বাবা ছিলেন খুব সাধারণ মানুষ। চাকরী সংসার নিয়ে ব্যস্ত তার রাজনীতি নিয়ে কোন আগ্রহ ছিলো না। মা বলেছিল গান্ধীজীকে মেরে ফেলাটা বাবা মানতে পারে নি। এক দিন এক রাত না খেয়ে অনশণ করেছিলেন নিজের মতো। বাবার মুখে ভয় দেখেছি পঁচাত্তরে। দেখেছি, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুব বিষণ্ণ ও হতাশ। কিন্তু যে রাতে ইনি ও এঁদের হত্যা করা হলো, বাবাকে দেখলাম উদ্বিগ্ন আর বিচলিত। এ ঘর ও ঘর করে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। বারবার বলছিল, এ দেশে আর কোন দিন নেতা জন্মাবে না। তাঁর মতো মানুষকে মেরে ফেলার অভিশাপ এই জাতিকে ক্ষমা করবে না।
এখন বুঝি, সাধারণ মানুষের অসাধারণ দৃষ্টি কাকে বলে। তাঁদের হত্যা করার পর এই দেশে আর কোন নেতা জন্মেছে? খেয়াল করবেন আজ পর্যন্ত আর কোন নেতা আসেননি। বরং নেতার নামে অভিনেতা আর ঠগ বাটপারে ভর্তি রাজনীতি। এককালে প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিং এর যে রাজনীতি তা শেষ হয়ে গেছিল চার জাতীয় নেতার হত্যাকান্ডে। সেদিক থেকে খুনীরা সার্থক। তারা যা চেয়েছিল তাই হয়েছে।
আজ দেশে নেতৃত্ব নাই। নেতার অভাবে রাজনীতির যে করুণ দশা তার মূলে এই হত্যাকান্ড। এখনো সঠিক বিচার কেন হয় নি? তার কারণ তো অজানা না। জানা উচিৎ সৈয়দ নজরুল, তাজ উদ্দীন আহমেদ আর কামরুজ্জামান, মনসুর আলীরা কেমন কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। সে কি কাল । সবাই বাকশালে যোগ দিচ্ছে। এমন কি আজ আওয়ামী লীগের মূল টার্গেট যে দল তার প্রধান জিয়াউর রহমানও যোগ দিয়েছিলেন। সবাই এমন ভাব দেখালেন যে বঙ্গবন্ধুর বিপ্লব শেষ না হ ওয়া পর্যন্ত তারা বাড়ী ফিরবে না। অথচ অন্যদিকে চলছিল ষড়যন্ত্র।
চারজন জাতীয় নেতাকে জেলখানায় নির্মম ভাবে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল কে জানেন? তাঁদের দলের নেতা, মাত্র সাড়ে তিন বছর আগেও যে ছিলো তাঁদের বন্ধু বেশী শয়তান। সেই বিশ্বাসঘাতক বেঈমান মোশতাকের বুক কাঁপেনি জেল খানার গেইট খুলে দেয়ার আদেশ দিতে। কি ভয়ংকর। এঁদের অপরাধ তাঁরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর পা দিয়ে দেশ শাসনতো দূরের কথা বঙ্গভবনেও যেতে চাননি। এঁদের মধ্যে তাজ উদ্দীন আহমেদ ছিলেন ব্যতিক্রম। এমন কি মৃত্যুর ব্যাপারেও। তখন তিনি হাত মেলালেও বলার কিছু ছিলো না। কিন্তু এই মানুষটি যে ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তিনি এ দেশটির জন্মলগ্নে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা নতুন প্রজন্ম জানে না। কত মিথ্যা কত ষড়যন্ত্র আর ছলনা। বড় বড় নেতাদের অনেকেই পাল্টি খাওয়ার জন্য তৈরী। মোশতাক বাইরের দেশে গিয়ে পাকিদের সাথে কনফেডারেশানের প্রস্তাব দেবে এমন গুজব বাজারে। তিনি দিল্লীকে বলে মোশতাকের বাইরে যাওয়া বন্ধ করিয়েছিলেন। তখন ইন্দিরার সচিব ছিলেন বাঙালি ডি পি ধর। এই ধর বাবুকে সব কিছু বুঝিয়ে বলতেন তিনি। এমনও শোনা যায় শেষদিকে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আর কৌশল বজার রাখার জন্য দিল্লী তাজ উদ্দীন আহমেদ ছাড়া আর কাউকে অনুমতি দিতো না ।একা তিনিই ছিলেন মুখপাত্র।
অথচ তাঁর হাত তখন খালি। দল তাঁকে একঘরে করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে ভুল বুঝিয়ে রাখা লোকদের কারণে তিনি একদিনের জন্যও সময় পাননি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলার। ইতিহাস জানানোর।৭১ সালে কলকাতায় একদিকে যেমন মুক্তির জন্য লড়াই আরেক দিকে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা সে অভয়ারণ্যে মজা নিতে ব্যস্ত। তাদের বিলাস আনন্দ নারীসঙ্গ ছিলো কাহিনী। ইনি তখন পরিবারের সাথে না থেকে অফিসের মেঝেতে ঘুমাতেন। কোন বিশেষ বাহিনীর পরিবর্তে মুক্তিবাহিনীর নামে যুদ্ধ পরিচালনা করার প্রতিজ্ঞা তাঁকে কতবার বিপদে ফেলেছে। নিজেদের লোকরাই মাথা গরম করে বন্দুক নিয়ে গেছে মেরে ফেলার জন্য। পারে নি। মারলো স্বাধীন দেশের কিছু খুনী জওয়ান।
গত বৃহস্পতিবার সারাদিন ঢাকায় ছিলাম। রাত দুপুরে ফ্লাইট বলে কোথাও বের হই নি। তবে একটি তীর্থস্থান মিস করিনি। বিষণ্ণ অপরাহ্নে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছিল আলীশান সব গাড়ি। চোখ খুললেই সুরম্য আকাশ চুম্বি অট্টালিকা। দুনিয়ার যে কোন শহরের তুলনায় লেভিস চাকচিক্যময় দেশের লোকজন কি জানেন বনানীর ঘাসে ঢাকা ছোট কবরটিতে শুয়ে আছেন এ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। যাঁর ত্যাগ ও বিচক্ষণতা ছাড়া এ দেশ স্বাধীন হতো না। সারাজীবন সাদা হাফ হাতা সার্টের এই মানুষটির সাথে শেষ হয়ে গেছে শুভ্রতা ও স্বচ্ছতার রাজনীতি। বাংলাদেশকে চার জাতীয় নেতা উপহার দিয়ে গেছেন বিশ্বাসের রাজনীতি। তাজ উদ্দীন নাকি তাঁর পরিবারের লোকজনকে বলেছিলেন , মুজিব ভাই তাঁকে ডাকছে। বলছেন চলে আয়। তোকে ছাড়া ভালো লাগছে না। আহা রে ইতিহাস। যে মানুষটি জীবদ্দশায় পর হয়ে থাকলো যাঁকে মোশতাক গং কাছে ভিড়তে দিলো না আশ্চর্যজনক ভাবে বঙ্গবন্ধুরও সময় হলো না একবার তাঁর কথা শোনার, সে মানুষটার নাম শোনার সাথে সাথে খুনীরা এমন ভাবে গুলি চালিয়েছিল মনে হতে পারে তারা কোন শত বছরের দুশমন খুঁজে পেয়েছে। মেরেও তারা শান্তি পায় নি। লাশ নেড়ে চেড়ে দেখেছে আছে কি নাই। জেলখানার মত নিরাপদ জায়গা যেখানে লেখা থাকে রাখিব নিরাপদ সেখানে জেইলারের অসম্মতিতে জোর করে প্রেসিডেন্ট নামধারী মীরজাফর বেঈমান মোশতাকের অনুমতি নিয়ে চার নেতাকে হত্যা করা হয়। আজকের প্রজন্ম কি তা জানে? যারা বুকে ব্যানার ঝোলায় এদেশে কেবল তারাই অনিরাপদ তাদের বলি, এঁরা স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। আমাদের পতাকা সঙ্গীত ভূমি দিয়েছেন কিন্তু আমরা তাঁদের বাঁচতে দেইনি। এই কৃতঘ্নতা কি ইতিহাস বা সময় মাফ করবে? যতদিন এর সুষ্ঠু বিচার ও ইতিহাসে এঁদের আলো এসে না পড়বে, যতদিন তাঁদের একটু হলেও ছোট করে রাখা হবে ততদিন রাজনীতির মুক্তি নাই।
সালাম চার জাতীয় নেতা। শ্রদ্ধা প্রিয় তাজউদ্দীন আহমেদ।
অজয় দাশগুপ্ত
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সিডনি,অস্ট্রেলিয়া।