প্রজন্ম। গনতন্ত্র, উন্নয়নে, কৃষ্টি, সংস্কৃতিতে ও পদমর্যাদায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমাদের প্রিয় স্বদেশ। আর কিছু চাইবার নেই।
সকলকে ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা। শুভ হোক ২০২১। মহামারীর নিরাময় হোক।