‘৭৫ সালে পরাজিত শক্তি আমাদের স্বাধীনতার চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছিলো: ইসহাক খান

  
    

 

১৯৭১ সাল। রক্তক্ষয়ী ৯ মাসের যুদ্ধে বীর বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত করেছিলেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম ও আত্মত্যাগ এবং অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর প্রাণ। ঘৃণাভরে ধিক্কার জানাই পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতকদের। বিজয়ের এই মাসে আমরা প্রশান্তিকায় শ্রদ্ধা জানাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
আজ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে আমাদের নিবেদন বীর মুক্তিযোদ্ধা কথাসাহিত্যিক ইসহাক খান, যিনি একসময় অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন। এখন সেই হাতে কলম। দেশ ও দেশের কল্যাণে তাঁর যুদ্ধ চলছে নিরন্তর। পড়ুন লেখকের বয়ানে:

জন্ম: আমার জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার কানসোনা গ্রামে। সেদিন ছিলো বাংলা ১৩৬২ সনের ২৩ শ্রাবণ।

প্রশিক্ষণ: আমি ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছি। প্রশিক্ষণ নিয়েছি ভারতের মেঘালয় রাজ্যে তুরার পাহাড়ে। ময়মনসিং অঞ্চল ছিল আমাদের যুদ্ধের এলাকা। আমাদের যুদ্ধ শুরু হয় ভয়াবহ কামালপুর সেক্টর হতে।

যুদ্ধ: গোটা নয়মাস ধরেই আমাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। আলাদা করে কি বলবো। তবে একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমরা তখন সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলায় অবস্থান করছি। জামতৈল স্টেশনের অদূরে একটি ব্রিজ আছে নাম ছাগলা পাগলার ব্রিজ। আমরা সেই ব্রিজ ধংস করতে যাচ্ছি। ১০০ জনের একটি বাহিনী। আকাশে কৃষ্ণ চাঁদ। আমরা জমির আল দিয়ে লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সংবাদদাতা আমাদের জানিয়েছেন, ব্রিজে ১০ জন রাজাকার পাহাড়ায় থাকে। আমাদের সিদ্ধান্ত, প্রথমে আমরা রাজাকারদের আত্মসমর্থন করিয়ে কারপর আমাদের ইঞ্জিনিয়ার কোরের সৈনিকরা ব্রিজে এক্সপ্লোসিভ ফিট করবে। আমরা নিরাপদ দুরুত্বে এসে ফিউজে আগুন দেব। তারপর বিকট শব্দে ব্রিজ উড়ে যাবে। কিন্তু পথে বাজলো গোলমাল। আমরা ব্রিজ থেকে মাইলখানেক দূরে আছি। এই সময় আমাদের কাছাকাছি থেকে হঠাৎ আমাদের লক্ষ্য করে কারা যেন গুলি ছোড়ে। আমরাও দ্রুত পজিশন নিয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকি। তুমুল য়ুদ্ধ শুরু হয়। ঘণ্টাখানেক য়ুদ্ধ চলার পর আমাদের কমান্ডার ‘জয়বাংলা’ বলে ধ্বনি দিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও জয়বাংলা বলে চেঁচিয়ে উঠি। তখন ওরা আমাদের চমকে দিয়ে জয়বাংলা বলে ধ্বনি দিয়ে ওঠে। তখন আমাদের কমান্ডার যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কারা? তোমাদের কোম্পানির নাম কি? ওরা কোন জবাব দিছিল না। কমান্ডার তখন আমাদের একজনকে ওদের কাছে পাঠালেন। সে যদি ৫ মিনিটের মধ্যে জয়বাংলা না বলে আমরা ওদের সাড়াশি আক্রমণ করবো। আমাদের সেই সৈনিক জীবন হাতে নিয়ে জয়বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে ওদের কাছে যায়। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সে জোরে জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে ওঠে। তারমানে আমাদের সেমসাইড হয়ে গেছে। ভুলটা ছিল ওদের। পরে এ জন্যে ওদের শাস্তি পেতে হয়েছে।

পরিবারের সাথে ইসহাক খান

অবসর: এখন লেখালিখি ছাড়া আর কিছু করি না। করার সময় এবং বয়স আর নেই। এখন লেখালিখি করে সময় পার করি। সময় কাটে স্ত্রী শ্যামলী খান ও দুই কন্যা অমৃতা খান ও আনন্দিতা খানের সঙ্গে। বড় কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে একটি নামি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছে, ছোটটা এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে নিয়মিত কলাম লিখেও সময় চলে যায়। টেলিভিশনের জন্য নাটক লেখা ছাড়াও গল্প ও উপন্যাস লিখে যাচ্ছি নিরন্তর।

গ্রন্থ: আমার গ্রন্থের সংখ্যা ৫০। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থ ১০ টি। আমি প্রতিবছর কিশোরদের জন্য একটি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখছি। আমার এ ধারা অব্যাহত থাকবে। সবই আমার দেখা ঘটনা, আমি সেগুলোই লিখে যাচ্ছি। এবার লিখছি,’পাগলা ডাক্তারের বিচ্ছু বাহিনি।’ আসছে বইমেলায় এটি প্রকাশিত হবে।

রবীন্দ্রসরোবরে প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছেন ইসহাক খান

কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন: একটি উদার গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরাজিত শক্তি আমাদের স্বাধীনতার চাকা ঘুরিয়ে দেয় ১৯৭৫ সালে। সেই ক্ষত জাতিকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় আমরাও বিধ্বস্ত হয়ে আছি। এই অবস্থা থেকে জাতি আবার ঘুড়ে দাঁড়াতে পারবে বলে আমি সন্দিহান।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments