[ নৌটাঙকী থিয়েটার এর ‘টেন ইয়ার্স টু হোম- বছর দশে (ঘরে) ফেরা!’র অভিবাসন বাস্তবতা ]
নদী পাড়ে একটা নাট্যশালা আছে। সেখানে নিয়মিত নাটক, অপেরা বা মিউজিক্যাল আর চলচ্চিত্র প্রদর্শন হয়। খোদ পাড়ামাতাতেই রিভার সাইড থিয়েটার। নদীময় নাট্য শালা! বছর তিনেক এর প্রশান্ত নিবাসে একবার শুধু নীল বাবুর নিমন্ত্রণ রাখতে ফ্ল্যাট মেট আশরাফকে নিয়ে নগদ মূল্যে টিকেট কেটে ‘কারী কিং পাড়ামাতা’ দেখেছি। সেবার নাটক দেখে যেমন আনন্দ পেয়েছি তেমনি সিডনির পশ্চিমের ইমিগ্রান্ট বা অভিবাসী কমিউনিটি সম্পর্কে একটা ধারণাও হয়েছে। ভেবেছিলাম আর যেতে হবে না। ব্যানার্জী মশায়, যিনি নৌটাঙকী থিয়েটার এর কর্নধার- তিনি সে ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে দিলেন। রীতিমতো ভি. আই. পি. এর মতো নাম লিখে সৌজন্য টিকেট খানা রেখে দিয়েছেন। ‘টেন ইয়ার্স টু হোম- বছর দশে (ঘরে) ফেরা!’ নাটক দেখার সুযোগটা করেই নিতে হল।

গাঙ পাড়ের মানুষ বলে কথা। দেখি পাড়ামাতা নদী কি কথা কয়! হাজার বছর আগে চাঁদনী রাতে দারুগ আদিবাসী মানব-মানবীরা কি শীতের সন্ধ্যায় গান বাদ্যি করতো? বলতো কি কিভাবে তারা ঘর বেঁধেছিল এই মায়াময় নদীর জলের সিথানে? গুনিয়ালাঙ্গালুঙ, গুনিয়ালাঙ্গালুঙ বলে কি উলু দিত! বলতো কি আমি স্বপ্ন দেখি একটি গৃহের, আমি সেই আদি মানবী! এই সে বুরামুত্তার শান্ত জল ঘুরে ঘুরে নগুবাদী নগুবাদী আওয়াজ তুলে, সে আসলে আমার প্রাগৈতিহাসিক কালের ভালবাসা!
বুরামুত্তা আদিম কিশোরী অভিবাসীদের হাতে পড়ে নগর নন্দিনী পাড়ামাতা হয়েছে! নদী পাড়ে একটা নাট্য শালা- রিভার সাইড থিয়েটার। এই বেলা থিয়েটার Lennox এ ঢুকি। তা সিটখানা যা পড়লো বাবা, একেবারে নাট্য নির্দেশকের পিছনে। মঞ্চে পাদ প্রদীপের আলোয় পাঁচ খানা কাঠের ব্লক- বাক্স। সময় ধরে নাটক শুরু হল। হলও ভরে গেছে! শুরু হল নয়া অভিবাসনের পালা- তিন রমনীর ক্বাসিদা।
রীমা জিলানী যিনি নাটকের মূল চরিত্র বসন্ত (Vasant) মঞ্চে তুলে আনলেন তিন প্রজন্মের অস্ট্রেলিয়া অভিবাসনের ইতিহাস। তৌফিক শেখ যিনি রুশী চরিত্রে অভিনয় করেন প্রথম ইন্সুরেন্স কোম্পানির কাজ নিয়ে ১৯৫০ এর দিকে অস্ট্রেলিয়া আসেন। উচ্চ শিক্ষিত গুজরাটি ভারতীয় হিসেবে কিভাবে তিনি তার পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকত্ব অর্জন করে নিলেন এবং পরবর্তীতে তার কন্যা ও দৌহিত্রী এক সমন্বিত নয়া সমাজ তৈরী করলেন সেই পারিবারিক নিটোল গল্পটাই অভিনয় হল মঞ্চে। এ এমন নতুন কিছু নয়। তাহলে এত ঢাক ঢোল বাজনা কেন ? নাটকটি এই গোটা অভিবাসনকে একজন পরিশ্রমী ও শ্নেহময়ী নারীর নাড়ীর খবর দেয়। যেখানে ইমিগ্রেশনকে ফাঁকি দিয়ে আনা কারী পাতার গাছ বাগানে বেড়ে ওঠে। আর তার ডালপালা পাতা প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। এটাই এই গল্পের নান্দনিক রূপকল্প। নয় বাস্তবতা। গুনিয়ালাঙ্গালুঙ। ভালবাসার সতেজ পাতা!!! কিন্তু কিভাবে নৌটাঙকী পেল এমন গল্পের নাগাল?

সে আরেক ইতিহাস। নাটকের সংগঠনটি ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ড্রামা সূত্র নামে এক নাট্য নির্মাণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করে। যার সূত্রে নাটক লেখা, পঠন, নির্দেশক নিয়োগ ও প্রযোজনা এবং প্রদর্শন হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রথমে যুক্ত হন নাটককার সোনাল মুর- যিনি তার জীবনের গল্পের তার, মা’র ভালবাসার কারীপাতার ঘ্রাণ সংলাপে নির্মাণ করেছেন। তার ভাষা এমন অকপট যে বসন্তের মেয়ে সোনাল হিসেবে স্বয়ং নিজে নাটকে মূর্তিমান। সোনালের সাথে নির্দেশক জুলস ওরকুলও নাম না উল্লেখ করলে এ বয়ান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। নির্দেশক এই নারী ফিলিপিনো বংশদ্ভুত অস্ট্রেলিয়ান হয়েও সব চরিত্রকে মাত্র পাঁচটি কাঠের ব্লক দিয়ে তৈরি মঞ্চের আলো ছায়ায় দাড় করিয়েছেন -সে আরেক ভালবাসার মুন্সিয়ানা। দুংখজনক বিষয় হল নাটকটি সাকুল্যে ১৭০ জন দর্শক দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছে পর পর দু’টি প্রদর্শনীতে।

নিয়মিত থিয়েটার চর্চা করা অস্ট্রেলিয়াতে খুব সহজ নয়। বিশেষ করে নাট্য চর্চাকে যেখানে এখনো পেশা হিসেবে নেয়ার সুযোগ নেই। তাই সবাইকে কাজ করতে হয় অন্তর দিয়ে। প্রাণের টানে। সেই তো সেই অভিবাসন আর ভালবাসার গল্প। জয়তু রিভার সাইড থিয়েটার। অভিবাদন বুরামুত্তা জলের সিথান। অভিনন্দন নৌটাঙকী Nautanki Theatre.